চিকিৎসাই হল না, বিল এল ৪১৭০৬ টাকা মাত্র!

চট্টগ্রামের এক ইউরোলজিস্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ

ডাক্তার রিপোর্ট দেখেই বললেন, ‘কিডনি তো দুইটাই ড্যামেজ। আপনার অপারেশন করা লাগবে। কেবিন দিচ্ছি, ভর্তি হয়ে যান।’ এই টেস্ট সেই টেস্ট— শুরুতেই নগদে ১৬ হাজার টাকার টেস্ট। রোগী এর মধ্যে কেবিনেই করলেন ব্রেইন স্ট্রোক। পাঁচদিনের মাথায় ডাক্তার বললেন, রোগী অপারেশনের জন্য ফিট না, বাসায় নিয়ে যান। চিকিৎসাই হল না। কিন্তু বিল এলো ৪১ হাজার ৭০৬ টাকা! ডাক্তার বললেন, টাকা দিয়ে রোগী নিয়ে যাবেন।

চট্টগ্রামের একজন ইউরোলজিস্ট ডা. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসাইন ও তার মালিকানাধীন চিটাগং ইউরোলোজি এন্ড জেনারেল হাসপাতালের বিরুদ্ধে এমন হয়রানি ও প্রতারণার অভিযোগ এনেছেন একজন আওয়ামী লীগ নেতা। হাসপাতালটি চট্টগ্রাম নগরীর সুগন্ধা এলাকায় অবস্থিত। তার পিতার জরুরি অপারেশন করতে হবে জানিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে পাঁচ দিন ধরে বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখা হয়। পরে প্রায় ৪২ হাজার টাকার ভুয়া বিল ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলে ডা. জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক বরাবর একটি লিখিত অভিযোগও জমা দিয়েছেন জাহেদ হোসাইন টিপু নামের ওই আওয়ামী লীগ নেতা। পরে অনেক অনুনয় করে ২৮ হাজার টাকায় পিতাকে রিলিজ করানোর কথা জানালেও টিপু অভিযোগ করেছেন ৫ দিনের হয়রানি ছাড়াও কোন চিকিৎসা না পেয়ে আরও ৪৮ হাজার ৫০০ টাকা গচ্ছা দিতে হয়েছে তাকে।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ কমিটির সাবেক সদস্য জাহেদ হোসাইন টিপু বুধবার (৩ জুন) রাতে তার ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে দেয়া এক পোস্টে লিখেছেন, ‘চিটাগং ইউরোলোজি এন্ড জেনারেল হাসপাতালে আমার বাবার কিডনি সমস্যা নিয়ে ডা. জাহাঙ্গীরের কাছে গেলাম। তিনি আমার বাবার আগের রিপোর্টগুলো দেখে আমার বাবার সামনেই বললেন ‘আপনার কিডনি তো দুইটাই ড্যামেজ। আপনার অপারেশন করা লাগবে। আপনাকে কেবিন দিচ্ছি, ভর্তি হয়ে যান।’ আমরাও ভর্তি করালাম। তখন তিনি বললেন আগে অগ্রিম পাঁচ হাজার টাকা জমা দেন। দিলাম টাকা। আমার বাবা কষ্ট পাচ্ছে। আমরা দেখেও কিছুই করতে পারছি না।’

হাসপাতালে ভর্তির পর তাদের অনেকগুলো টেস্ট করতে হয়েছে জানিয়ে টিপু লিখেছেন, ‘ডা. জাহাঙ্গীর তার ইচ্ছেমত টেস্ট দিলেন। তার নিজের ল্যাবে প্রায় ১৬ হাজার টাকার টেস্ট করালেন।’

অপারেশন করতে হবে বলে ভর্তি করানো হলেও তার পিতাকে বিনা চিকিৎসায় ফেলে রেখে সময় বাড়ানো হচ্ছিল— এমন অভিযোগ করে টিপু লিখেছেন, ‘এভাবে সময় নষ্ট করেই যায়। তারপর আমার বাবা ওই কেবিনেই ব্রেইন স্ট্রোক করে। তাও কোন চিকিৎসা নেই। আমি বারবার যাওয়ার পর তিনি (ডা. জাহাঙ্গীর) সিটি স্ক্যান করতে দেন। এভাবে ৫টা দিন পড়ে থাকে বাবা। আমি ডাক্তার কল করতে বলি। ওরা বলে ডাক্তার আসে না। তাই আমি নিজেই একজন নেফ্রোলজিস্ট ডাক্তার নিয়ে আসি। এতে তিনি রাগান্বিত হয়। পরে তিনি একজন ডায়বেটিস ডাক্তার নিয়ে আসে। সেই দিন রাতটা ছিলো আমার জীবনের কালোরাত। আমার বাবার ডায়াবেটিস নিল হতে বসে। পরে সারারাত দৌড়াদৌড়ি করে একজন নার্স ম্যানেজ করে বাবার শরীরে গ্লুকোজ দিয়ে বাবাকে বাঁচিয়ে নিই।’

