জরুরি অবস্থায় ঘরে নামাজ পড়ার কথা বলেছেন রাসুলও (সা.)

মসজিদে যাওয়া মুসল্লির স্পর্শ লাগে ১৯টি স্থানে

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ায় একাধিক মুসলিম দেশে জুমার নামাজ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপ বন্ধ হলে তা আবার পুনর্বহাল হবে। বাংলাদেশেও ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে জনসমাগম এড়িয়ে মসজিদে উপস্থিতি সীমিত করার আহ্বান জানানো হয়।

পবিত্র মক্কা নগরীর মসজিদ আল হারাম এবং মদিনার মসজিদে নববীতে ২০ মার্চ থেকে জুমা নামাজ স্থগিত করেছে সৌদি সরকার। এর আগে এ দুটি মসজিদ ছাড়া সৌদি আরবের বাকি সব মসজিদে জামাতে নামাজ পড়া স্থগিত করে নির্দেশ জারি করেছিল দেশটির কর্তৃপক্ষ। শুধু সৌদি আরব নয় বাহরাইনসহ একাধিক আরব দেশ জুমার নামাজ স্থগিত করেছে।

আরব দেশগুলো নবী মোহাম্মদের (সা) সময়কার নিয়ম হিসেবে আজানের বাক্যেও এনেছে পরিবর্তন। তবে আজানের সাথে মুসলিম জাতির দীর্ঘদিনের আবেগও জড়িয়ে আছে। আলেমরা বলছেন, আমাদের আবেগ সেটা মানতে কষ্ট হলেও ইসলামের বিধান হলো জীবনের জন্য, আবেগের চাহিদা পূরণের জন্য নয়। ভিন্নমত পোষণকারী আলেমদের অভিমত হলো, আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। তবে জুমার নামাজে কড়াকড়ি আরোপ করা যাবে না। মসজিদে এসে আল্লাহর কাছে মুক্তি চাইতে হবে।

লন্ডনের আলহুদা একাডেমি এন্ড ইসলামিক সেন্টারের খতীব ও চেয়ারম্যান বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আব্দুল কাদির সালেহ। তিনি জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে বা এহেন দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় মসজিদে নামাজ পড়া বিষয়ে ইসলামের স্পষ্ট বিধান রয়েছে । এমতাবস্থায় হাদীস বলছে : ‘তুমি নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না এবং কাউকে ক্ষতিগ্রস্থ করবেও না’— এটিই এক্ষেত্রে এই মূলনীতি প্রযোজ্য হবে বলে বিশ্বের অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম মতপ্রকাশ করেছেন।

মাওলানা আব্দুল কাদির সালেহ বলেন, ‘গবেষকরা দেখিয়েছেন, প্রবেশের সময় থেকে নামাজ পড়া পর্যন্ত উনিশটা স্থানে মসজিদে আগত একজন মুসল্লির স্পর্শ লাগে। ওই সমস্ত স্থান অন্যরাও ব্যবহার করেন। মুসল্লিদের দুটি অবস্থা থাকে। হয় অন্যের সংস্পর্শ থেকে আক্রান্ত হতে পারে অথবা সে না জেনেই অন্যকেও সংক্রমিত করতে পারে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সংস্পর্শের দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি। এমন জরুরি অবস্থায় রাসুলের (সা.) জামানায় এবং সাহাবীগণের সময়ে ঘরে নামাজ আদায়ের কথা বলা হয়েছে। আজানেও ‘হাইয়া আলাসসালাহ’ এর পরিবর্তে ‘সাল্লু ফির রিহাল বা সাল্লু ফী বুয়ুতিকুম’ বলে আহবান করা হয়েছে । সুতরাং এই বিশেষ পরিস্থিতিতে মসজিদে জামাতে বা জুমআয় না এসে ঘরে নামাজ আদায় করাই উত্তম এবং শরীয়তসম্মত। এটাই উলামায়ে কেরামের অভিমত। যদিও কোন কোন আলেমের মতামত এর বিপরীতে আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘লন্ডনে আমার পরিচালিত মসজিদে ২০ মার্চ থেকে এবং সাথে সাথে অন্যান্য মসজিদেও ওয়াক্তিয়া নামাজ, জুমা এবং অন্যান্য সকল সার্ভিস সাময়িক সময়ের জন্য সাসপেন্ড রাখা হয়েছে। তবে মসজিদ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। এ জন্য প্রতি ওয়াক্তে মুয়াজ্জিন মসজিদে আজান দেবেন এবং ইমাম ও অন্য যারা মসজিদের মেনটেইনেন্সের সাথে জড়িত তারা জামাত ও অল্প উপস্থিতি হলেও জুমা পড়বেন। মোট কথা মসজিদ বন্ধ হবে না— বড় গ্যাদারিং এবং সার্ভিস বন্ধ থাকবে। অবস্থার উন্নতি হলে তা পুনর্বহাল হবে।’

এ প্রসঙ্গে মিশরের আল আজহারের আরেক আলেম চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক বিএম মফিজুর রহমান আলআযহার বলেন, ‘রাসুলের (সা.) কাছে ইসলাম গ্রহণ করার জন্য তায়েফ থেকে একটা দল এসেছিলেন। তাদের দলে ছোঁয়াচে রোগী ছিলেন। রাসুল (সা) জানার পর তিনি বায়াত গ্রহণ করতে আসা সেই তায়েফবাসীর উদ্দেশ্যে বললেন, তোমার বায়াত গ্রহণ হয়েছে। তাকে সাহাবীদের ভীড় ঠেলে হাতে হাত রেখে বায়াত গ্রহণ করতে হয়নি। সুতরাং কোন মুমিন মুসলিম যেন রোগাক্রান্ত না হয়, সেজন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আল্লাহর কাছে মুক্তি চাইতে হবে। পরিস্থিতি উন্নত না হওয়া পর্যন্ত বড় জমায়েত থেকে বিরত থাকতে হবে।’

