ছোট চিরকূটের বেআইনি ব্যবসা শেষ করে দিচ্ছে খাতুনগঞ্জের বাজার, পণ্যের দাম বাড়ছে লাফিয়ে

করোনার কারণে কিছু সময় স্বাভাবিক থাকার পর চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ আবার অস্থির হয়ে উঠেছে ছোট চিরকূটের অবৈধ বাণিজ্যে। চট্টগ্রামে পাইকারি ব্যবসার এই প্রধান কেন্দ্রে কোটি কোটি টাকার ‘ডিও’ বা ডেলিভারি অর্ডার কেনাবেচা হয় কখনও মুখে মুখে, কখনও ফোনে, তবে বেশিরভাগই হয় ছোট্ট একটি স্লিপের মাধ্যমে। কাগজের এই স্লিপই কয়েক দফা হাতবদলের কারণে পণ্যের দামও বেড়ে যায় কয়েক গুণ। বাজারে তৈরি হয় অস্বাভাবিক অস্থিরতা।

খাতুনগঞ্জে ডিও’র বিপরীতে স্লিপের ব্যবসা অনেকটা শেয়ারবাজারের কাগুজে শেয়ারের ব্যবসার মতোই। পণ্য আমদানি করার পর প্রথম পর্যায়ে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের কাছে ডিও বিক্রি করে দিয়ে লাভের টাকা তুলে নেয়। এরপর মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা ওই ডিও ফের বিক্রি করে আরেক দফা লাভ করে। ডিওর মূল্য বেশি হলেও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়েও কেনা যায় বিশেষ স্লিপ। এভাবে স্লিপ হাতবদল হতে হতে পণ্যের মূল্য বাড়তে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে।

গত বছরের মার্চে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর অন্য সব ব্যবসাকেন্দ্রের মতো খাতুনগঞ্জও অনেকটা স্থবির হয়ে পড়ে। ডিও কিংবা স্লিপের লেনদেনও বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ভোগ্যপণ্যের বাজার ছিল অনেকটাই স্বাভাবিক। কিন্তু করোনার প্রভাব খানিকটা কমে আসতেই এখন আবার আগের মতোই অবৈধ ডিও ব্যবসা জমে উঠেছে, স্লিপে লেনদেন হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এর ফলে ভোজ্যতেল, চিনিসহ ভোগ্যপণ্যের বাজার আবার অস্থির হয়ে উঠেছে।

খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা খোলাখুলিই বলছেন, এই স্লিপ বাণিজ্য ঠিক এই সময়ে ভোজ্যতেলের দামে ইন্ধন জোগাচ্ছে।

জানা গেছে, যুগ যুগ ধরে খাতুনগঞ্জের অসৎ কিছু পাইকারি বিক্রেতা নগদ টাকার বিনিময়ে ডিও বা ডেলিভারি অর্ডার বিক্রি করে দেয় মধ্যস্বত্ত্বভোগী দালালদের কাছে। এর ফলে এক পণ্যের মালিকানা চলে যায় অনেকগুলো হাতে। এই ‘হাত’ বা দালালরা পণ্যের দাম বাড়ার জন্য অপেক্ষা করে। দাম বাড়লেই নিজেরা লাভ রেখে আরও বেশি দামে পাইকারি বিক্রেতা কিংবা তৃতীয় অন্য কোনো পক্ষের কাছে বিক্রি করে দেয়।

মূলত খাতুনগঞ্জভিত্তিক কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ব্রোকারেজ হাউজ কিংবা ভাসমান ব্রোকারের মূল ব্যবসাই হল ডিও বা স্লিপের বাণিজ্য করে দ্রুত টাকা হাতিয়ে নেওয়া।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে খাতুনগঞ্জের একজন ব্রোকার বললেন, ডিও’র বিপরীতে স্লিপের ব্যবসা অনেকটা শেয়ারবাজারের ব্যবসার মতোই। পাইকারি বিক্রেতার মাধ্যমে একজন আমদানিকারক বাজারে ডিও ছেড়ে দেয়। সেই ডিও বিনিময়ের মাধ্যমে লাভ তুলে নেয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্রোকাররা।

