পথে পথে ঝুপড়ি/ ফিশারিঘাট থেকে পাথরঘাটা চোলাইমদের অভয়ারণ্য

শুরুতে ফ্রি খাইয়ে ব্যবসা এখন জমজমাট

চট্টগ্রাম মহানগরীতে মদের মহালের আড়ালে চলছে চোলাইমদের রমরমা ব্যবসা। একটি কক্ষ ও নির্দিষ্ট সীমানায় মদের ব্যবসাটি পরিচালনা করার শর্তে অনুপ বিশ্বাস নামের এক ব্যক্তি মদ বিক্রির লাইসেন্স পেয়ে আড়ালে চালিয়ে যাচ্ছেন চোলাইমদের অবৈধ ব্যবসা—এমন অভিযোগ এলাকাবাসীর। নগরীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ফিশারিঘাট থেকে পুরো পাথরঘাটা এলাকাজুড়ে সড়কের পাশে গজিয়ে ওঠা শত শত ঝুপড়িতে চলছে চোলাইমদের বিক্রি ও সেবন। পুরো এলাকাই এখন মদ বিক্রি ও সেবনের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলা এ অনাচারে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে।

শুরুতে ফ্রি, এখন জমজমাট
জানা যায়, অনুপ বিশ্বাস নামের এক ব্যক্তি নগরীর কোতোয়ালী থানার ফিশারিঘাট এলাকার ১২৮ নম্বর ইকবাল রোডের চারতলা একটি ভবনে মদের মহালের লাইসেন্স পান। এর আগে এ মহালটি ছিল ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায়। ২০০৫ সাল থেকেই মূলত মদের মহালের আড়ালে শুরু হয় চোলাই মদের ব্যবসা। শুরুতে ব্যবসা প্রসারের লক্ষ্যে এলাকার প্রভাবশালী একশ্রেণীর যুবক ও মধ্যবয়স্ক শ্রেণীদের এক থেকে তিন লিটার পর্যন্ত মদ বিনামূল্যে দেওয়া হতো। বিনামূল্যে পাওয়া মদের কিছুটা নিজেরা কিছু সেবন করতো, বাকি মদ অন্যজনের কাছে বিক্রি করে দিতো। এভাবে একসময় এই ব্যবসা জমজমাট হয়ে ওঠে।

ফিশারিঘাট এলাকায় চারতলা এই ভবনে মদের মহাল
ফিশারিঘাট এলাকায় চারতলা এই ভবনে মদের মহাল

‘ম্যানেজ’ করেই চোলাইমদের ব্যবসা
সূত্র জানায়, স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে অনুপ বিশ্বাসের চোলাইমদের ব্যবসা। অনুমোদিত মদের মহালের আড়ালে চোলাইমদের এই অবৈধ ব্যবসা এখন নগরজুড়ে ছেয়ে গেছে। ব্যবসা নির্বিঘ্ন রাখতে নগরীর ফিশারীঘাট এলাকায় ৪০ থেকে ৫০ সদস্যের সন্ত্রাসী বাহিনীও গড়ে তোলা হয়েছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তার ওপরে নেমে আসে হামলা, মামলা ও হুমকি। এ কারণে ভয়ে কেউ এদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস করেন না।

জানা যায়, ২০১৮ সালের ৫ মে নগরীর ফিশারিঘাট এলাকায় এনজেড গলির অনুপ বিশ্বাসের বিল্ডিং থেকে সরবরাহ হওয়া চোলাইমদসহ মো. ইউসুফকে (৪৫) গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এ সময় ৫ লাখ টাকা মূল্যের ৯৯০ লিটার দেশীয় তৈরি চোলাইমদ জব্দ করা হয়।

২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দেওয়া লাইসেন্সের নীতিমালা অমান্য করার অপরাধে নগরীর কোতোয়ালী থানার ফিশারীঘাট এলাকায় অনুপ বিশ্বাসের মদের মহালে অভিযান চালিয়ে এক হাজার লিটার মূল্যের দেশীয় চোলাই মদসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৭।

গত ১৪ অক্টোবর (২০১৪) মহানগরের কোতোয়ালী থানা এলাকায় অনুপ বিশ্বাসের মদের মহাল থেকে ১৬২ লিটার মদসহ বকুল মিয়া (২৬) নামে এক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

