জটিল রোগীই শুধু দেখতে চান ডা. এমএ হাছান চৌধুরী, ৩৩ বছরের অধ্যায় শেষে নতুন যাত্রা

অধ্যাপক ডা. এমএ হাছান চৌধুরী। চট্টগ্রামের প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ তিনি। ২২ মার্চ দীর্ঘ ৩৩ বছরের চাকরি শেষে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে অবসরে গেলেন। বর্তমানে অধ্যাপনা, ব্যক্তিগত চেম্বারের পাশাপাশি করে যাচ্ছেন চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণার কাজও। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল এন্ড ইনফেকশন ডিজিস (বিআইটিআইডি) পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।

১৯৮৬ সালের মে মাসে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে তিনি বের হলেন পূর্ণ ডাক্তার হয়ে।
১৯৮৬ সালের মে মাসে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে তিনি বের হলেন পূর্ণ ডাক্তার হয়ে।

বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিপুলসংখ্যক রোগীর এই ধারণা রয়েছে যে, ডা. এমএ হাছানকে দেখাতে পারলেই তারা রোগ থেকে মুক্তি পাবেন। ফলে তাকে নিয়ে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে একধরনের উন্মাদনা আছে। তার একটা সিরিয়াল পাওয়াই যেন অর্ধেক রোগমুক্তি— এমনও মনে করেন অনেকেই।

‘একজন ডাক্তারকে সবসময় পড়াশোনার মধ্যে থাকতে হবে। ভালো চিকিৎসক হতে হলে জ্ঞানার্জন জরুরি। কারণ রোগের ধরনে নিত্যনতুন পরিবর্তন হতেই থাকে।’
‘একজন ডাক্তারকে সবসময় পড়াশোনার মধ্যে থাকতে হবে। ভালো চিকিৎসক হতে হলে জ্ঞানার্জন জরুরি। কারণ রোগের ধরনে নিত্যনতুন পরিবর্তন হতেই থাকে।’

রোগীদের এমন প্রগাঢ় আস্থার পাশাপাশি বরাবরই ডা. এমএ হাছানের বিষয়ে একটি অভিযোগ মেলে সবসময়, সেটি হচ্ছে তার সিরিয়াল পাওয়া দুরূহ। অনেকের আবার অভিযোগ আছে, তাকে পেতে হলে প্রাইভেট ক্লিনিক বা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ‘অন কলে’ তাকে ডেকে পাঠাতে হয়, তবেই তিনি রোগী দেখতে আসেন। রোগীদের অনেকেরই ক্ষোভ— তার সিরিয়াল পাওয়া ‘সোনার হরিণ’ হলেও ‘অন কলে’ কিভাবে তাকে সহজেই পাওয়া যায়?

এমন সব প্রশ্ন ও অভিযোগের পাশাপাশি ব্যক্তি মানুষ হিসেবে ডা. এমএ হাছানের জীবনটা কেমন— সেসব জানতে চট্টগ্রাম প্রতিদিন মুখোমুখি হয়েছিল চট্টগ্রামের এই কিংবদন্তী চিকিৎসকের। ডা. এমএ হাছান চৌধুরীও খোলামেলা উত্তর দিলেন সব প্রশ্নেরই, অভিযোগও খণ্ডন করেছেন অকপটে।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের বেসরকারি শেভরন ক্লিনিক্যাল ল্যাবের ব্যক্তিগত চেম্বারে বসে ডা. এমএ হাছান চৌধুরী জানালেন তার বেড়ে ওঠা, শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন এবং সেই সঙ্গে আগামী দিনের নানা পরিকল্পনার কথাও।

যেভাবে বেড়ে ওঠা

এমএ হাছান চৌধুরীর জন্ম ১৯৬৩ সালে, চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বরুমচড়ায়। বাবা মরহুম মোসলেম উদ্দিন ও মা জাহানারা বেগম। বরুমচড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পড়ে ভর্তি হন একই স্কুলের মাধ্যমিক সেকশনে। এরপর সেখান থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হওয়ার পর সুযোগ পান চট্টগ্রাম মেডিকেলে কলেজে।

নিজের তীব্র ইচ্ছাশক্তির পাশাপাশি বাবার প্রেরণা তাকে চিকিৎসাবিদ্যায় পড়তে সাহস যুগিয়েছে। থাকতেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের হোস্টেলেই।

১৯৮৬ সালের মে মাসে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে তিনি বের হলেন পূর্ণ ডাক্তার হয়ে। এরপর কিছুদিন ক্লিনিকে চাকরি করেন। তবে সরকারি চাকরিতে ঢোকার ইচ্ছে ছিল তার। জানতেন, সেজন্য টিকে আসতে হবে বিসিএসে। তাই হালিশহর এলাকায় ছোট্ট একটা ঘর নিয়ে বিসিএসের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। এর পাশাপাশি একই এলাকায় ভাড়া করা রুমে চেম্বার করে রোগী দেখা শুরু করেন। সেখানে দুই রুমের ভাড়া ছিল ১৫০০ টাকা। তখন রোগী দেখার ভিজিটও ছিল ৩০-৪০ টাকা। সবমিলিয়ে আর্থিক দিক থেকে তেমন সমৃদ্ধি না পেলেও তরুণ ডাক্তার এমএ হাছানের সুনাম ছড়িয়ে পড়ল আশেপাশে। মানুষের সঙ্গেও বাড়তে থাকলো মেলামেশা।

