জামায়াতের দুই দুর্গ তছনছ করে ভোটের মাঠেও নির্ভার এমপি নদভী

চট্টগ্রামে জামায়াত ইসলামীর দুটি দুর্গ ছিল। এই দুর্গের একটি সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসন, অপরটি হলো সীতাকুণ্ডের কুমিরায় পাহাড়ি অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (আইআইইউসি)। এই দুই স্থানে কখনও কেউ উচ্চারণ করতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কথা, বঙ্গবন্ধুর কথা। এখানে কেউ রাজনীতিও করতে পারতো না জামায়াতের বাইরে। তবে গত ৮ বছরে সে পরিস্থিতি পালটে দিয়েছেন একজন। তিনি প্রফেসর ড. আবু রেজা মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভী। এই দুই দুর্গে তার কৌশলের কাছে মার খেয়েছে জামায়াত। এ দুই জায়গায় এখন চর্চা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার।

জানা গেছে, প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থীর আইআইইউসিতে জামায়াতের কারণে চলছিল অচলাবস্থা। প্রফেসর ড. আবু রেজা নদভীকে সরকার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান করার পর গত এক বছরেই এ অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠেছে। নতুন ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের এক বছরের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের লাল তালিকাভুক্তি থেকে উত্তরণ ঘটলো এই প্রতিষ্ঠানের। বছরখানেক আগেও একপ্রকার তালা ঝুলতে যাওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশাসনিক, একাডেমিক ও অবকাঠামো উন্নয়ন সমানতালে এগোচ্ছে।

এই ক্যাম্পাসে একাডেমিক পরিবেশ নিশ্চিতের পাশাপাশি এখন শুরু হয়েছে প্রগতির চর্চাও। দীর্ঘ সময় ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সামনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের কোনো বিষয় উপস্থাপিত হতো না। কারণ দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সংগঠন জামায়াত ইসলামীর নিয়ন্ত্রণে।

বর্তমান ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবু রেজা মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন উদযাপন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উদযাপন, বঙ্গবন্ধু রিসার্চ সেন্টার, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে মুজিব কর্নার স্থাপন করা হয়েছে গত এক বছরে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষক-শিক্ষার্থী নিয়ে কেন্দ্রীয় অডিটরিয়ামে নিয়মিত আয়োজন করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল লেকচার। বর্তমানে একের পর এক কর্মসূচির মাধ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চর্চা করা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদগুলোতে বিভিন্ন পদে নিয়োগ ও পদায়ন করা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ও প্রগতিশীল ব্যক্তিদের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মনোনীত করা হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফকে।

অতীতে এই পদগুলো ছিল জামায়াতপন্থী শিক্ষক ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের ক্যাডারদের নিয়ন্ত্রণে। অভিযোগ রয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলকে ঘাঁটি ব্যবহার করেই ২০১৩-২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপসহ নানা নাশকতা চালিয়েছিল জামায়াত-শিবির।

আইআইইউসি সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছরের মার্চে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের সাংসদ ও এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক প্রফেসর ড. আবু রেজা মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মনোনীত করে চিঠি দেয় শিক্ষা মন্ত্রনালয়। তার আগে জামায়াত নেতাদের অবৈধ ট্রাস্টি বোর্ডের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ নানা বিষয় উল্লেখ করে সরকারের কাছে নতুন ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের আবেদন জানিয়ে যৌথভাবে চিঠি দেন আইআইইউসির প্রতিষ্ঠাকালীন ট্রাস্টি বোর্ড সদস্যের সন্তান বায়তুশ শরফের বর্তমান পীর মাওলানা আব্দুল হাই নদভী ও বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রিজিয়া রেজা চৌধুরী। তাদের এই চিঠির পরপরই সরকার এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিমেল একাডেমিক জোনের চেয়ারম্যান রিজিয়া রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপনসহ মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু আদর্শ চর্চার নানা অনুশীলনমূলক কর্মসূচির পরিকল্পনা প্রনয়ণ ও বাস্তবায়নের কাজ চলছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে সাংসদ প্রফেসর ড. আবু রেজা নদভীকে নিয়োগ দেওয়ার নেপথ্যে সরকারের বিবেচ্য বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রী দপ্তরের একাধিক সূত্র জানায়, বাঙালি আলেমদের মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বর্তমানে প্রফেসর ড. নদভীর রয়েছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। আইআইইউসিকে পূনর্গঠনে একসময়ের বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ড সদস্য ও প্রতিষ্ঠাকালীন অন্যতম উদ্যোক্তা প্রফেসর ড. নদভীর বিকল্প নেই বলে মনে করে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।

অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনে কখনও নৌকা প্রতীক বিজয়ী হতে পারেনি। এই আসনে প্রথমবারের মত টানা দুইবার নৌকা প্রতীককে বিজয়ী করে এনেছেন প্রফেসর ড. আবু রেজা নদভী। জামায়াতকে তাদের প্রতিষ্ঠিত ঘাঁটিতে ‘তুলোধুনো’ করার কারিশমা দেখিয়েই সরকারের কাছে নিজের গুরুত্ব পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন আওয়ামী লীগের এ সংসদ সদস্য।

দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের মানুষ বেশ ধর্মপরায়ণ। তাদের এই ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে জামায়াত ইসলামী আওয়ামী লীগকে একটি ‘ইসলামবিরোধী’ দল বলে অপব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ভোট আদায় করতো যুগের পর যুগ ধরে। এদের এই অপব্যাখ্যার বিপরীতে একজন ইসলামিক স্কলার হিসেবে প্রফেসর নদভী ও তার স্ত্রী রিজিয়া রেজা চৌধুরী ভোটারদের ঘরে ঘরে গিয়ে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু যে ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তা তথ্য-উপাত্ত এবং যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। একজন ইসলামিক স্কলার হিসেবে প্রফেসর নদভী ও তাঁর স্ত্রী রিজিয়া রেজা চৌধুরী আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার ফলে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় জামায়াত ইসলামীর ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে পুঁজি করে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা মাঠে মারা যায়।

এর আগে ওই অঞ্চলে জামায়াত নারীদের বুঝিয়েছিল, ‘নৌকায় ভোট দিলে বেহেশতে যাওয়া যাবে না। আওয়ামী লীগ ইসলামের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক দল। তাই ভোট দিতে হবে দাড়িপাল্লায়।’

ধর্মপরায়ণ নারীদের সামনে জামায়াতের এই মিথ্যা অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধে প্রথমবারের মত শক্ত অবস্থান নেন রিজিয়া রেজা চৌধুরী। আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও আদর্শের বিষয়ে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে সক্রিয়ভাবে রিজিয়া রেজা চৌধুরী অসংখ্য উঠান বৈঠক করেন। তিনি নারীদের সংগঠিত করে ওই দুই উপজেলায় সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে থাকায় ওই অঞ্চলের নারীরা আওয়ামী লীগকে নতুন করে চেনার সুযোগ পায়। বর্তমানে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার বহু নারী রিজিয়া রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে সক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছে। যে অঞ্চলের নারীরা কখনও জামায়াতের বাইরে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনকে বিশ্বাস করতো না, তারা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে রিজিয়া রেজা চৌধুরীর ডাকে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিচ্ছে।

সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের মতে, সাতকানিয়া-লোহাগাড়া জামায়াতের আঁতুড়ঘর। এখানে পুরুষরাই কখনও আওয়ামী লীগের নাম মুখে নিতে পারতো না। সে জায়গায় সাংসদ ড. আবু রেজা নদভীর সহধর্মিনী নারীদেরও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিজেদের ঘাঁটিতে জামায়াতকে শুধু ‘বধ’ করাই নয়, হেফাজতে ইসলাম এবং কওমী মাদ্রাসাগুলোতে জামায়াতের দখলদারিত্বেও বাগড়া বসিয়েছেন সাংসদ নদভী। এসব জায়গায় জামায়াতের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল অতীতে। কিন্তু এখন সেখানে সাংসদ নদভী ইসলামিক স্কলার হিসেবে নিজ দক্ষতায় ছড়িয়ে দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। এখন যার রাজনৈতিক ফসল যাচ্ছে আওয়ামী লীগের ঘরে।

আবার মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক যোগসূত্র স্থাপনের সেতু তৈরিতেও ভূমিকা রেখে চলেছেন ড. নদভী। এ জায়গায় আগে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী। সরকারের চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে নিয়মিত তিনি সফর করছেন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলোতে। মূলত এসব কারণেই আওয়ামী লীগ ও সরকারের উচ্চপর্যায়ে আস্থাভাজন হয়েছেন সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার এ সংসদ সদস্য।

এছাড়াও রাজনৈতিক প্রভাবের পাশাপাশি সারাদেশে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা স্থাপনসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থেকে দেশজুড়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে বেশ প্রশংসিত প্রফেসর ড. নদভী। তিনি এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন।

এ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের অধীনে প্রফেসর ড. আবু রেজা নদভী সারা দেশে নির্মাণ করেছেন প্রায় এক হাজার মসজিদ। দেশের বিভিন্ন স্কুল, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করেছেন তিনি প্রায় শতাধিক ভবন। দেশের প্রায় ৪০০ মসজিদের অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে তার হাত ধরেই। এছাড়াও প্রায় ৫০টি জেলায় বিস্তৃত রয়েছে ড. নদভীর প্রতিষ্ঠিত আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের সেবা কার্যক্রম। এ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে টেকনাফে রোহিঙ্গাদের জন্য এক হাজার বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় অসহায় মানুষকে নির্মাণ করে দিয়েছেন কয়েক শত বাড়ি। এছাড়া ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমেও আইআইইউসিতে বিভিন্ন ভবন নির্মিত হয়েছে।

