জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহ বিভিন্ন কারনে ছোট হচ্ছে প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন : সাগরের অতলে হারিয়ে যাবার আশংকা পর্যটকদের

এস এম আরোজ ফারুক, সেন্ট মার্টিন থেকে ফিরে ॥

বিপুল প্রাকৃতিক বৈচিত্রের এই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে সমুদ্র, দেশের সেরা দ্বীপগুলোর মধ্যে সেন্টমার্টিন অন্যতম। এখানে বছরজুড়ে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে আসা বহু পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের মানুষের জীবন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই দেশের অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে আলাদা। দ্বীপটির চতুরদিকে প্রবাল পাথর আর কেয়াবনে বেষ্টিত।

????????????????????????????????????

নীল জলরাশী আর রাতে চাঁদের আলো দেখার পাশাপাশি সমুদ্রের গর্জন যেন অন্য রকম অনুভূতি জাগায়। সাগর পথে জাহাজে করে প্রবাল দ্বিপ সেন্ট মার্ন্টিন যাওয়া ও আসার সময় প্রকৃতি যেন অন্য রকম এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যরে রুপ ধারন করে। শত শত গাংচিলগুলোকে খুব আপন মনে হয় আর মনে হয় গাংচিলের সাথে মানুষরে বুঝি গভীর মিতালী তারা আমাদের পাশে থেকে পথীক হয়ে এগিয়ে দিচ্ছে অনেকটুকো পথ।

 

এতসব সৌন্দর্যের ধারক সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি নিয়ে সঙ্কিত খোদ পর্যটকরাই। অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, প্রাবল পাথর উত্তলন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাগরের পাড় ভেঙ্গে দ্বীপ ছোট হয়ে আসা ভাবিয়ে তুলেছে পর্যটক ও স্থানীয়দের।

 

জানা গেছে, বিগত ৭-১০ বছর ধরে পর্যটকদের দৃষ্টি পড়েছে এই ক্ষীণ সাগরকন্যার দিকে। পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার পর্যটক দেখতে যান এই সাগরকন্যাকে। যাওয়ার ব্যবস্থাটা আরও উন্নত হলে হয়তো এ সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়াত হাজার দশেক। এক্ষেত্রে বলতেই হয় সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাওয়ার ব্যবস্থাটা উন্নত নয়। সেন্টমার্টিন দ্বীপের গঠন প্রকৃতি, আকৃতি, আর সার্বিক পরিবেশ কোনভাবেই এত সংখ্যক মানুষের চাপ বহন করার উপযোগী নয়।

 

১৯৯৫ সালের বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী সেন্টমার্টিন দ্বীপ সরকার ঘোষিত একটি প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা। দ্বীপের প্রবেশমুখেই বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদফতর পর্যটকদের কী করা উচিত হবে না তা লিখে রেখেছে বিলবোর্ডে। যেমন প্রবাল, শৈবাল, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি সংগ্রহ করা থেকে বিরত থাকা, প্লাস্টিক-পলিথিন যত্রতত্র ফেলা থেকে বিরত থাকা, রাতে সৈকত এলাকায় আলো বা আগুন জ্বালানো থেকে বিরত থাকা, দ্বীপে মাইক বা উচ্চশব্দে গান-বাজনা না করা, স্থানীয় জনতার ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধে আঘাত দেয় এমন কাজ না করা, দ্বীপে যেহেতু মিঠা পানির উৎস সীমিত, তাই পানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়াসহ আরও অনেক কিছু। কিন্তু বাস্তবে কী তা হচ্ছে ?