এর মধ্যেই বিসিএসে উত্তীর্ণ হলেন এমএ হাছান চৌধুরী। পোস্টিং হল বান্দরবান আলীকদমে। সেখানে কর্মরত থাকাকালেই ১৯৯৩ সালে এফসিপিএসে ভর্তি হন দেশের প্রথম চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়— পিজিতে।

পিজি থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে

এফসিপিএস প্রথম পর্ব পাস করার পর পোস্টিং নিয়ে চলে যান পিজিতে। এর মধ্যেই অবশ্য চট্টগ্রামের চন্দনাইশসহ আরও কয়েকটি উপজেলাতে তার পোস্টিং হয়।

এসসিপিএস প্রথম পর্ব শেষ করে সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে পিজি হাসপাতালেরই মেডিসিন বিভাগে যোগ দেন তিনি। ১৯৯৭ সালের জানুয়ারিতে এফসিপিএস শেষ পর্ব পাস করে রেজিস্ট্রার হিসেবে চলে আসেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে। যোগ দেওয়ার পর রেজিস্ট্রার থেকে কনসালট্যান্ট, সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হন তিনি। সর্বশেষ মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন শেষে গত ২২ মার্চ অবসরে যান তিনি।

রোগ নির্ণয়ের ৮০ ভাগই ইতিহাস

৩৩ জীবনের কর্মজীবনে আকাশছোঁয়া সাফল্যের পেছনে মূল কারণ কী— এমন প্রশ্নে ডা. এমএ হাছান চৌধুরী জানান, প্রথমে তিনি রোগীর মুখে রোগের ইতিহাস জানার চেষ্টা করেন। এরপর ডায়াগোনোসিস হয়ে নিশ্চিত হন রোগটা কী? তারপর শুরু করেন চিকিৎসা।

ডা. এম এ হাছান বলেন, ‘রোগীর সঙ্গে রোগ নিয়ে ডিটেইল জানতে গেলেই রোগীই অনেকটা জানিয়ে দেন রোগটা আসলে কী? কারণ যার সমস্যা তিনিই ভালো অনুবাধন করতে পারেন। তাই ডায়াগোনোসিসের আগে রোগীর মুখে রোগের ইতিহাস শোনাই সবচেয়ে জরুরি। যে কোনো রোগ নির্ণয়ের জন্য শতকরা ৮০ ভাগ হল ইতিহাস। ইতিহাস নিলে রোগীই বলে দেন রোগটা আসলে কী?’

প্রতিদিন শুধু ৩০ রোগী

ডা. এমএ হাছান চৌধুরী প্রতিদিন তিনি তার চেম্বারে ৩০ জন রোগী দেখেন নতুন ও পুরাতন মিলে। কিন্তু এর বাইরে আরও প্রচুর রোগী সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষায় থাকেন প্রতিদিনই। অপেক্ষায় থাকলেও অনেকেরই শেষপর্যন্ত তাকে দেখানোর সুযোগ হয় না।

কেন প্রতিদিন শুধু ৩০ জন রোগী দেখেন— এমন প্রশ্নে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ‘৩০ জনের বেশি রোগী দেখলে আমি রোগীর প্রতি যথাযথ অ্যাটেনশন দিতে পারব না। রোগীকে ভালোভাবে দেখতে পারব না। কোয়ালিটি এনসিওর হবে না।’

এরপর এই প্রশ্নও তিনি রাখেন— ‘তবে আমার কাছে সব রোগীর ভিড় কেন হবে? আমার কাছে আসবে শুধু রেফার্ড কেসের রোগীগুলো। সাধারণ জ্বর, সর্দি-কাশির রোগীর তো আমার কাছে আসার দরকার নেই।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে সঠিক নীতিমালা নেই। নীতিমালা থাকা দরকার। একজন রোগী প্রথমে যে এলাকায় থাকেন, সেই এলাকার প্র্যাকটিশনারকে দেখাবে। তারপর ওই প্র্যাকটিশনার দেখে রোগ জটিল মনে করলে স্পেশালিস্টের কাছে রেফার্ড করবেন। কিন্তু দেখা যায়, আমাদের দেশে হচ্ছে উল্টোটা। যার টাকা আছে সেই ভাবে, একটু হাঁচি দিলেই স্পেশালিষ্টের কাছে যাওয়া উচিত।’

‘আমার কাছে জটিল কেসগুলোই আসুক’

অনেকের আবার অভিযোগ আছে, তাকে পেতে হলে প্রাইভেট ক্লিনিক বা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ‘অন কলে’ তাকে ডেকে পাঠাতে হয়, তবেই তিনি রোগী দেখতে আসেন। রোগীদের অনেকেরই ক্ষোভ— তার সিরিয়াল পাওয়া ‘সোনার হরিণ’ হলেও ‘অন কলে’ কিভাবে তাকে সহজেই পাওয়া যায়?

এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে ডা. এমএ হাছান চৌধুরী বলেন, ‘আমি সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চেম্বারে রোগী দেখি। এর আগের সময়গুলোতে আমার বিভিন্ন জায়গায় ক্লাশ নিতে হয়। এর ফাঁকে আমি অন কলে রোগী দেখতে যাই। কিন্তু রোগীরা আমার সিরিয়াল না পেয়ে প্রাইভেট ক্লিনিক কিংবা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আমাকে দেখাবে— এটা রোগীদের বিষয়। সেখানে আমি কী বলতে পারি?’

তিনি বলেন, ‘তবে আমি এ বিষয়টি ডিজকারেজ করে থাকি। আমি চাই আমার কাছে জটিল কেসগুলোই আসুক।’

একসঙ্গে আক্রান্ত করছে অনেক রোগ

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এমএ হাছান বলেন, ‘এখন রোগ নির্ণয়ের সুযোগ বেড়ে গেছে। একসঙ্গে অনেক রোগ একজন মানুষকে একসঙ্গে আক্রান্ত করছে। কিন্তু রোগ গুরুতর না হয়ে ওঠা পর্যন্ত বেশিরভাগ রোগী চিকিৎসকের কাছে যান না। কিন্তু একজন মানুষের নিয়মিত চেকআপে থাকা উচিত। প্রাইমারি হেলথ কেয়ার কিংবা ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানকে মাসে না হলে তিন মাস কিংবা ছয় মাসে একবার দেখানো উচিত। হাতের কাছেই সরকারি হাসপাতাল। সেখানেও দেখানো যেতে পারে।’

বিষয়টি আরও ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষ নিজেদের নিয়ে সচেতন না হওয়ার কারণে খুব সহজেই এক রোগের পাশাপাশি অন্য রোগও বাঁধিয়ে ফেলছে। একজন রোগী যখন প্রেসারের সমস্যা নিয়ে একজন চিকিৎসকের কাছে যান তখন দেখা যায়, তিনি কিডনি, ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তাই আমাদের সচেতন হতেই হবে।’

ডাক্তারির চেয়ে বেশি পছন্দ শিক্ষকতা

নিজের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ টেনে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ‘ডাক্তারির চেয়ে শিক্ষকতা আমাকে বেশি টানে। আমি যদি একজন ভালো ডাক্তার তৈরি করে যেতে পারি— এটাই আমার সার্থকতা। এটাই সফলতা।’

তবে তিনি নবীন ডাক্তারদের উদ্দেশ্যে এটাই বললেন, ‘সঠিক জ্ঞানার্জনের জন্য রোগীরা শিক্ষক। জুনিয়র ডাক্তারদের ট্রেনিং প্রশিক্ষণের জন্য রোগীবান্ধব হওয়া উচিত।’

থাকতে হবে পড়াশোনার মধ্যে

ব্যক্তিগত জীবনে ডা. এমএ হাছান চৌধুরী দুই সন্তানের জনক। দুই ছেলেই দেশের বাইরে থাকেন। স্ত্রী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কামরুন্নাহার রুমা।

ব্যস্ত চিকিৎসাপেশার বাইরে ব্যক্তিজীবনটা কেমন— এমন জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ ঘন্টা পড়াশোনা করি। নতুন নতুন যে রোগগুলো আসছে, সেগুলো সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি ইন্টারনেটের দুনিয়া থেকে।

তিনি বলেন, ‘একজন ডাক্তারকে সবসময় পড়াশোনার মধ্যে থাকতে হবে। ভালো চিকিৎসক হতে হলে জ্ঞানার্জন জরুরি। কারণ রোগের ধরনে নিত্যনতুন পরিবর্তন হতেই থাকে।’

ভালোবাসেন গান শুনতে

সদ্য অবসরে যাওয়ার পর বেসরকারি বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ থেকে শিক্ষকতার প্রস্তাব পেয়েছেন ডা. এমএ হাছান চৌধুরী। তবে এখনও সিদ্ধান্ত নেননি বলে জানান তিনি।

এর বাইরে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় গ্রামের বাড়িতে নিয়মিত মেডিকেল ক্যাম্প করেন তারই উদ্যোগে। এলাকার মানুষের বিভিন্ন সামাজিকতায়ও নিজেকে জড়িয়ে রাখার চেষ্টা করেন তিনি।

অবসরে কী করেন— এ প্রশ্নে ঠোঁটের কোনায় তার মৃদু হাসি ফুটলো। বললেন— ‘গান শুনতে ভালোবাসি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!