ছেঁড়া শার্টে আশাহীন চোখ, দুর্দিনের ছাত্রনেতার অভাবের জীবন
একসময় তার নামডাক ছিল বেশ। দুর্দিনে আগলে রাখতেন দলকে। আজ পরিবার নিয়ে নিত্য অভাবে ভরা জীবন তার। তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মোতাহার হোসেন রানা।
মোতাহার হোসেন রানা ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জসিম উদ্দিন হল শাখার সাবেক সভাপতি। ছিলেন মিরসরাই থানা ছাত্রলীগের সভাপতিও। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাকে দেখা যেতো মিছিলের পুরোভাগে।
গত ১৬ নভেম্বর ছিল মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন একসময়ের মাঠকাঁপানো সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মোতাহার হোসেন রানা। সভামঞ্চে তারই হাতে গড়া কর্মী, সহযোদ্ধাদের অনেকে থাকলেও মোতাহার ছিলেন দর্শকসারির এক কোণায়। নতুন-পুরনো নেতাকর্মীদের ভিড়ে জনতার সারিতে একাকী বসে ছিলেন দুর্দিনের ত্যাগী এই নেতা। ময়লা ছেঁড়া শার্টে উদভ্রান্ত চোখের মানুষটিকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না এই লোকটিই একসময় ছাত্রলীগের দাপুটে নেতা ছিলেন।
মোতাহের হোসেন রানার নিজের অবশ্য আক্ষেপ নেই এ নিয়ে। দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বললেন, ‘আমি দীর্ঘদিন রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম। আওয়ামী লীগ আমার রক্তে মিশে আছে। একটা সময় রাজনীতিতে ছিলাম। কতজনকে কতো সাহায্য সহযোগিতাও করেছি। কিন্তু আমার আজকের এই পরিণতি শুধু আমার তকদিরের জন্য। ১৬ নভেম্বর সভায় আমার অবস্থান আমার তকদির ছাড়া কিছুই না। কেউ দায়ী নয় আমার এ অবস্থার জন্য। প্রধানমন্ত্রী আমাকে সম্মান দিয়ে কিছু ভাতা দেন। প্রধানমন্ত্রী যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন ততদিন ভাতাগুলো পাবো। তবে এ ভাতা দিয়ে পরিবার চালাতে পারি না।’
কথা বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, ‘আপা (প্রধানমন্ত্রী) আমার পরিবার নিয়ে চলতে খুব কষ্ট হয়। ৬ ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, আল্লাহ যে কেমনে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমিও জানি না। আপা আমি এমএ পাশ করেছি, আপনি আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিলে আপনার কাছে খুবই কৃতজ্ঞ থাকবো সারাজীবন।’
মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া এলাকায় মোতাহের হোসেন রানার বাড়ি। স্ত্রী ও ৬ ছেলেমেয়ে নিয়ে তার বসবাস। তিন ছেলে তিন মেয়ে পড়াশোনা করছে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সামান্য ভাতা পান মোতাহের হোসেন রানা। অল্প ওই ভাতায় চলে না তার পরিবারের সদস্যদের খাওয়া-দাওয়া ও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ। তবে অর্থকষ্টে থাকলেও রাজনীতির প্রতি নেই তার কোনো ক্ষোভ বা আক্ষেপ।
সরকার ও রাজনীতিবিদদের প্রতি কোনো আক্ষেপ আছে কিনা জানতে চাইলে মোতাহের হোসেন রানা বললেন, ‘কী বলেন? আমার ছাত্রলীগ, আমার আওয়ামীলীগ, আমার মাননীয় নেত্রী অনেক বছর পরে ক্ষমতায় এসেছেন এর চেয়ে সুখের আর কী হয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আমি চলি। আওয়ামী লীগ আমার রক্তে। কার প্রতি আমি ক্ষোভ প্রকাশ করবো? কারো প্রতি আমার কোনো দুঃখ নেই। যার ইচ্ছে হবে সে সাহায্য করবে। আমার ভাগ্য তো আমাকেই ভয়ে বেড়াতে হবে। কেনো আমি অন্য কাউকে দুষবো। সবসময় আমার বঙ্গবন্ধুর জয় হোক এ কামনা করি।’
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক সালাউদ্দিন সাকিব ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ক্ষমতার রাজনীতি বড়ই নিষ্ঠুর! জ্বি, উনি মোতাহার হোসেন রানা। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অগ্রসৈনিক। সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি। সাবেক সভাপতি, কবি জসিম উদ্দিন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি মিরসরাই উপজেলা ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম।’
আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজসেবা উপ-কমিটির সদস্য অধ্যাপক আজিজ আহমদ শরিফ বলেন, ‘রানা ভাই আমার খুব কাছের মানুষ। উনি নিজে একসময় অনেক করেছেন ছাত্রলীগের জন্য। কিন্তু আজ উনার টাকা-পয়সাও নেই, দাপটও নেই। এখনকার যুগে রাজনীতিগুলো এমনই হয়ে যাচ্ছে। রানা ভাইয়ের এ অবস্থা অথচ আমরা কেউ কিছু করিনি— এটা খুবই লজ্জার। আমি সামান্য একজন শিক্ষক। মাঝে মাঝে দেখা হলে টাকা-পয়সা দিই। কিন্তু আমাদের এ দেওয়া তো তার পোষায় না। বর্তমানে তিনি ঢাকায় আছেন।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, ‘রানা ভাইয়ের এ অবস্থা দেখে নিজেকে সামলাতে পারিনি। একজন ভালো মানুষ, ত্যাগী নেতার এমন পরিণতি কিন্তু মেনে নেওয়া যায় না। এলাকায় অনেক বড় বড় নেতা, মন্ত্রীরা আছেন তারা দেখলে হয়তো আজ রানা ভাইয়ের এ অবস্থা হতো না।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সাবেক সহ-সম্পাদক নওশাদ মাহমুদ রানা বলেন, ‘১৯৮৫ সাল থেকে রানা ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। রানা ভাই ছিলেন মিরসরাই থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য। রাজনীতিতে উনার মতো ত্যাগী নেতা আমি আর একজনকেও দেখিনি। যেকোনো ঝামেলায় ঝাঁপিয়ে পড়তেন তিনি, নিজের চিন্তা করেননি কখনো। শুধু দিয়ে গেছেন ওনার যা ছিলো। অথচ উদভ্রান্ত, ময়লা ছেঁড়া শার্ট পরিহিত ও আশাহীন চোখে তাকিয়ে থাকা এ মানুষটিকে আজ বড়ই অসহায়ভাবে বেঁচে থাকতে হচ্ছে আমাদের সমাজে। বর্তমান রাজনীতিতে অর্থ-বিত্ত না থাকলে তার দাম নেই। এখন তো রাজনীতিও নেই। রাজনীতিকে সাইবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করে কিছু মানুষ টাকা উপার্জনের পথ বের করেছে মাত্র।’
সিপি