জামায়াতের ঘাঁটি চকবাজারে মিন্টুকে হটাতে মরিয়া আওয়ামী লীগেরই ফরহাদ

পাঁচ বার কাউন্সিলর হয়েও উন্নয়ন হয়নি—ক্ষোভ এলাকায়

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জামায়াত-শিবিরের ‘আঁতুড়ঘর’ হিসেবে পরিচিত ১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ডে নির্বাচনী লড়াই জমে উঠেছে মূলত দুজন প্রার্থীকে ঘিরে। দুজনই আওয়ামী লীগের। দুজনই আবার এলাকায় প্রভাবশালী। এর মধ্যে চকবাজার ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন চকবাজার থানা আওয়ামী লীগের ‘উপদেষ্টা’ সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টু। তবে দলের মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হলেও এবার সেখানে শক্ত প্রার্থী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা দেলোয়ার হোসেন ফরহাদ। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের বড় অংশই এবার ফরহাদের পক্ষে কাজ করছেন।

মিন্টু থানা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা নন জানিয়ে তার বিরুদ্ধে ভুয়া রাজনৈতিক পদবি ব্যবহার করে কাউন্সিলর মনোনয়ন বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলনও করেছে চকবাজার থানা আওয়ামী লীগের বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা।

এই ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর পদে এবার আরও নির্বাচন করছেন চকবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ডা. মোশারফ হোসেনের সন্তান দেলোয়ার হোসেন ফরহাদ। তিনি নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য। চকবাজার এলাকায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় চরম মূল্য দিতে হয়েছে এই পরিবারটিকে। ১৯৮৯ সালে ফরহাদের বড় ভাই মো. ইউসুফকে প্রকাশ্যে জবাই করে হত্যা করেছিল শিবিরের সন্ত্রাসীরা। সে সময় ওই হত্যাকাণ্ড এতটাই আলোচিত ছিল যে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ফরহাদের পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিতে ছুটে গিয়েছিলেন তাদের বাসায়। এছাড়া ফরহাদের আরেক ভাই জাকির হোসেন ছিলেন মহানগর ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, অন্য ভাই একরাম হোসেন নগর যুবলীগের সদস্য ও ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি। তাদের ওপরও বিভিন্ন সময়ে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছিল জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা।

চকবাজারে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠায় পিতা ও ভাইয়ের যে ত্যাগ সংগ্রাম তার চূড়ান্ত বিজয়ের জন্যই কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করছেন জানিয়ে দেলোয়ার হোসেন ফরহাদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এখানকার ইতিহাস সবাই জানে। চকবাজার থেকে বলতে গেলে বৃহত্তর চট্টগ্রামের যাবতীয় সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতো জামায়াত-শিবির। সেই জায়গায় দলের আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে আমরা চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছি। আমার আব্বার চেম্বার অন্তত ৮-১০ বার আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। আজ জামায়াত-শিবির রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হলেও এই ওয়ার্ডে এখনও আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়নি।’

চকবাজারে আওয়ামী লীগের ‘চূড়ান্ত বিজয়’ না হওয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে ফরহাদ বলেন, ‘যে সংগ্রামে এত লোক রক্ত ও শ্রম দিল সেখানে জীবনেও আওয়ামী লীগ না করা একজনকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। মনোনয়ন পেতে তিনি মিথ্যা পরিচয় ব্যবহার করেছেন। এখানে যেসব নেতাকর্মী জীবন দিয়েছেন তাদের ত্যাগের সাথে এটা বড় ধরনের প্রতারণা। এজন্যই আমি নির্বাচন করছি।’

১৯৮৯ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ফরহাদের পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিতে ছুটে গিয়েছিলেন চকবাজারের বাসায়।
১৯৮৯ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ফরহাদের পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিতে ছুটে গিয়েছিলেন চকবাজারের বাসায়।

এছাড়াও নগরের অন্যান্য ওয়ার্ডের চেয়ে চকবাজারে তুলনামূলক কম উন্নয়ন হয়েছে মন্তব্য করে ফরহাদ বলেন, ‘মিন্টু ভাই মানুষ খারাপ না। কিন্তু তিনি পাঁচ বার চসিকের কাউন্সিলর থেকেও এখানে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করতে পারেননি। আপনি যখন পাশের পাঁচলাইশ থেকে কিংবা জামালখান থেকে চকবাজারে ঢুকবেন তখন মনে হবে যেন একটা ময়লার ডিপোতে ঢুকছেন। এই ওয়ার্ডটি নগরের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রতিনিধিত্ব করে অথচ এখনকার রাস্তাগুলো খুব সরু। এখানে বলতে গেলে সেই অর্থে কোনো উন্নয়নই হয়নি। কাজেই মানুষ একটা পরিবর্তন চায়।’

এক্ষেত্রে এবারে সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টু তার ‘ভাল মানুষ’ তকমাটাও ধরে রাখতে পারছেন না মন্তব্য করে ফরহাদ বলেন, ‘যেহেতু মানুষ পরিবর্তন চায় এবং তিনি সেটা বুঝতে পেরেছেন তাই এবারে তিনি ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছেন— যেসব আগে ছিল না। কদিন ধরে দেখছি শীর্ষ সন্ত্রাসী টিনু গ্রুপের ইভানসহ তার লোকজনের সঙ্গে উনার আনাগোনা।’

