সড়কে হারিয়ে যাওয়া ছেলের ভাঙা হেলমেট কাঁদাচ্ছে মাকে!

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আহসান হাবীবের পড়ে থাকা ভাঙা হেলমেটের দিকে অপলক চেয়ে থাকেন মা রাশেদা বেগম। আহসান হাবীবকে আদর করে মা ডাকতেন ‘সাজ্জাদ’। ‘সাজ্জাদ…সাজ্জাদ’— বারবার ডেকে ডেকে মূর্ছা যান তিনি। জ্ঞান ফেরার পর আবারও ছেলের পরনের কাপড় জড়িয়ে কেঁদে কেঁদে সাজ্জাদকে খোঁজেন মা। মায়ের ডাকে আর কোনদিন সাড়া দেবে না সাজ্জাদ। ছেলের শোকে প্রেসার আর ঘুমের ওষুধ খেয়েই দিন কাটছে রাশেদা বেগমের।

২৫ অক্টোবর রাতে খাবেন কি না জানতে চাইলে আহসান মাকে জানান, ‘আজ কাজের খুব তাড়া। রাতে বাসায় খাবেন না।’ বাবা মো. হাসান, ছোট ভাই গিয়াস উদ্দিন আর মায়ের সাথে আহসানের শেষ খাবারই ছিল সেদিনের দুপুরের খাবার। মৃত্যুর ঘণ্টা আগেও ছোট ভাই গিয়াসের খুঁনসুটি করেছিলেন তিনি। ছোট ভাইকে জানিয়েছিলেন রক্ত দানের কথা।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে আহসানের ছোট ভাই গিয়াস উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ভাই ছাড়া কেমন যে লাগছে বুঝাতে পারবো না। বুক ফেটে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করলে ভাইয়ের চেহারা ভেসে উঠছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভাইয়ের কাছে ঘটনার দিন বাইক চেয়েছিলাম। কিন্তু কাজ ছিল বলে নিজেই নিয়ে গেল। রাতে ভয় পেলে ভাইকে জড়িয়ে ঘুমাতাম। আমি এখন কাকে জড়িয়ে ঘুমাবো। ভাইয়া সবসময়ই বলতো আমি কাজ চোর। ভাইয়া ছিল বলেই আমি কাজে ফাঁকি দিতাম। ভাইয়ের সাথে শেষ দুষ্টামি সেদিন দুপুর ১.১৫ তে।’

আহসান হাবীবের ফেসবুক প্রোফাইলে গেলেই চোখে পড়বে তার জীবনবৃত্তান্তে লেখা— ‘এতো কিছু দিয়ে কী হবে?’ তার ফেসবুক দেয়ালে শুভেচ্ছাবার্তার সঙ্গে শোকবার্তা যেন মিশে একাকার। দেয়াল ছবির ওই মুখটা হাস্যোজ্জ্বল হলেও যেনো লেপ্টে গেছে শোকে।

সেদিন ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২টা পেরুতেই শুভাকাঙ্ক্ষী, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবদের শুভেচ্ছাবার্তায় ভরে গিয়েছিলো তার ফেসবুকের দেয়াল। রাত পেরিয়ে দিন শেষে শুভেচ্ছা বার্তার জবাব দেন নিজের ফেসবুক দেয়ালে। শেষ লেখায় সকলের কাছে মন থেকে ক্ষমা চান তিনি। আগের জন্মদিনগুলোতে জাঁকজমক করে পরিবার পরিজন নিয়ে আনন্দ করতেন আহসান। কিন্তু এবারের ২৪ শে অক্টোবর দিনটা ছিল একেবারেই ভিন্ন। জন্মদিনের কেক কাটবেন না বলেই জানিয়েছেন বাসায়।

আমজাদ পারভেজ নামের একজন তার ফেসবুক দেয়ালে লিখেছেন, ‘আহসান হাবিবের স্বপ্ন ছিল রাঙ্গুনিয়ার সকল বাইকারদের হেলমেট ব্যবহার নিশ্চিত করা। ৬৪ জেলা ঘুরে বিয়ের পিঁড়িতে বসার কথা ছিল। কিন্তু হয়নি তার স্বপ্ন পূরণ। শখের বাইকেই প্রাণ গেলো তার।’

বাইক লাভার্স সংগঠনের সদস্য নিয়াজ দুঃখভরা কন্ঠে দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আহসান ভাই আমার বড় ভাইয়ের মতো। উনার মতো বাইক রাইডার হয় না। তিনি বাইক লাভার্স সংগঠনের অ্যাডমিন। আমরা একসাথে কতো জায়গায় ঘুরেছি। তিনি আমার নিজের ভাইয়ের চেয়ে অনেক বড় কিছু। খুব দুঃখ হচ্ছে ভাইয়ার জন্য। কিভাবে এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলো। কতকিছুই তো বাকি ছিল। আহসান ভাইয়ের পরিবারের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ভাইয়া কখনোই কারোর ভালো ছাড়া ক্ষতি করেনি। সবসময় সবার পাশে ছিল। তাহলে তার সাথে কেনো হলো!’

https://www.facebook.com/100005921715384/videos/1325652750975436/

উল্লেখ্য, শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের রোয়াছড়ি এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহসান হাবিবের মৃত্যু হয়। কাপ্তাই থেকে চট্টগ্রামে বাইক চালিয়ে আসার পথে বাইকের সামনে একজন পথচারী চলে আসলে তাকে বাঁচাতে গিয়ে হঠাৎ ব্রেক করলে বাইক থেকে ছিঁটকে পড়ে যায় আহসান। এ সময় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি সিএনজি অটোরিকশা তার মাথায় চাপা দিয়ে চলে যায়। এতে তার মাথাসহ সমস্ত শরীরে গুরুতর জখম হয়ে মৃত্যু হয় আহসানের।

ছোটবেলা থেকে ক্রিকেট খেলায় ডুবে ছিলেন আহসান হাবীব। শখ ছিল ক্রিকেটার হওয়ার। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে অতিবাহিত করেন জীবনের কয়েক বসন্ত। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রাখতে হঠাৎ আহসান হাবীবের মনে দাগ কাটে জন্মস্থান রাঙ্গুনিয়ার তরুণদের নিয়ে কাজ করার। যুক্ত হন কয়েকটি সামাজিক সংগঠনের সাথে। নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কাজও করে যাচ্ছিলেন। সময়ের কিনারায় ধীরে ধীরে শখ পরিবর্তন হয়ে যায় আহসান হাবীবের। ক্রিকেটার হওয়ার নেশা পাল্টে হয়ে যান ভ্রমণ পিপাসু।

নতুন স্বপ্ন জাগে বাইকে চড়ে পুরো বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ানোর। যেই ভাবা সেই কাজ। একই সাথে ২০১৫ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর গড়ে তোলেন রাঙ্গুনিয়া বাইক লাভার্স (আরবিএল)। এর কাজই ছিল বাইকের যাবতীয় কাগজপত্র সঠিক রাখতে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করা। সকল বাইকারদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে হেলমেট ব্যবহার নিশ্চিত করা।

এসআর/এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!