চিকিৎসা নিতে এসে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নতুন ঝুঁকিতে নবজাতক ও মা

ওয়ার্ডের ভেতরে নবজাতক, বারান্দায় থাকেন প্রসূতি মা

১৯ বছর বয়সী রিকন আকতার মা হয়েছেন তিনদিন আগে। চট্টগ্রামের বাঁশখালীর এই মায়ের গর্ভে আসে ফুটফুটে এক ছেলেসন্তান। কিন্তু গ্রামের বাড়িতে স্থানীয় এক ধাত্রীর হাতে সন্তান প্রসবের পর পরই শিশুটি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। অবস্থা ভালো নয় দেখে পাঁচ দিনের সেই নবজাতককে এনে ভর্তি করান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউনেটাল বা নবজাতক ওয়ার্ডে। পাঁচ দিন বয়সী শিশুটি ভেতরে, আর সদ্য প্রসূতি মাকে থাকতে হচ্ছে ওয়ার্ডের বাইরে— হাসপাতালের বারান্দায়।

বুধবার (২ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ঠান্ডা মেঝেতে পাটি বিছিয়ে বসে আছেন রিকন আকতার। তার সাথে এসেছেন মা, ছোট বোন ও তার স্বামী। ওয়ার্ডের ভেতর থেকে ডাক্তাররা ডাকলে তিনি ভেতরে গিয়ে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাইয়ে দিয়ে আসছেন। রাতে বারান্দার গ্রিল দিয়ে ঢোকে ঠান্ডা বাতাস। ওয়ার্ডের নোংরা বাথরুমটিই রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে ব্যবহার করতে হয়। মা বারান্দা থেকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ওয়ার্ডের দিকে। প্রতি মুহূর্ত কান পেতে থাকেন কখন ভেতর থেকে ডাক্তারের ডাক আসবে, কখন দেখতে পারবেন সন্তানকে। এদিকে ঠান্ডা মেঝে ও খোলা বারান্দায় থাকতে গিয়ে রিকনের শরীরও ভালো নয়। রাতে জ্বর এসেছে দুইদিন।

রিকনই শুধু নন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩২ নং নবজাতক ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন সব নবজাতকেরই নতুন মায়েদের আশ্রয় হয়েছে ওয়ার্ডের সামনের বারান্দায়। বারান্দার মেঝেতে অমানবিক পরিবেশে থাকতে গিয়ে সদ্য প্রসূতি মায়েরা নতুন করে নানা শারীরিক সমস্যায় পড়েছেন। কারও জ্বর, সর্দি, তলপেটে ব্যাথা, মাথাব্যথা, কারও বা আবার রক্তক্ষরণের মতো সমস্যায়ও পড়তে হচ্ছে।

চিকিৎসা নিতে এসে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নতুন ঝুঁকিতে নবজাতক ও মা 1

নবজাতক ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা বলছেন, নবজাতকের সাথে নতুন মায়েদেরও শারীরিক সুরক্ষা জরুরি। মায়েরা সুরক্ষিত না হওয়ায় সংক্রমণ ছাড়াতে এসে নবজাতকেরা উল্টো নতুন করে সংক্রমণের শিকার হচ্ছেন। বাড়ছে নবজাতকের শারীরিক জটিলতা। সুস্থ হতে সময় লাগছে বেশি।

নবজাতক ওয়ার্ড সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩২ নং নবজাতক ওয়ার্ডে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৭ হাজার ৯১৪ জন নবজাতক ভর্তি হয়েছিল। এর মধ্যে মারা গেছে ১ হাজার ৪১৯ জন। প্রতি মাসে চিকিৎসা নিতে আসা নবজাতক মৃত্যুর হার ১৫ শতাংশ। কোনো কোনো মাসে এটি আরও বেশি বলে জানান ওয়ার্ডে কর্মরত নার্স।

চিকিৎসা নিতে এসে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নতুন ঝুঁকিতে নবজাতক ও মা 2

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ধারণক্ষমতার পাঁচ গুণ বেশি নবজাতককে চিকিৎসাসেবা দিতে হচ্ছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্পেশাল কেয়ার নিওনেটাল ইউনিট বা নবজাতক ওয়ার্ডে। নবজাতক ওয়ার্ডে অনুমোদিত শয্যা সংখ্যা ৩২টি। তবে স্থানীয়ভাবে ১০০টি শয্যা স্থাপন করা হয়েছে ওয়ার্ডে। এই ১০০ শয্যার বিপরীতে গড়ে দৈনিক ১৫০ শিশু ভর্তি থাকে। কারণ শুধু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জন্ম নেওয়া নবজাতক নয়, বৃহত্তর চট্টগ্রামের অন্যান্য জেলায় উন্নত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় সেখানকার অসুস্থ নবজাতকদেরও চিকিৎসার জন্য এখানে নিয়ে আসা হয়।

নবজাতক ওয়ার্ডের বিভাগীয় প্রধান ডা. জগদীশ চন্দ্র দাশ জানান, তিন ধরনের সমস্যা নিয়ে আসা নবজাতককে এখানে ভর্তি করা হয়। জন্মের পর শ্বাস নিতে না পারা বা কান্না না করা, জীবাণুর সংক্রমণ, অপরিণত ও স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ। চিকিৎসা ভাষায় এটিকে প্রিম্যাচিউরিটি (অকালজাত) বলা হয়ে থাকে।

চিকিৎসা নিতে এসে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নতুন ঝুঁকিতে নবজাতক ও মা 3