জানা গেছে, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, আমিরাত, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে সাংসদ নদভী সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। যাতে কেউ সরকারের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করতে না পারে কিংবা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে না পারে। এই রাষ্ট্রগুলোর বিভিন্ন পর্যায় থেকে আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে উন্নয়ন সহযোগিতা নিয়ে আসছেন এমপি নদভী।

শুধু তাই নয়, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ডসহ আরও কয়েকটি রাষ্ট্রও আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এ দেশে উন্নয়ন সহযোগিতা করে আসছে। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবে তাঁর এই কর্মকাণ্ড প্রকারান্তরে দলটির পক্ষে জনমত ধরে রাখতেও সহায়ক ভূমিকা রাখছে।

আইআইইউসি সংশ্লিষ্টরা জানান, অতীতে আইআইইউসি ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য থাকাকালীন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছ থেকে অনুদান এনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন করেছেন প্রফেসর ড. আবু রেজা নদভী। আইআইইউসির সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক যেসব কর্মকান্ডের চুক্তি হয়েছিল, সেসব চুক্তিতে বাংলাদেশ তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করতেন তিনি।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াত নেতাদের কেউ কখনও বিদেশি অনুদান আনতে পারেনি। কিন্তু জামায়াত কৌশলে তাদের নেতাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা শুরু করলে এতে জোর আপত্তি তোলেন প্রফেসর ড. নদভী। জামায়াতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেওয়ায় প্রফেসর ড. নদভীকে আইআইইউসি ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য পদ থেকে রাতারাতি অব্যাহতি প্রদান করে জামায়াত নেতাদের মদদপুষ্ট প্রশাসন। এরপর থেকে একচেটিয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় দেশব্যাপী শুরু হয় জামায়াতের অর্থায়ন।

অভিযোগ উঠে, গত বছরের মার্চে আইআইইউসির নতুন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর ও জামায়াত মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার সাবেক সদস্য মাওলানা শামসুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর অধ্যাপক আহসানুল্লাহ, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা জামায়াতের আমীর এবং জামায়াতের কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য আমিরুজ্জামান, চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের সাংগঠনিক সম্পাদক ও শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি আজম ওবায়দুল্লাহ, দক্ষিণ জেলা জামায়াতের আমীর জাফর সাদেক, চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের আমীর ও শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোহাম্মদ শাহজাহান। সরকার প্রফেসর ড. নদভীর নেতৃত্বাধীন ট্রাস্টি বোর্ডকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার আগে জামায়াতের এই নেতারাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন।

নতুন ট্রাস্টি বোর্ড দায়িত্ব নেওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয় বারবার দিনের পর দিন বিনা কারণে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার মত কোনো অর্থও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে ছিল না। এমন অচলাবস্থায় পড়ে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে এক বছরের ব্যবধানে আর্থিক ও একাডেমিকভাবে সমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেছে প্রফেসর ড. আবু রেজা মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভীর নেতৃত্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

তারা আরও জানান, প্রফেসর ড. নদভী দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি ও শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দিয়ে জামায়াত নেতারা তাদের দল পরিচালনা করতেন। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতেও কোটি কোটি টাকা এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়ে গেছে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা। চট্টগ্রাম ও সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় দায়ের হওয়া নাশকতাসহ প্রায় শতাধিক রাজনৈতিক মামলা পরিচালনা করা হতো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায়। যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক বেতন-ভাতাও দিতে পারছিল না জামায়াত প্রভাবিত প্রশাসন। শুধু তাই নয়, বছরের পর বছর বন্ধ ছিল শিক্ষক, কর্মকর্তা কর্মচারীদের ইনক্রিমেন্টও। নতুন প্রশাসন আসা মাত্রই প্রভিডেন্ট ফান্ড পুনর্গঠনসহ প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে কাজ শুরু হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। এছাড়া প্রত্যেককে ২০ শতাংশ হারে বেতন-ভাতা বৃদ্ধিরও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

সারাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ের জামায়াত ক্যাডারদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দেওয়া হতো জানিয়ে আইআইইউসির একাধিক শিক্ষক জানান, কোটি কোটি টাকা নগদেই লোপাট করা হচ্ছিল এই প্রতিষ্ঠান থেকে। এই লোপাটের নেতৃত্ব দিয়েছেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা। সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনে জামায়াতের নির্বাচনী ফান্ডও তৈরি হতো এই প্রতিষ্ঠানের টাকায়।