 

দ্বীপটি দাঁড়িয়ে আছে প্রবাল পাথরের ভিত্তিভূমির ওপর। সাগরের নিচ থেকে উঠে উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়েছে অনেকটা ব্যাঙের ছাতার মতো। তাই দ্বীপ থেকে কোরাল বা প্রবাল পাথর সরিয়ে নেয়া দ্বীপের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। শুধু তাই নয়, দ্বীপে ইটের তৈরি কোন ভারি স্থাপনা তৈরি করাও ঝুঁকিপূর্ণ। অধিকসংখ্যক মানুষের ভার বহনেও দ্বীপটি কতটুকু সক্ষম তাও হিসাব করে বের করা প্রয়োজন। সুতরাং প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন দেশের একমাত্র প্রবাল গঠিত এ দ্বীপের জন্য আমাদের সবার কিছু করা প্রয়োজন।
উইকিপিডিয়াসহ অনেক তথ্যভান্ডারের কল্যাণে জানা গেল, প্রায় আড়াইশ’ বছর আগে সেন্টমার্টিন দ্বীপে সর্বপ্রথম বসতি স্থাপন করে আরব দেশের নাবিকরা। তখন এর নাম ছিল জিঞ্জিরা। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ শাসনামলে এর নামকরণ হয় সেন্টমার্টিন দ্বীপ। বর্তমানে সেখানে কত মানুষের বাস তা নিয়ে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না। কারও মতে, সাড়ে পাঁচ হাজার, আবার উইকিপিডিয়ার মতে সাত হাজার।

saint-martin-pic-3

তবে স্থানী কয়েকজনের মতে বর্তমানে সেখানে বাস করে প্রায় ১০ হাজার মানুষ। এ সংখ্যাটা বাড়ছে ক্রমান্বয়ে, বিশেষ করে পর্যটন মৌসুমে। সেন্টমার্টিনে বর্তমানে কোন হাইরাইজ ভবন বানানোর অনুমতি নেই। কিন্তু সেখানে রয়েছে বেশ কিছু একতলা-দোতলা দালান। এবং এখনো গড়ে উঠছে পাকা দালান তার প্রায় সবগুলোই হোটেল ও কটেজ।
ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা মাহবুব সোবহান সাকলাইন বলেন, প্রতিনিয়তই দ্বীপটিতে অপরিকল্পিত ভাবে ভবন গড়ে উঠছে এতে করে পরিবেশের ভারসম্য হারাচ্ছে। এছাড়াও বিগত কয়েক বছরের তুলনাই এবারে দ্বীপটিকে বেশ ছোট মনে হয়েছে সাগরের পাড়ে ভাঙ্গনের চিহ্নও দেখা গিয়েছে। এতেই বোঝা যায় সেন্ট মার্টিনে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এমন অবস্থায় দ্বীপটি রক্ষার্থে সরকারকে দ্রুত উদ্যোগী হওয়া উচিত।
একদিন হয়তোবা সেন্টমার্টিন দ্বীপের সব পাকা স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়ে সে স্থলে গড়ে উঠবে ইকোবান্ধব আকর্ষণীয় কটেজ। স্থানীয়রা চায় না তাদের প্রিয় দ্বীপটা মিলিয়ে যাক বঙ্গোপসাগরের অথৈ নীলে। স্থানীয়দের সাথে কথা বললে তারা বলেন, এই দ্বীপে কোন ব্যাংকেরই শাখা নেই। তারা সহজ শর্তে ঋণ চায় পরিবেশবান্ধব পর্যটন ব্যবসায়ে বিনিয়োগের জন্য। টাকার অভাবে তারা মনের মতো করে সাজাতে পারছে না দ্বীপটাকে। তারা চায় পর্যটকদের সেবা দিতে। তাদের হিসাব মতে, বর্তমানে ওই দ্বীপে ১১০টির মতো একতলা-দোতলা এবং অল্প কিছু তিনতলা হোটেল/কোটেজ আছে। কিন্তু অর্থের অভাবে তারা ভালো কিছু সৃষ্টি করতে পারছে না, ভালো মানের সেবাও দিতে পারছে না। ফলে বেশির ভাগ পর্যটকই ফিরে যান অসন্তুষ্টি নিয়ে, যা তাদের কাম্য নয়। কোন ব্যাংক কি এগিয়ে আসবে সেন্টমার্টিন দ্বীপে একটি শাখা তৈরি করে কম হারে স্থানীয় মানুষকে ঋণ দেয়ার জন্য?