ওয়ার্ডে জনবল সংকট রয়েছে বলে জানিয়ে ডা. জগদীশ জানান, জন্মের পর প্রথম ২৮ দিন বয়স পর্যন্ত শিশুদের সংক্রমণ খুবই বিপজ্জনক। সংক্রমণের কারণে নবজাতকের মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। তাই মায়েদের জন্য সুরক্ষিত পরিবেশ জরুরি বলে জানান তিনি। এ দিকটা মাথায় রেখে ওয়ার্ডের বাইরে বারান্দার জায়গাটা ঘিরে নতুন মায়েদের থাকার ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান ডা. জগদীশ চন্দ্র দাশ।

কিন্তু ওয়ার্ডের বাইরে নতুন মায়েদের সুরক্ষিত পরিবেশের ছিঁটেফোটা নমুনাও দেখা যায়নি। নতুন মায়েরা বারান্দায় থাকতে গিয়ে নতুন করে সংক্রমিত হচ্ছেন। পরবর্তীতে তারা নবজাতককেও সংক্রমিত করছেন।

ফটিকছড়ির মেয়ে ইসমত আরা মুন্নি মাত্র চার দিন আগে ছেলেসন্তানের জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু জন্মের পরপরই তার বাচ্চার ঠান্ডা লেগে যাওয়ায় এনে ভর্তি করান নবজাতক ওয়ার্ডে। অন্যদের মতোই ডাক্তার ডাকলে ভিতরে গিয়ে বাচ্চাকে দেখে আসেন মুন্নি। মুন্নির শরীর দুর্বল। চোখ-মুখ ফ্যাকাসে। মুন্নি তার মা, বোন ও ভাবীর সাথে বসে আছেন নবজাতক ওয়ার্ডের সামনের বারান্দাতেই। ছোট একটি পাটির ওপর চাদর বিছিয়ে রাতে থাকছেন তারা।

চিকিৎসা নিতে এসে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নতুন ঝুঁকিতে নবজাতক ও মা 4

নবজাতক ওয়ার্ডের সামনের বারান্দার এসব চিত্র প্রতিদিনেরই। গত ২৯ নভেম্বর ও ১ ডিসেম্বর গিয়ে এর ব্যতিক্রম কিছু চোখে পড়েনি। বারান্দায় নতুন মায়ের সাথে দেখা গেছে তিন থেকে চারজন স্বজনকে থাকতে। অনেক মায়ের সাথে দেখা গেছে পাঁচ থেকে ছয়জনও। গাদাগাদি করে পাটি বিছিয়ে বসে থাকেন কেউ। কেউবা শুয়ে, কেউবা গোল হয়ে বসে গল্প করছেন। সেখানে বসে খাবার খাওয়ায় জায়গাটাও হয়ে পড়েছে অপরিচ্ছন্ন। তারপরও সবার মধ্য থেকে নতুন মায়েদের আলাদা করে চেনা যায়। চোখে-মুখে তাদের ক্লান্তির ছাপ, অবসন্ন চেহারা। এর মধ্যেই বিক্রি হচ্ছে মাস্ক। ফেরিওয়ালা ফাস্কে করে বিক্রি করছে চা। ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে হাসপাতালের ভেতরের কয়েকজন দালালকে।

নোংরা বাথরুম, সিকিউরিটি গার্ড বেচে মাস্ক-পিপিই
ওয়ার্ডের গেটে থাকা সিকিউরিটি গার্ডদের চড়া মূল্যে মাস্ক ও পিপিই বিক্রি করতে দেখা গেছে। বাচ্চাকে দেখতে ওয়ার্ডের ভেতরে যেতে হলে মাকে প্রসূতি মায়েদের পিপিই পরে যেতে হয়। বাইরের ফার্মেসিতে যেসব পিপিই বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়, ওয়ার্ডের গেটে থাকা সিকিউরিটি গার্ডরা সেই একই পিপিই বিক্রি করছেন ২৫০ টাকায়। কিন্তু ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে এসে নতুন মায়েরা পিপি ফেলে রাখছেন নোংরা জায়গায়।

বহদ্দারহাট থেকে আসা তাসলিমা আক্তার ১৫ দিন আগে এ ওয়ার্ডে তার বাচ্চাকে ভর্তি করিয়েছেন। বাচ্চার বয়স ২২ দিন। তার বাচ্চার হঠাৎ করে প্রস্রাব-পায়খানা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সাথে সাথে এনে ভর্তি করান এই ওয়ার্ডে। সৈয়দা বেগম নামের আরেক মা তার ১৭ দিনের বাচ্চা ঠান্ডার সমস্যায় পড়ার পর এ ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়েছেন।

অন্যদিকে মিনু আক্তার এসেছেন বাঁশখালী থেকে। তার ছেলে হয়েছে ৪ দিন আগে। ৭ মাস ৫ দিনেই ওই বাচ্চা ভূমিষ্ট হয়। বাচ্চা প্রিম্যাচিউরড (অপূর্ণাঙ্গ) হওয়ায় রাখা হয়েছে ইনকিউবেটরে। মিনু আক্তারকে ঘিরে তার বোন, ভাবী, মামী মিলে ছয় থেকে সাতজন মহিলা বসে গল্প করছেন। ১ নভেম্বর বিকেলে প্রতিবেদকের সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন মিনুর চোখে ঘুম ঘুম ভাব। মিনু জানান, রাতে তার ঘুম হয় না। বাচ্চার দুশ্চিন্তায় সবসময় বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!