এ ছাড়া গত সাত মাস আগে ৭০০ লিটারসহ দেশীয় তৈরি চোলাই মদসহ অনুপ বিশ্বাসের মদের মহালের সিকিউরিটিকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এছাড়া পুরো চট্টগ্রামের গ্রেপ্তারকৃত চোলাইমদ ব্যবসায়ি ফিশারিঘাট থেকে চোলাইমদ নিয়ে বহুবার গোয়েন্দা পুলিশ, র‌্যাব ওমাদকদ্রব্য অধিদপ্তর গ্রেপ্তার করেছে প্রশাসনিক সূত্রে জানা যায়।

প্রতিবাদ করলেই হয়রানি
এদিকে অনুপ বিশ্বাসের এ মদের মহালের আড়ালে অবৈধ কর্মকাণ্ড এবং অবাধে মদ বিক্রি ও সেবনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে হয়রানির স্বীকার হয়েছেন সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদপ্রার্থী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনাম।

তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, ‘তিন বছর আগে অবাধে মদ বিক্রি ও সেবন এবং পুরাতন মাছবাজার স্থানান্তরের প্রতিবাদ করায় অনুপ বিশ্বাস দুটি অস্ত্র দিয়ে পুলিশ দিয়ে আমাকে গ্রেপ্তার করায়। তিন মাস জেল খেটে বর্তমানে আমি জামিনে মুক্ত হয়ে আবার এসবের প্রতিবাদ করছি।’

তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে এলাকার হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম নির্বিশেষে ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতারা রয়েছেন। স্থানীয় কাউন্সিলরও আমার সঙ্গে আছেন। তারা আমাকে সাহস যুুগিয়েছেন। আমি ভয় করি না, এসবের প্রতিবাদ করতে গিয়ে যদি মারাও যায়, আপস করবো না।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে গত কয়েকদিনে অনুপ বিশ্বাসের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে একাধিকবার কল ও এসএমএস পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।

<span>পথে পথে ঝুপড়ি/</span> ফিশারিঘাট থেকে পাথরঘাটা চোলাইমদের অভয়ারণ্য 1
ফিশারিঘাট এলাকায় মাদকবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন পালন করে স্থানীয়রা।

এলাকায় বিক্ষোভ, মানববন্ধন
গত ১৯ জুন অনুপ বিশ্বাসের মদের মহালটির লাইসেন্স বাতিল ও তার সহযোগীদের মদব্যবসার প্রতিবাদে ফিশারিঘাট এলাকায় মাদকবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন পালন করে স্থানীয়রা। থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মশিউর রহমানের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় কাউন্সিলর মো. ইসমাইল বালি, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, ছাত্রসহ এলাকাবাসী।

কাউন্সিলরের আক্ষেপ
স্থানীয় কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইসমাইল বালি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘অনুপ বিশ্বাসের মদের মহালটি ছিল ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায়। সেখান থেকে স্থানীয়রা উঠিয়ে দিলে ফিশারিঘাটে তিনি মহালটি চালু করেন। নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে এসে অবাধে মদের এলাকা ও সেবনকারী স্থানে পরিণত করছেন তিনি। বিষয়টি অবগত করে মদের মহালটি বন্ধ ও তার মহালটির লাইসেন্স বাতিল চেয়ে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরে চিঠি দিয়েছি। আমি প্রশাসনকে অনুরোধ করবো এ বিষয়ে শীঘ্রই ব্যবস্থা নিলে যুবসমাজ ধ্বংস থেকে রক্ষা পাবেন।’

অবগত প্রশাসন
চট্টগ্রাম মাদক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামীম আহমেদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘একটি কক্ষ ও নির্দিষ্ট সীমানায় ব্যবসাটি পরিচালনা করার শর্তে অনুপ বিশ্বাস মদ বিক্রির লাইসেন্স পেয়েছেন। ঢালাওভাবে ঝুপড়িকেন্দ্রিক মদ বিক্রি ও সেবন করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এছাড়া তার বিরুদ্ধে চোলাই মদ বিক্রির অনেক অভিযোগ রয়েছে। শীঘ্রই এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

চট্টগ্রাম মহানগরের পুলিশের উপ পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মেহেদী হাসান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘অনুপ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে এর আগেও তথ্য পেয়েছি। শীঘ্রই অভিযান পরিচালনা করা হবে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!