ছোট ভুলে বড় বিপদ কিডনি রোগীদের, করোনা ধরলেই কঠিন হচ্ছে বাঁচানো

১৩ মাসে করোনায় ভুগে ২২০ কিডনি রোগীর মৃত্যু

ছোট ভুলে বড় বিপদ ডেকে আনছেন করোনাভাইরাসের উপসর্গধারী কিডনি রোগীরা। মৃদু উপসর্গকে ‘সামান্য’ মনে করে গুরুত্ব না দেওয়ার পরিণতি হিসেবে বেশিরভাগকেই বরণ নিতে হচ্ছে মৃত্যুকে। গত ১৩ মাসে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসা এ ধরনের কিডনি রোগী মারা গেছেন অন্তত ২২০ জন। চিকিৎসকদের দেওয়া তথ্য মতে, করোনামুক্ত হওয়ার পর হাসপাতাল থেকে বাসায় গিয়েও এক-তৃতীয়াংশ রোগী মারা গেছেন নানা জটিলতায় ভুগে।

ডাক্তাররা বলছেন, কিডনি রোগীরা করোনার মৃদু সংক্রমণকে পাত্তা দেন না। জ্বর-সর্দি-কাশিকে মনে করেন সাধারণ রোগ। ভাইরাল ফিভার মনে করে বাড়ির পাশের মোড়ের ডাক্তারদের কাছ থেকে ওষুধ কিনে খান। কিন্তু সেই কিডনি রোগীই যখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে তার অক্সিজেন স্যাচুরেশন নিচের দিকে নামতে শুরু করে আর শুরু হয় শ্বাসকষ্ট— তখন হাসপাতালে এনেও সেই রোগীকে আর বাঁচানো সম্ভব হয় না। চট্টগ্রামে কিডনি রোগীদের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটছে প্রায়ই।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত ১৩ মাসে জরুরি বিভাগ ও কিডনি ওয়ার্ড হয়ে করোনা ডায়ালাইসিস ইউনিটে চিকিৎসা নিতে গেছেন ২৯৭ জন কিডনি রোগী। এর মধ্যে করোনা ধরা পড়েছে ৯২ জনের শরীরে। অন্যদিকে করোনার উপসর্গ মিলেছে ২০৫ জনের মাঝে। সবমিলিয়ে এ ধরনের রোগী মারা গেছেন ২২০ জন। বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কিডনি ওয়ার্ডে ১০০ থেকে ১২০ জন রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পোস্ট গ্রাজুয়েশনের শিক্ষার্থী ডা. সাদ্দাত হোসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘অজ্ঞতা, খামখেয়ালিপনা ও রোগ গোপন করার প্রবণতার কারণে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর কিডনি রোগীদের বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না।’

বিষয়টি ব্যাখা করে তিনি বলেন, ‘কিডনি রোগীরা করোনার মৃদু উপসর্গকে পাত্তা দেন না। জ্বর-সর্দি-কাশিকে মনে করেন ভাইরাল ফিভার। মোড়ের দোকান থেকে জ্বরের ওষুধ কিনে খান। এভাবে সময়ক্ষেপণ করতে করতে একসময় সেই সব রোগীর অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে শ্বাসকষ্ট শুরু হতে থাকে। তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসার পর জরুরি বিভাগের ডাক্তাররা পড়ে যান দোটানায়। কারণ রোগীরা সেখানেও জ্বর-সর্দি-কাশিতে ভোগার কথা গোপন করে।’

তিনি বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জরুরি বিভাগ থেকে র‌্যাপিড এন্টিজেন টেস্ট করে করোনা পজিটিভ হলে রোগীকে সরাসরি হাসপাতালে করোনা ইউনিট রেড জোনের কোভিড ডায়ালাইসিস ইউনিটে পাঠানো হয়। বাকি রোগীদের মেডিসিন ও কিডনি ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু সেখানেও শেষ রক্ষা হয় না। চিকিৎসাধীন অবস্থায় অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যায়। রোগীর প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়। শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। সেসব রোগীকেও তখন পাঠানো হয় রেড জোনের কোভিড ডায়ালাইসিস ইউনিটে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগী বাঁচানো আর সম্ভব হয় না।’

