জঙ্গি ‘গুরু’ লুকিয়ে ছিলেন খাগড়াছড়ি বান্দরবানের দুর্গম এলাকায়

জঙ্গি জোগাড় হতো ওয়াজ মাহফিলের আড়ালে

পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের জেলার দুর্গম এলাকায় আত্মগোপন করে ছিলেন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার আল ইসলাম’ এর আধ্যাত্মিক নেতা মাহমুদ হাসান ওরফে গুনবী। চলতি বছরের মে মাসের শুরুতে গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি কুমিল্লা থেকে খাগড়াছড়ি চলে যান। এরপর জুনের শেষদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে তিনি আবার স্থান বদলে বান্দরবানে চলে যান। সেখানে ২-৩ দিন অবস্থান করেন। এরপর কয়েকবার তিনি অবস্থান পরিবর্তন করে একপর্যায়ে দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন।

বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) রাতে র‌্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা এবং র‌্যাব-৪ এর অভিযানে রাজধানীর শাহ আলী থানার বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকা থেকে গুনবীকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযানে উদ্ধার করা হয় উগ্রবাদী বই ও লিফলেট।

র‍্যাব কর্মকর্তারা জানান, গ্রেপ্তার এড়াতে মাহমুদ হাসান ওরফে গুনবী আত্মগোপনে চলে যান। তিনি কুমিল্লা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়িতে চলে যান এবং দুর্গম এলাকায় আত্মগোপন করেন। জুনের শেষের দিকে পুনরায় স্থান পরিবর্তন করে বান্দরবানে অবস্থান নেন। পরবর্তীতে লক্ষ্মীপুরের চর গজারিয়া ও চর রমিজে কয়েক দফা স্থান বদলান। এরপর উত্তরবঙ্গে আত্মগোপন করেন এবং প্রয়োজনে দেশত্যাগের পরিকল্পনা করেন।

শুক্রবার (১৬ জুলাই) র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সাংবাদিকদের বলেন, ‘গ্রেপ্তার মাহমুদ হাসান ওরফে গুনবী পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। ২০০৮ সালে সে মোহাম্মদপুরের জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া থেকে তাইসির দাওরায়ে হাদিস শেষ করে। এরপর সে ঢাকাসহ কুমিল্লা, নোয়াখালী, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সবাজারের বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ছিল। পাশাপাশি ধর্মীয় মতাদর্শের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়। সে ২০১০ সাল থেকে ওয়াজ শুরু করে। ২০১৪ সাল থেকে ধর্মীয় বক্তব্যে উগ্রবাদীত্ব প্রচারে নিজেকে সম্পৃক্ত করে। এছাড়া সে ধর্মীয় পুস্তকের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়।’

কমান্ডার মঈন বলেন, ‘গুনবী প্রথমে হুজির সঙ্গে যুক্ত ছিল। পরবর্তীতে জসিম উদ্দিন রহমানির সঙ্গে তার পরিচয় সূত্রে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। ওই ঘনিষ্ঠতার সূত্রে সে আনসার আল বাংলা টিমের (আনসার আল ইসলাম) সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। জসিম উদ্দিন রাহমানি গ্রেপ্তারের পর গুনবি উগ্রবাদীত্ব প্রচারক হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করে।’

তিনি বলেন, ‘গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গি মাহমুদ হাসান গুনবী আনসার আল ইসলামের দাওয়াত ও প্রশিক্ষণে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কয়েকটি মাদ্রাসায় খণ্ডকালীন, অতিথি বক্তা বা দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষকতা বা পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। ওই মাদ্রাসায় সম্পৃক্ত হয়ে জঙ্গিবাদের বিস্তৃতি ঘটিয়ে থাকে বলে জানা যায়। সে মাদ্রাসাগুলোতে উগ্রবাদী বক্তব্য প্রদান ও একইসঙ্গে উগ্রবাদী বইয়ের বিস্তারের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের আগ্রহী করে তোলে। পরবর্তীতে সেই উগ্রবাদী বই সরবরাহ করে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষকদের উগ্রবাদী লেকচার প্রদানে উদ্বুদ্ধ ও উগ্রবাদী বই তৈরি, প্রকাশ, প্রণয়নে সহায়তা করে থাকে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মাহমুদ হাসান গুনবী ওরফে হাসান একজন দর্শন পরিবর্তনকারীর ভূমিকা পালন করে থাকে। সে আনসার আল ইসলামের (এবিটি) পক্ষে অন্যতম একজন দর্শন পরিবর্তনকারী। দর্শন পরিবর্তনের কৌশল সম্পর্কে গ্রেপ্তার গুনবি জানায়, বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে গোপন আস্তানায় বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যেখানে প্রশিক্ষণার্থীরা আত্মীয়-স্বজন, পরিবার বন্ধু বান্ধব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। প্রশিক্ষণার্থীদের বাইরের জীবন, সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান ইত্যাদি থেকে দূরে রাখা হয়। এরপর তাদের মস্তিষ্কে ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে ভয়ভীতি তৈরি ও স্বাভাবিক জীবন সম্পর্কে বিতৃষ্ণা জাগ্রত করা হয়ে থাকে। ফলে প্রশিক্ষণার্থীদের ভেতর আবেগ, অনুভূতি, বুদ্ধিমত্তা, পারিবারিক বন্ধন, বিচারিক জ্ঞান ইত্যাদি লোপ পায়। এভাবে কোমলমতিদের নৃশংস জঙ্গি হিসেবে গড়ে তোলা হয়।’

উল্লেখ্য, গত ৫ মে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গি আল সাকিবের (২০) মতাদর্শ পরিবর্তন ও পরবর্তীতে তাকে আত্মঘাতী পন্থায় উদ্বুদ্ধকরণে গুনবির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক বলেন, ‘গুনবী হাসান একজন আনসার আল ইসলামের আধ্যাত্মিক নেতা। সে নিজ পেশার আড়ালে জঙ্গিবাদ প্রচার করে থাকে। সে একাধিক ধর্মীয় সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতর তার ঘনিষ্ঠদের মধ্যে বেশ কয়েকজন জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্টতায় ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে। তার মধ্যে সাইফুল ইসলাম, আব্দুল হামিদ, আনিছুর রহমান ও হাসান উল্লেখযোগ্য।’

তিনি বলেন, ‘সংগঠনের অভ্যন্তরে উগ্রবাদী মতাদর্শের প্রচারে সে “ছায়া সংগঠন” পরিচালনা করত। যাদেরকে “মানহাজী” সদস্য বলা হয়। সদস্যরা সংগঠনের ভেতরে জঙ্গি সদস্য তৈরি করত। এছাড়া বিভিন্ন ইস্যুতে উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসবাদকে উস্কে দিত। সে “দাওয়াত ইসলাম” এর ব্যানারে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ করে জঙ্গিবাদে অন্তর্ভুক্তির বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে তারা বিশেষ করে মনস্তাত্ত্বিক অনুশোচনা জাগ্রত করার কৌশল অবলম্বন করে। এছাড়া সে মাহফিলের আড়ালে জঙ্গি সদস্য নিয়োগ দিত।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!