খাতুনগঞ্জে ভোজ্যতেলের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি সয়াবিন তেলের দাম স্বাভাবিক সময়ে মণপ্রতি (প্রায় ৩৭ কেজি) তিন হাজার থেকে তিন হাজার ২০০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করে। কিন্তু গত তিন মাসে এই পণ্যের দাম বেড়ে গেছে এক হাজার টাকারও বেশি। বর্তমানে প্রতি মণ সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে চার হাজার ২৫০ টাকায়।

সয়াবিন তেলই শুধু নয়, এই একই সময়ে পাম অয়েল এবং সুপার পাম অয়েলের দামও বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। পাম অয়েলের মণপ্রতি দাম এখন তিন হাজার ৭০০ টাকা। অন্যদিকে সুপার পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ তিন হাজার ৮০০ টাকায়।

জানা গেছে, বছরের মার্চে শুরু হওয়া করোনা মহামারি এবং এরপর ৬৬ দিনব্যাপি লকডাউনে খাতুনগঞ্জে কার্যত বন্ধ ছিল স্লিপের বাণিজ্য। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস থেকে করোনা পরিস্থিতির একটু উন্নতি হতেই আবার ফিরে এসেছে অবৈধ সেই বাণিজ্য— যা পণ্যের বাজারকে দিন দিন অস্থির করে তুলছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনায় লকডাউন চলাকালীন সারা দেশের পাইকারি বিক্রেতারা আমদানিকারক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সরাসরি পণ্য কিনতেন। সেই সময় বাজার ছিল স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল। পণ্যের দামেও ছিল না অস্থিরতা। সরকারঘোষিত সাধারণ ছুটি কিংবা গত রমজান মাসে ভোগ্যপণ্যের দাম সামান্য বাড়লেও পরে সেটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যায়। এমনকি গত ঈদুল আজহার আগে গত কয়েক বছরে পণ্যের দাম নেমে এসেছিল সর্বনিম্ন পর্যায়ে।

সাধারণ ব্যবসায়ীদের মতে, এর পেছনে মূল কারণ ছিল সেই সময় খাতুনগঞ্জের বাজারে কোনো দালাল, মৌসুমী ব্যবসায়ী বা স্লিপ ব্যবসায়ী ছিল না।

ব্যবসায়ীরা বলেন, গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে আমদানিকারক ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো খাতুনগঞ্জের বাজারে তেলের জন্য প্রচুর ডিও বা ডেলিভারি অর্ডার বিক্রি করেছে। সেই ডিও কেনার পর পাইকারি বিক্রেতারা অর্ডারগুলো ছোট ছোট স্লিপে ভাগ করে মৌসুমী ব্যবসায়ী ও দালালদের কাছে বিক্রি করে দেয়।

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ডিও এবং স্লিপ বাণিজ্যের জন্য একনামে পরিচিত যেসব প্রতিষ্ঠান, তার মধ্যে রয়েছে বাদশা মার্কেট, সোনামিয়া মার্কেট, নবী মার্কেট, ব্যাংক এশিয়া মার্কেট, জাফর মার্কেট এবং ইলিয়াস মার্কেট।

খাতুনগঞ্জের ডিও ব্যবসায়ী শামসুল ইসলাম বলেন, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী ও প্রকৃত ব্যবসায়ীরা শাটডাউনের সময় বাজার পরিচালনা করতেন। কিন্তু অক্টোবরের দিকে আগের সেই চেহারা আবার ফিরে আসে খাতুনগঞ্জে। এর ফলে কৃত্রিমভাবে পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রবণতা শুরু হয় আবার।

খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘ডিও এবং স্লিপ ট্রেডিংয়ের কারণে বাজারের অবস্থা অস্বাভাবিক হয়ে ওঠেছে। বাজারে সরবরাহ ও চাহিদার বদলে পণ্যের দাম ওঠানামা করছে শুধু স্লিপ বাণিজ্যের কারণে।’

সিপি

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড অবলম্বনে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!