এই সময়ে ডাক্তার তার কাছে বিল চাওয়া ছাড়া আর কোন কাজই করেনি উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘ডা. জাহাঙ্গীরের কাজ ছিল শুধু রুমে গিয়ে আমাকে বলা— ভাই আরও ১০ হাজার টাকা জমা দেন। অথচ সব টাকা নগদ দিয়েই ট্রিটমেন্ট করছি। কল করা ডাক্তারের টাকা আগে নিয়ে নিছে। পাঁচ দিন যাওয়ার পর বললেন উনি অপারেশনের জন্যে ফিট না। আপনারা উনাকে নিয়ে যান।’

এই ধরনের হয়রানির পর বিদায়বেলায় বিল নিয়ে নতুন হয়রানির মুখে পড়ার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে টিপু লিখেছেন, ‘৪১ হাজার ৭০৬ টাকার বিল একটা করে দেয়। বলে টাকা দিয়ে রোগী নিয়ে যান। আমি বললাম বিলটা দেন। বিল দেওয়ার পর দেখি ওই বিলে এর মধ্যে খরচ হয়ে যাওয়া টেস্টের কোন টাকা উল্লেখ নাই। ডাক্তার কল করার টাকা উল্লেখ নাই। সম্পূর্ণ নতুন বিল ৪১ হাজার ৭০৬ টাকা। আগে দুই দফায় ৫ হাজার করে ১০ হাজার টাকা দিয়েছি। ওইসব মাইনাস দিয়ে ৩১ হাজার ৭০৬।’

হাসপাতালের ওই বিলের অসঙ্গতি তুলে ধরে তিনি লিখেন, ‘এখন কথা হলো আমি বিল শো করছি। এখানে রেজিস্ট্রেশন ফি ৫ হাজার, এটা কী? বিলটা দেখবেন, এই ৫ দিনে ওষুধ কী দিয়েছে তার কোন লিস্ট দেয়নি তারা। তারপর তার কাছে রিকোয়েস্ট করলাম। বললাম আমার বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি এটা শুনে রেগে গেলেন। বললেন ৭১ এর পর মুক্তিযোদ্ধা নাই। আমি আমার দলীয় পরিচয় দিলাম। তিন বললেন কিসের ছাত্রলীগ, কিসের আওয়ামী লীগ। আমি আমার টাকায় ব্যবসা করতে বসছি। আমি কিছু না বলে তাকে টেস্ট আর কল ডাক্তারের টাকাগুলোসহ ২৮ হাজার টাকা দিয়ে রিলিজ নিয়ে বাবাকে বাসায় নিয়ে আসি।’

তবে এরপরেও কোন চিকিৎসা পাওয়া ছাড়াই হয়রানির পাশাপাশি ৪৮ হাজার ৫০০ টাকা গচ্ছা দিতে হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘টেস্ট করাতে ১৬ হাজার টাকা লেগেছে, কল ডাক্তার বাবদ ৪ হাজার ৫০০ টাকা, হাসপাতালে জমা দিতে হয়েছে ২৮ হাজার টাকা। সবমিলিয়ে ৪৮ হাজার ৫০০ টাকা। ৫ দিনে কোন চিকিৎসা না পেয়ে বাবাকে বাসায় দিয়ে আসলাম।’

আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় উপকমিটির নেতা হয়েও এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হলে চিকিৎসা খাতে সাধারণ মানুষদের কী রকম ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়— সেই প্রশ্ন জুড়ে দিয়ে জাহেদ হোসাইন টিপু বলেন, ‘এবার আপনারাই বলেন, আমার সাথে যদি এমন হয়, তাহলে সাধারণ জনগণের কী হবে?’

ওই পোস্টেই মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন নামের একজন লিখেছেন, ‘এই ডাক্তারটা এমনই। গলাকাটা। আমার আব্বুর বেলাতেও জোর করে অপারেশন করাইছে। অনেক কষ্ট পাইছে আব্বু। উনার কাজই রোগীদের সাথে এমন করা। অপারেশনের পর আবার প্রতিদিন যেতে বলত। প্রস্রাবের রাস্তা পরিষ্কার করার কথা বলত। ডেইলি এক হাজার টাকা নিত। অসুস্থ বাবার চিকিৎসার জন্য টাকাটা মূখ্য না। কিন্তু রোগী যে পরিমাণ কষ্ট পায় সেটা খুবই অমানবিক। পরে অন্য ডাক্তার দেখাই আমরা। ওই ডাক্তার অনেক ক্ষেপে গেছিল। বলল, আপনারা কেন অপারেশন করাইছেন। এই অসুখ ওষুধের মাধ্যমেই সেরে যায়। পরে আল্লাহর রহমতে আব্বা অনেক সুস্থ হয়।’

এদিকে চিকিৎসার নামে এই প্রতারণার বিষয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন ভুক্তভোগী জাহেদ হোসাইন টিপু।

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!