জামায়াতত্যাগী ‘জনআকাঙ্খা’ অন্তরালে তৎপর চট্টগ্রামে

নতুন ‘রাজনৈতিক মতের’ পক্ষে রাজধানীতে ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জুর সংবাদ সম্মেলনের পর চট্টগ্রামেও চলছে নানান গুঞ্জন। কে যাচ্ছেন মঞ্জুর সঙ্গে? এমন জিজ্ঞাসার উত্তরে শোনা যাচ্ছে অনেকের নাম। কেউ কেউ বলছেন খোদ জামায়াতের বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুল ইসলামও দলত্যাগ করতে পারেন।

২৭ এপ্রিল রাজধানীতে সংবাদ সম্মেলন করে ‘জনআকাঙ্খা’র ব্যানারে সামনে আসা মজিবুর রহমান মঞ্জুর রাজনৈতিকভাবে বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং সর্বশেষ শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন মঞ্জু। জামায়াত থেকে বহিস্কারের আগে তিনি জামায়াতের মজলিশে শুরার সদস্য ছিলেন। চট্টগ্রাম থেকেই মঞ্জুর উত্থান। সে হিসেবে স্বাভাবিক একটা গুঞ্জন চলছে চট্টগ্রাম জামায়াত-শিবিরের কে কে থাকছেন মঞ্জুর সঙ্গে। নগর ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি গোলাম ফারুক এবং সীতাকুণ্ড উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এডভোকেট মোস্তফা নুরও মঞ্জুর সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

নতুন উদ্যোগের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকা নগর শিবিরের সাবেক সভাপতি গোলাম ফারুক বলেন, ‘আমরা যখন সবার নাম ঘোষণা করবো তখন জানতে পারবেন। তবে কারো নাম বলে কাউকে বিব্রত না করাটাই শ্রেয়। কারণ ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা, সমালোচনা হচ্ছে।’

কে কে যাচ্ছেন নতুন দলে—জানতে চাইলে এডভোকেট মোস্তাফা নুর বলেন, ‘তথাকথিত চমক হয়তো আমাদের উদ্যোগে দেখা যাবে না। আমরা আমাদের কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হবো। যে বা যারা যেখান থেকে আসবেন দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য দরজা খোলা থাকবে।’

তবে নগরে বেশ জোরালো গুঞ্জন রয়েছে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের সাবেক সাংসদ শাহজাহান চৌধুরী ও আ জ ম ওবায়েদুল্লাহর নাম। দুজনই চট্টগ্রাম নগর জামায়াতের নায়েবে আমীর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সব ক্যাম্পাস থেকে উঠে আসা শিবিরের অধিকাংশ নেতাই মঞ্জুর সঙ্গে রয়েছেন বলে জোর দাবি করছেন মঞ্জুর সাথে সম্পৃক্ত লোকজন।

শাহজাহান চৌধুরী প্রতিদ্বন্দ্বী শামসুল ইসলামের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে এক দশকের বেশি সময় জামায়াতে কোণঠাসা ছিলেন। তিনি দল ছাড়তে পারেন—এমন আশঙ্কা থেকে জামায়াত সম্প্রতি শাহজাহানকে নগর জামায়াতের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমীর পদে বসিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, শাহজাহান যদি জামায়াতের মায়া ছাড়তে নাও পারেন সেক্ষেত্রে তার অনুসারীদের ছেড়ে দেবেন নতুন উদ্যোগে যুক্ত হতে।

বিষয়টিকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়ে সাবেক সাংসদ শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ‘গুঞ্জনটি থাকতে পারে। তবে সঠিক নয়, অনুমাননির্ভর। যে কেউ যে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করতেই পারেন। এটি তার সাংবিধানিক অধিকার। আমার জীবন-যৌবনের ৪৯টি বছর ছাত্রশিবির ও জামায়াতে ইসলামীর সাথে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জামায়াত ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না।’

‘মজিবুর রহমান মঞ্জুর সাথে আপনার ঘনিষ্ঠতা তো আছে’—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মঞ্জু ছাত্রশিবিরের চট্টগ্রাম কলেজ সভাপতি ছিলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েরও সভাপতি ছিলেন। সেই হিসেবে চট্টগ্রামে নানা আন্দোলন সংগ্রামে আমার সহযোদ্ধা মঞ্জু। এ ছাড়াও তিনি ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। তারপর দীর্ঘদিন আমরা দুজনই কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। তার সঙ্গে তো ঘনিষ্ঠতা থাকবেই।’