 
এ দ্বীপের জমির পরিমাণ হল ভাটার সময় ৮ বর্গকিলোমিটার আর জোয়ারের সময় ৫ বর্গকিলোমিটার। কতটুকুই বা জমি? এর ওপরেও নজর পড়েছে দখলবাজদের। দ্বীপের রয়েছে তিনটি অংশ উত্তরে উত্তর পাড়া, দক্ষিণে দক্ষিণ পাড়া আর দুই অংশের মাঝখানটা গলার মতন সরু বলে গলাচিপা নামে পরিচিত। এই তিন অংশের মাঝে উত্তর অংশ মূলত জনপদ। বেশির ভাগ ট্যুরিস্ট অ্যাকমডেশন ইউনিট, বাজার, আর নৌবন্দর এই উত্তর অংশেই অবস্থিত।

 

গলাচিপায় কিছু ভালো কটেজ, নৌ-বাহিনীর স্থাপনা আর কিছুসংখ্যক স্থানীয় মানুষের বসবাস। অগুনতি নারিকেল গাছ আর আবাদি জমির বেশির ভাগই এই অংশে অবস্থিত। দক্ষিণ অংশ এখন পর্যন্ত ‘রেস্টিক্টেড অ্যাকসেস জোন’ হিসেবেই পরিচিত। সেখানে দ্বীপজুড়ে পড়ে আছে বিশাল বিশাল প্রবাল পাথর।
দ্বীপটির খোলা জায়গাগুলোর চারদিকে দেখা গেল শুধু জমি মালিকানার সীমানা আর সাইনবোর্ড। অর্থাৎ সীমিত প্রবেশাধিকার জোনের জমিগুলোও বিক্রি হয়ে গেছে। লাখো বছরের সঞ্চিত প্রবাল পাথরগুলোকে সরিয়ে মাটি বের করা হচ্ছে কটেজ বানানোর জন্য। শুধু তাই নয়, প্রবাল পাথরের টুকরোগুলোকে দিয়ে বানানো হচ্ছে প্লটের সীমানা প্রাচীর। এতে করে দিন দিন চরম ঝুঁকির সম্মুক্ষিণ হচ্ছে দ্বীপটি।
এ অবস্থায় পাথরের টুকরো সরানো কিংবা কোন স্থাপনা নির্মাণ করা ঘোরতর পাপের সমান। অথচ দ্বীপটিতে তাই হয়ে যাচ্ছে নির্বিচারে নির্বিকারে।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সরাদার শরিফুল ইসলাম বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের ‘সেন্ট মার্টিন দ্বীপের জীব বৈচিত্র্য রক্ষা প্রকল্প’ নামের একটি প্রকল্প ছিল যার মেয়াদ ৭বছর আগে শেষ হয়ে যাওয়ায় আমরা আর কিছু করতে পারিনি। তবে সম্প্রতি আমরা সেই প্রকল্পটির দ্বিতীয় পর্ব শুরু করতে যাচ্ছে। যার মধ্য দিয়ে দ্বীপটির চারপাশে থাকা কেয়াবন রক্ষা করা যাবে। আগামী ৩ মাসের মধ্যে সেন্ট মার্টিনে প্রকল্পটির কাজ শুরু করতে পারবো।
তবে সচেতন মহলের মতে, সংকটাপন্ন ছেড়া দ্বীপসহ দক্ষিণ পাড়ার পুরো অংশেই মানুষের পদার্পণ বন্ধ করার সময় এসেছে এখনই। নয়তো একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হয়তো শুনা যাবে, আমাদের অতি আদরের সাগরকন্যা সেন্টমার্টিন দ্বীপটি চিরতরে হারিয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরের অতলে।

 

এ এস / জি এম এম / রাজীব প্রিন্স

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!