জশনে জুলুসে আগুনে পোড়া দুই কিশোরের পাশে নেই কেউ

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের ৬ নম্বর ও ১৫ নম্বর বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে অগ্নিদগ্ধ রিফাত ও রফিকুল। লালখান বাজার এলাকায় ঈদে মিলাদুন্নবীর জুলুসে পিকআপ ভ্যানের জেনারেটর বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে চমেক হাসপাতালে ভর্তি হয় রোববার (১০ নভেম্বর)। কিন্তু জুলুসে নিয়ে যাওয়া এলাকার বড় ভাইয়েরা ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়ে দায়িত্ব শেষ করলেও বর্তমানে কয়েকজন আপনজন ছাড়া কেউ নেই তাদের পাশে।

রোববার দুপুরে বাকলিয়া তুলাতলী থেকে ১৫ থেকে ১৬ জনের একটি পিকআপ ভ্যান জুলুসে অংশ নেয়। নগরীর লালখান বাজার এলাকায় পৌঁছালে পিকআপ ভ্যানের সাউন্ড সিস্টেমে জেনারেটর বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয় ছয়জন। এরা হলো নূর নবী (৬), মো. কাউছার (২০), রফিকুল ইসলাম (১২), রিফাত (১০), ইয়ামিন (৯) ও হৃদয় (১৬)। অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় তাদের চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

সোমবার (১১ নভেম্বর) কাউছার, নূর নবী ও ইয়ামিনকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়। রিফাতের অবস্থার অবনতি হলে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে হৃদয় ও রফিকুল চমেক হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে কাতরাচ্ছে।

যাদের কথায় জুলুসে অংশগ্রহণ করেছিল এই ছোট ভাইগুলো, দুর্ঘটনার পর তাদের কারোর দেখা মেলেনি— এমন অভিযোগ আহতদের পরিবারের।

মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর ) চমেক হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ৬ নম্বর বেডে শুয়ে থাকা হৃদয়ের শরীরের ১১ ভাগ পুড়ে গেছে। সঙ্গে ডান পায়ের হাড়ও ভেঙে গেছে।

হৃদয় দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলে, ‘কেন যে সেদিন গেলাম! না গেলে হয়তো আজ আমার এখানে পড়ে থাকতে হতো না। আমার এলাকার বড় ভাইয়েরা আমায় যেতে বলেছিল। কিন্তু এখন তাদের কাউকে পাশে পাচ্ছি না। আমি এ যন্ত্রণা আর সহ্য করতে পারছি না। খুব কষ্ট হচ্ছে।’

হৃদয়ের দুলাভাই মহিউদ্দিন বলেন, ‘এই ছোট ছোট ছেলেগুলোকে দরকার ছিল না জুলুসে নেওয়ার। কিন্তু ঘটনা ঘটার পর এখন আর কেউ নেই। দুয়েকটা সংস্থা এসে ৭ হাজার টাকার মতো সাহায্য করেছে। আরও যে কতদিন হাসপাতালে পড়ে থাকতে হবে বুঝতে পারছি না।’

১৫ নম্বর বেডে শুয়ে আছে রফিকুল ইসলাম (১৩)। শরীরের ১৫ ভাগ পুড়ে গেছে তার। রফিকের চিৎকারে ভারি হয়ে উঠেছে হাসপাতালের পরিবেশ। ড্রেসিংরুম থেকে ব্যান্ডেজ পরিবর্তন করার সময় শোনা যাচ্ছিল তার আর্তনাদ। দরজার বাইরে অঝোরে কাঁদছিলেন মা রোকেয়া বেগম।

রোকেয়া বেগম বললেন, ‘আমার ছেলে জেএসসি পরীক্ষার্থী। বাসায় কাউকে না বলেই অন্য ছেলেদের সাথে জুলুসে চলে যায়। গাড়িতে এসব সাউন্ড সিস্টেম না রাখলে কী হয়? আজকে এটার কারণেই কতজনকে দুর্ঘটনার শিকার হতে হলো। একজনের অবস্থা বেশি খারাপ হওয়াতে ঢাকায় নিয়ে গেলো। খুব কষ্ট লাগছে এসব দেখে।’

তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেটা পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ছটফট করছে। কিন্তু এ অবস্থায় কিভাবে পরীক্ষা দেবে! উঠে বসতেও পারছে না। সব পরীক্ষা দেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র বিজ্ঞান ও অংক পরীক্ষা বাকি ছিল। ও চাইলেও পরীক্ষা দিতে যেতে পারবে না।’

চিকিৎসার জন্য কেউ সাহায্য করছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তেমন কেউ আসেনি ওদের দেখতে। তবে দুয়েকটা সংস্থা এসে আমাদের হাতে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা দিয়ে গেছে।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রফিক উদ্দিন আহমেদ দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘তিনজন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। তবে রিফাতের শরীরে ৪০ ভাগ পুড়ে গেছে। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে হৃদয় ও রফিকুল ইসলাম চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। তাদের সুস্থ হতে সময় লাগবে।’

পরিদর্শনে আসা গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশ চট্টগ্রাম মহানগরের আহ্বায়ক মীর মো. সেকান্দর দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, ‘আহতদের দেখতে এলাম। আমি আমার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে আমার মতো করে সাহায্য করার চেষ্টা করছি।’

আনজুমান কমিটির দপ্তর সম্পাদক মো. শাহ আলম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গাড়িতে সাউন্ড সিস্টেম রাখার নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও অনেকে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবস্থা করে থাকে। এ ধরনের দুর্ঘটনা আর শব্দ দূষণের কথা মাথায় রেখে সাউন্ড সিস্টেম রাখা উচিত নয়। অধিকাংশ ছেলেপুলে এসব শোনে না। যার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে।’

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সিনিয়র ডেপুটি গভর্নর আমিনুল হক বাবু জানান, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন আঞ্চলিক শাখা আহত ৩ জনের মায়ের হাতে নগদ ১৫ হাজার টাকা তুলে দিয়েছে। মানবাধিকার কমিশন আহতদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।

এসএএস/সিআর

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!