তবে ভিন্ন মত আছে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার অধ্যক্ষ মাওলানা মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান ও জমিয়াতুল ফালাহ জামে মসজিদ চট্টগ্রামের খতিব মাওলানা সৈয়দ আবু তালেব মোহাম্মদ আলাউদ্দিনের। মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান বলেন, ‘আল্লাহর মেহেরবানী আমাদের দেশে এখনো ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নাই। সুতরাং আমরা জুমার জামায়াত পড়বো, আল্লাহর কাছে দোয়া করবো, এসতেগফার করবো, ক্ষমা প্রার্থনা করবো, দেশবাসী, বিশ্ববাসীর জন্য দোয়া করবো। এই মুহুর্তে দোয়া ছাড়া আমাদের জন্য আর বিকল্প কিছু নাই।’

প্রায় একই কথা বললেন মাওলানা সৈয়দ আবু তালেব মোহাম্মদ আলাউদ্দিন। তিনি বলেন, বাহিরে যেসব মাহফিল হয় সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে। মসজিদ বন্ধ করা যাবে না, জুমা বন্ধ করা যাবে না, নামাজ বন্ধ করা যাবে না। যেটা ফরজ সেটা বন্ধ করা যাবে না। তবে যিনি অসুস্থ তিনি মসজিদ না আসার বিধার রয়েছে। যে আসতে চায় তাকে বাধা দেওয়া যাবে না।’

এদিকে ২৫ মার্চ ইসলামী ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘মসজিদ বন্ধ হবে না। তবে করোনা সংক্রমন প্রতিরোধ করে মসজিদে যেতে হবে এবং জনসমাগম এড়িয়ে মসজিদ সীমিত উপস্থিত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি সরকারের বিশেষজ্ঞগণ যে নির্দেশনা দিয়েছে তা মেনে চলে অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত থেকে আল্লাহর দরবারে তওবা করার আহ্বান জানানো হয়।

এদিকে মহামারীর এই পরিস্থিতিতে ২৫ মার্চ রাজধানীর আগারগাঁও ইসলামিক ফাউন্ডেশনে আলেম ও ওলামারা সভা করেন। তাতে আল-হাইআতুল উলয়া লিল জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের কো-চেয়ারম্যান আল্লামা আব্দুল কুদ্দুস, মারকাযুত দাওয়ার শিক্ষাসচিব মুফতি মুহাম্মাদ আবদুল মালেক, শায়খ যাকারিয়া (র.) ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের মহাপরিচালক মুফতি মীযানুর রহমান সাঈদ, জামেয়া ইসলামিয়া দারুল উলুমের মুহতামিম মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন, ঢাকা নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ড. আল্লামা কাফীলুদ্দীন সরকার সালেহী, মদীনাতুল উলুম কামিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক আল আযহারী, জামেয়া রহমানিয়ার মুহতামিম মাওলানা মাহফুজুল হক, ইদারাতুল উলুম আফতাবনগর মাদ্রাসার মুহতামিম মুফতি মোহাম্মদ আলী, মহাখালী হোসাইনিয়া কামিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ড. নজরুল ইসলাম আল মারুফ, নারায়ণগঞ্জের ভূমিপল্লী আবাসন জামে মসজিদের খতিব শায়খ আহমাদুল্লাহ, বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম মাওলানা মিজানুর রহমান, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুফতি মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, তেজগাঁও জামেয়া ইসলামিয়ার শায়খুল হাদিস ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ, বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি মুহিব্বুল্লাহিল বাকী নদভী, পেশ ইমাম মাওলানা মহিউদ্দিন কাসেম, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুহাদ্দিস মুফতি ওয়ালিয়ুর রহমান খান ও মুফাসসির ড. মাওলানা আবু ছালেহ পাটোয়ারী অংশ নেন।

ওই সভায় ‘কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মহামারী ও দুর্যোগকালীন সময়ে ইসলামের বিধি-বিধান অনুসরণের’ ক্ষেত্রে মসজিদে নামাজের জামায়াতে উপস্থিতি সীমিত করার আহ্বান জানানো হয়। সভায় আলেম-ওলামারা দেশের মুসলমানদের উদ্দেশে চারটি আহ্বান জানিয়েছেন।

১. করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে এবং মানুষের ব্যাপক মৃত্যুঝুঁকি থেকে সুরক্ষার জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে সব ধরনের জনসমাগম বন্ধের পাশাপাশি মসজিদসমূহে জুমআ ও জামাআতে সম্মানিত মুসল্লিগণের উপস্থিতি সীমিত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

২. মসজিদ বন্ধ থাকবে না, তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ হতে সুরক্ষা নিশ্চিত না হয়ে মসজিদে গমন করবেন না।

৩. সরকার ও বিশেষজ্ঞগণ সতর্কতার জন্য যেসব নির্দেশনা প্রদান করছেন তা মেনে চলার জন্য জনগণকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

৪. সবাইকে অপরাধমূলক কাজকর্ম থেকে বিরত হয়ে ব্যক্তিগতভাবে তওবা, ইস্তিগফার ও কুরআন তিলাওয়াত অব্যাহত রাখারও আহ্বান জানানো হয়।

যাদের হাঁচি, কাশি কিংবা জ্বর রয়েছে তাদেরকে বাসায় বসে জুমার পরিবর্তে জোহরের নামাজ পড়ার আহবান করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। পাশাপাশি বয়স্ক মুসল্লিদের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে আপাতত কিছুদিন সব নামাজই বাসায় পড়তে অনুরোধ করা হয়েছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!