এই প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর মাওলানা শামসুল ইসলামের রাম-রাজত্ব। তার কথাই ছিল এই প্রতিষ্ঠানে শেষ কথা। নাশকতার মামলার আসামি থেকে শুরু করে শামসুল ইসলামপন্থী জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের এই প্রতিষ্ঠানে লাখ টাকা বেতন দিয়ে করা হয়েছিল পুনর্বাসনও। তাদের অনেকেই তাই চাকরি না করেও তুলে নিতেন বেতন।

কিন্তু নদভীর নেতৃত্বে গত এক বছরে জামায়াতের একাডেমিক ও আর্থিক এই দুর্গ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের সব স্তর থেকে বিভিন্ন নাশকতার ঘটনায় জড়িত জামায়াত নেতাদের দেওয়া হয়েছে অব্যাহতি। এসব জায়গায় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রগতিমনা স্কলারদের। ঢেলে সাজানো হয়েছে একাডেমিক সেক্টর। অবকাঠামো উন্নয়নে হাতে নেওয়া হয়েছে ১০০ কোটি টাকা প্রকল্প। গবেষণাখাতে আমুল পরিবর্তনের লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে বিশেষ উদ্যোগ৷ অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে বিভিন্ন পর্ষদ ও কমিটি গঠন করা হয়েছে নতুন করে। যে ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামই নেওয়ার সুযোগ ছিল না প্রতিষ্ঠার পর সে ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এখন বঙ্গবন্ধু কর্ণার ও বঙ্গবন্ধু রিসার্চ সেন্টার।

এদিকে নতুন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু রেজা নদভীর নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মাওলানা আব্দুল জব্বার শাহ হল, শরীয়াহ ফ্যাকাল্টি ভবন, দ্বিতীয় সায়েন্স ফ্যাকাল্টি ভবন, নতুন প্রশাসনিক ভবন। এছাড়া আইআইইউসির বহদ্দারহাট ক্যাম্পাসে এক হাজার আসনের ১৫ তলা ছাত্রী হোস্টেল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

আইআইইউসির একাধিক ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ বলেন, প্রতিনিয়ত জামায়াতের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হচ্ছে নদভী পরিবারকে। জামায়াতের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কোনো কোনো ভূইফোঁড় গণমাধ্যম আইআইইউসি ও সাতকানিয়া-লোহাগাড়া নিয়ে মিথ্যাচার করেও ব্যর্থ হচ্ছে। অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা না পেয়ে আইআইইউসি সংশ্লিষ্ট এবং আইআইইউসির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে দুর্নীতির দায়ে সম্প্রতি অপসারিত এক ব্যক্তি জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে এসব ভূইফোঁড় গণমাধ্যমকে টাকার বিনিময়ে ব্যবহার করছে।

সার্বিক বিষয়ে আইআইইউসি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবু রেজা মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘তলাবিহীন ঝুড়ি অবস্থায় দায়িত্ব নেওয়া আইআইউসি এখন সমৃদ্ধ আর্থিক ও একাডেমিকভাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আমাকে এই প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার পর বর্তমান বোর্ড অব ট্রাস্টের নেতৃত্বে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ্য সিন্ডিকেট সদস্যদের পরামর্শে একাডেমিক ও অবকাঠামো উন্নয়ন শুরু করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা এশিয়া মহাদেশের জ্ঞানচর্চার একটি সমৃদ্ধ ক্ষেত্র হিসেবে তৈরি করতে চাই। আমরা শিক্ষার্থীদের মেধা ও যোগ্যতা বিকাশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবদান রাখতে পারে এমন উপযোগী প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি আমরা।’

তিনি বলেন, ‘অবকাঠামো উন্নয়নে ইতোমধ্যে প্রায় ১০০ কোটি টাকার প্রকল্প আমরা বাস্তবায়নের চিন্তা করছি। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মননে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালনের পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপন করেছি মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার ও বঙ্গবন্ধু রিসার্চ সেন্টার। যেগুলো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতে ছিল না।’

সাংসদ নদভী আরও বলেন, ‘দীর্ঘ ২০ বছরের অধিক সময় ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয় যুদ্ধাপরাধের দায়ের অভিযুক্ত ও স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক, একাডেমিক ও আর্থিক ঘাঁটি ছিল। সর্বশেষ অবৈধভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামী মীর কাশেম আলীর বেয়াই, জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাওলানা শামসুল ইসলাম। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও কেউ তাদের অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেনি। তারা এখান থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে গেছে। এই টাকায় দেশে অরাজকতা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালিয়েছে। গত এক বছর ধরে তা আর সম্ভব হয়নি। এখানকার শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরাও জামায়াত নেতাদের হাতে পদে পদে নিগৃহীত হয়েছে। আমরা দায়িত্ব নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!