ডা. সাদ্দাত আরও বলেন, রেড জোনে কোভিড ডায়ালাইসিসে কিডনি রোগীদের জন্য তিনটি ডায়ালাইসিস মেশিনে প্রতিদিন ৯ থেকে ১০ জন রোগীকে ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়া হয়। প্রতি রোগীর ডায়ালাইসিসের সময় ৪ ঘন্টা। কিডনি ওয়ার্ডের মোট ১৩ জন পোস্ট গ্রাজুয়েশন শিক্ষার্থী শিফটিং দায়িত্ব পালন করেন ইউনিটটিতে। একেক শিক্ষার্থী একটানা ১৫ দিন রেড জোনের ডায়ালাইসিসে দায়িত্ব পালন করেন। ১৫ দিন পর দায়িত্ব পালন করেন আরেকজন।

তিনি বলেন, রোগীদের চিকিৎসাকালে ডায়ালাইসিস ক্যাথটার কিনতে গিয়ে গরিব রোগীরা দেরি করে ফেলেন। একেক ক্যাথেটারের দাম প্রায় ৩ হাজার ২০০ টাকা। হাসপাতাল থেকে এটির বরাদ্দ নেই।

জানা যায়, পেরিটোনাল ডায়ালাইসিসের সময় কিডনি রোগীর পেটের গহ্বরের (পেরিটোনাল গহ্বর) অংশের ভেতরে একটি নলের (ক্যাথেটার) মাধ্যমে একটি ক্লিনজিং ফ্লুইড (ডায়াল্যাসেট) সঞ্চালন করা হয়। ডায়ালাইসেট পেটের আস্তরণের (পেরিটোনিয়াম) রক্তনালীগুলো থেকে বর্জ্য পণ্যগুলো শোষণ করে সেসব রোগীর শরীর থেকে বের করে নেয়।

ডা. সাদ্দাত বলেন, করোনা আক্রান্ত কিডনি রোগীদের মধ্যে যাদের রেড জোনে ডায়ালাইসিস করতে হচ্ছে, তাদের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশকেই চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় এবং চিকিৎসা পরবর্তী সময়ে বাঁচানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

তার কথার সূত্র ধরে আরও জানা যায়, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর ডায়ালাইসিস করে কিডনি রোগীকে অনেক সময় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেড জোনে একমাসও থাকতে হয়। তবে যারা তাড়াতাড়ি করোনামুক্ত হয়ে একটু ভালোর দিকে যায়, সেসব রোগীকে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও নির্দেশিকা দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে অনেক কিডনি রোগীর শরীরে আবার রক্ত জমাট বেঁধে যায়—যা রোগীরা বুঝতে পারে না। অবস্থা দ্রুতই গুরুতর রূপ নিয়ে এ ধরনের রোগীরা মারা যায়।

কিডনি ওয়ার্ডের আরেক পোস্ট গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থী ডা. ইনসাদ জানান, যেসব রোগী কোভিড ডায়ালাইসিস ইউনিট থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি চলে যায়, তাদের আমরা ফোনে ফলোআপ করি। কিন্তু ফোনে যে তথ্য পাই তা রীতিমত ভড়কে যাওয়ার মতো। কারণ এক-তৃতীয়াংশ রোগী শুনছি হাসপাতাল থেকে বাসায় গিয়ে আর বেঁচে ফিরছেন না।

এমন পরিস্থিতিতে কিডনি রোগীদের কী করা উচিত— এমন প্রশ্নে ডা. সাদ্দাত হোসেন বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভ্যাকসিনেশনের মত র‌্যাপিড এন্টিজেন টেস্ট করানোর ব্যবস্থা করা উচিত কিডনি রোগীদের। যাতে জ্বর-সর্দির মতো করোনার মৃদু সংক্রমণ দেখা দিলেই এন্টিজেন টেস্ট করে দেখতে পারে তিনি করোনা আক্রান্ত কিনা। যদি এরকম কোনো কিছু শনাক্ত হয়, তাহলে তৎক্ষণাৎ রোগীকে হাসপাতালে চলে আসতে হবে। কিন্তু কিডনি রোগীরা এই ধরনের মৃদু উপসর্গকে গুরুত্ব না দেওয়ার পরিণতি হিসেবে মৃত্যুকে বরণ নিতে হচ্ছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!