গত ৩০ এপ্রিল শাহজাহান চৌধুরীকে আটক করার পর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেয় নগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। অনেকে ধারণা করছেন, নতুন সংগঠনের গতিপ্রকৃতি জানার জন্যই তাকে আটক করা হয়।

আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ চট্টগ্রাম আসার আগে ঢাকা মহানগরীতে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দলের ভেতরে বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হন। চট্টগ্রাম এসেও তেমন সুবিধা করতে পারেননি। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর তিনি নগর জামায়াতের বড় পদ পেয়েছেন। তাও তার হাতেগড়া কর্মী মোহাম্মদ শাহজাহানকে কক্সবাজার থেকে এনে তার ওপরের পদে বসিয়েছে জামায়াত। সর্বশেষ জামায়াতের পক্ষ থেকে ওবায়েদুল্লাহকে দেওয়া হয়েছে জনআকাঙ্খার বিষয়ে পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব। দলত্যাগের বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছেন নগর ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি সোহেল মাহমুদ। তিনি ওবায়েদুল্লাহর জামাতাও।

বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওবায়েদুল্লাহর বাড়ি ভোলা জেলায়। তার সাথে মাওলানা শামসুল ইসলামের মতের অমিল ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের দূরত্ব ঘুচলেও ওবায়েদুল্লাহকে সহ-সভাপতি পদেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। নগর কমিটির তিন সহ-সভাপতির আরেকজন হলেন দৈনিক কর্ণফুলীর সম্পাদক আফসার উদ্দিন চৌধুরী। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থাকায় দীর্ঘদিন মাঠে দেখা যাচ্ছে না।

এছাড়াও নাম শোনা যাচ্ছে, নগর ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মোরশেদুল ইসলাম চৌধুরী, আহমদ জাহেদুল আনোয়ারের নামও। মোরশেদ চৌধুরীর বাড়ি হাটহাজারী এবং জাহেদুল আনোয়ারের ফটিকছড়ি। জাহেদুল আনোয়ার মালয়েশিয়ায় অবস্থান করলেও নগরের তার অনুসারী রয়েছে প্রচুর। মোরশেদুল ইসলাম চৌধুরী জামায়াতের চকবাজার থানা সভাপতি এবং নগর কমিটির সদস্য। মোরশেদ এবং জাহেদ দুজনই নগর সভাপতির আগে চট্টগ্রাম কলেজ সভাপতি ছিলেন। সাবেক সভাপতি গোলাম ফারুক নগরের ফরিদার পাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটের কাছে জামায়াত চট্টগ্রাম-৮ আসনে তাদের প্রার্থী হিসেবে গোলাম ফারুকের নাম প্রস্তাব করেছিল।

এ ব্যাপারে জামায়াতঘনিষ্ঠ প্রফেসর শামিম উদ্দিন খান বলেন, ‘জামায়াত থেকে কে কোথায় গেলো তাতে জামায়াতের কোন সমস্যা হবে না। জামায়াত জামায়াতের নির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাবে।’

তবে দক্ষিণ জেলা জামায়াতের সহসভাপতি মোহাম্মদ ইসহাক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মজিবুর রহমান মঞ্জু দল থেকে বহিস্কৃত। একজন বহিস্কৃত লোক কী করলেন বা কী করবেন তা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মো. মোজ্জামেল হক বলেন, ‘যারা মজিবুর রহমান মঞ্জুকে নিয়ে কথা বলছেন তাদের যে কারো চেয়ে দলের জন্য মঞ্জুর অবদান বেশি। মঞ্জুর এই উদ্যোগ মূলত দেশের রাজনীতিতে গুণগত শূণ্যতা পূরণ করবে।’

মজিবুর রহমান মঞ্জু চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত মূলনীতি: সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফ এই তিনটি বিষয়কে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি হিসেবে ধরে আমরা অগ্রসর হচ্ছি। যে কেউ আমাদের সাথে যোগ দিতে পারবেন। তবে কে কে আসছেন তা সময়মতো সবাই জানবেন, অগ্রিম কিছু বলা যাচ্ছে না।’

এফএম/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!