তবে এগুলোকে ‘নির্বাচনী অপপ্রচার’ দাবি করে সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টু বলেন, ‘দেখুন আমি টানা ৫ বার সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর হয়েছি। এর আগেও যখন পৌরসভা ছিল তখনও আমি নির্বাচিত হয়েছি। এখানে একটাও রাস্তা বাকি নাই যেখানে পিচ ঢালাই হয় নাই কিংবা কাজ হয়নি। এখন কেউ যদি বলে উন্নয়ন হয়নি তাহলে কী বলার থাকে! তবে কিছু সমস্যা তো হয়। রাস্তায় কাজ করার দুদিন পর ওয়াসা এসে কেটে দিয়ে যায়। এসব কারণে মাঝে মাঝে সমস্যা হয়। তবে উন্নয়ন হয়নি এটা সত্য নয়।’

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের কাছে টানার অভিযোগ প্রসঙ্গে মিন্টু বলেন, ‘এখন আমি যদি বলি কে কোথায় যাচ্ছে কী করছে কোন্ কোন্ অপরাধীর সাথে নিয়ে চলছে সেসব কিছুও আমি জানি তাহলে…? কিন্তু আমি বলবো না। আমি মানুষ কিছুটা সহজ সরল। কিন্তু নির্বাচন কিভাবে করতে হয় সেটা আমি জানি। নির্বাচনকে নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলবে, আমি সেসব নিয়ে কথা বলতে চাই না। মানুষ আমাকে জানে। তারা এর জবাব দেবে।’

মিথ্যা রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে মনোনয়ন নেওয়া প্রসঙ্গে মিন্টু বলেন, ‘এটা তো থানা আওয়ামী লীগ বলবে। আমি মতি টাওয়ারের সামনে চকবাজারে, দারুল ফজল মার্কেটে দলের অনেক প্রোগ্রামে বক্তব্য দিয়েছি সেসব জায়গায় আমাকে থানা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা হিসেবেই সম্বোধন করা হয়েছে। আপনি থানা আওয়ামী লীগের কাছে জিজ্ঞেস করুন।’

এই বিষয়ে জানতে চাইলে চকবাজার থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনসারুল হক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের থানা আওয়ামী লীগের কোন উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়নি। তিনি (সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টু) ১৯৯৪ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সমর্থনে কাউন্সিলর হয়ে আসছেন। তবে তিনি দলের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। এখন কেন্দ্র যেহেতু মনোনয়ন দিয়েছে কিছু তো করার নাই।’

তবে কিছু করার না থাকলেও চকবাজারের মত জায়গায় নিজেদের কাউকে প্রার্থী হিসেবে না পাওয়ায় ক্ষুদ্ধ এখানকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

সেই ক্ষোভ থেকেই গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে মিন্টুর মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে চকবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতৃবৃন্দ।

সেই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন চকবাজার থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাফর আহমদ চৌধুরী। মিন্টুকে কৌশলী নেতা দাবি করে তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হবার পর কাউন্সিলর হিসেবে ১৯৭৭ সালে আত্মপ্রকাশ ঘটে এ প্রার্থীর। তিনি এতটা কৌশলী— কখনও রাজনীতিতে নিজেকে সম্পৃক্ত করেননি। যখন যার ক্ষমতা ছিল, সেই দলের সাথে সখ্য রেখে চলেছেন। যেন ক্ষমতার পালাবদলে নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারেন। আজ তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা বলে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে দলীয় সমর্থন আদায় করেছেন, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার বিষয়।’

এমন একজন ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়ায় স্থানীয় নেতা-কর্মীদের বিরূপ মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি কখনও জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেনি, তাকে প্রার্থী হিসেবে দলীয় সমর্থন দেওয়া দুর্দিনের ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতা-কর্মীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করেছে। লক্ষ্য করবেন, ১৯৮১ সালের পর দীর্ঘ ৩০ বছরের অধিক সময় ধরে চকবাজার এলাকাটি জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রিত ছিল। এখান থেকেই সারাদেশে শিবিরের কার্যক্রম পরিচালিত হতো। এ এলাকায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি করাটা ছিল খুবই কঠিন। জামায়াত-শিবির অধিপত্য বিস্তার করা এলাকায় দীর্ঘ ৩০ বছরের মধ্যে সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টু কাউন্সিলর হিসেবে কিভাবে বহাল তবিয়তে ছিলেন? কখনও তিনি নির্যাতন, হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন এমন একটি নজির নেই।’

মিন্টুকে জিয়ার আস্থাভাজন হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রতিবাদ তো দূরের কথা, উল্টো মেজর জিয়াউর রহমানের আশীর্বাদপুষ্ট হন তিনি। যা সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে নিজ মুখেই বলেছেন। সেই ভিডিও ফুটেজ ইতিমধ্যে ব্যাপক প্রচারিত হয়েছে।’

কাউন্সিলর মনোনয়ন নিয়ে এখানে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে মন্তব্য করে এর জবাব দিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মুখিয়ে আছে দাবি করে ফরহাদ বলেন, ‘আমি শুধু সেসব নেতাকর্মীর আত্মত্যাগের চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করতে চাই, যারা এখানে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করতে জীবন দিয়েছিল। আজ জামায়াতের অস্তিত্ব নাই। এর পরেও এখানে কাউন্সিলর হওয়ার মত আওয়ামী লীগের নিজস্ব একটা লোক নাই বিষয়টা তো এমন না। আমি চাই ভোট সুষ্ঠু হোক। তাহলেই বোঝা যাবে কার অবস্থান কী?’

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!