চাহারে চুরমার বাংলাদেশের সিরিজ জয়ের স্বপ্ন

দীপক চাহারের আগুন ঝরানো শুরু আর শেষের বোলিং তোপে বাংলাদেশের প্রথমবারের মতো ভারত জয়ের স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়। দলের চাহিদা মিটিয়ে প্রতিপক্ষের রানের চাকা থামিয়ে রাখা, সময় মতো উইকেট নেয়া এবং সবশেষ বোলারের জন্য স্বপ্নময় হ্যাটট্রিক পূরণ করা, কোন কিছুই বাকি ছিল না চাহারের। একই ম্যাচে এতসব কিছু করে বিশ্ব রেকর্ডে নিজের নাম তুলে ফেলেছেন ভারতের ডানহাতি পেসার দ্বীপক চাহার। সিরিজ নির্ধারণী শেষ ম্যাচে বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপকে একাই গুঁড়িয়ে দিয়ে মাত্র ৭ রানের বিনিময়ে ৬টি উইকেট নিয়েছেন তিনি। ম্যাচের চাহারের বোলিং ফিগার ৩.২-০-৭-৬!

আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এত কম রানে ৬ উইকেট নেয়ার রেকর্ড নেই আর কারো। এতদিন ধরে ৮ রানে ৬ উইকেট নিয়ে বিশ্ব রেকর্ড নিজের দখলে রেখেছিলেন শ্রীলঙ্কান স্পিনার অজান্থা মেন্ডিস। তাকে এবার দুইয়ে নামিয়ে দিলেন চাহার।

চাহারে চুরমার বাংলাদেশের সিরিজ জয়ের স্বপ্ন 1
চাহারের হ্যাটট্রিকসহ ছয় উইকেট শিকারে বাংলাদেশের সিরিজ জয়ের স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়

চাহারের এমন ভয়ঙ্কর রূপে এশিয়া কাপ, নিদহাস ট্রফির পর এবার টি-টোয়েন্টি সিরিজেও তীরে এসে ডুবল টাইগারদের তরী। ফাইনাল নামের দুঃস্বপ্ন যে কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না! আরও একবার প্রত্যাশার বেলুন ফের চুপসে গেল! এশিয়া কাপে হয়নি, নিদহাস ট্রফির ফাইনালেও এই ভারতের বিপক্ষে হতাশায় মাঠ ছেড়েছে বাংলাদেশ। এবার ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজের অলিখিত ফাইনালেও লেখা হলো সেই একই শোকগাথা! টাইগারদের জন্য শিরোপা শুধুই সোনার হরিণ।

নাগপুরের মাঠে রোববার রাতে টস ছাড়া আর কিছুই জেতা হলো না মাহমুদউল্লাহ রিয়াদদের। সফরকারীদের ৩০ রানে হারিয়ে সিরিজের ট্রফি থাকল ভারতেরই। প্রথম ম্যাচটা হারলেও পরের দুটো জিতে হাসিমুখেই সিরিজের ট্রফি হাতে তুলে নিলেন রোহিত শর্মা।

নাগপুরের বিদর্ভ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের মাঠে টস জিতে ভারতকেই প্রথমে ব্যাট করতে পাঠান মাহমুদউল্লাহ! কিন্তু স্লো উইকেটে তার সেই সিদ্ধান্তটা বোলাররা যৌক্তিক করতে পারলেন কোথায়? ভারত ২০ ওভারে ৫ উইকেট হারিয়ে তুলে ১৭৪ রান। জবাব দিতে নেমে বাংলাদেশ নড়বড়ে শুরুর পর দাপটের সঙ্গে ম্যাচে ফিরলেও শেষের ভুলে ১৯.২ ওভারে অলআউট হয়ে দল তুলে ১৪৪ রান।

দল তো জয়ের পথেই ছিল। মনে হচ্ছিল তরুণ মোহাম্মদ নাঈম শেখের ব্যাটে লেখা হবে ভারত জয়ের গল্প। কিন্তু শেষের দিকে এসে সর্বনাশ। পরপর দুই বলে উইকেট, এক ইনিংসে তিনবার, বিস্ময়কর! তারপর কী আর বিজয় গাথা লেখা যায়?

যদিও বাংলাদেশ হারলেও হারেননি নাঈম শেখ। এই তরুণ স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে লড়লেন মাথা উঁচু করে। তার ব্যাটে ৮১। অন্যরা ব্যর্থতার পসরা সাজিয়ে ফিরে গেলেন সাজঘরে। তার পথ ধরেই সঙ্গী হলো আক্ষেপ-হতাশা!

বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার কথা কারটা ছেড়ে কারটা বলা যাবে। দুজন ব্যাটসম্যান ছাড়া অন্য কেউ ডাবল ফিগারেই যেতে পারেননি। শেষ আট উইকেট গেছে মাত্র ৩৪ রানে। তারা অলআউট হয় চার বল বাকি থাকতে।

অথচ সিরিজের গল্পটা শুরু হয়েছিল অন্যভাবে। আট সাক্ষাতের পর ভারতের বিপক্ষে প্রথম টি-টুয়েন্টি জয় পায় বাংলাদেশ। দিল্লিতে ৭ উইকেটে জেতার পর সিরিজ জয়ের সুবর্ণ সুযোগ আসে টাইগারদের সামনে। কিন্তু দিল্লি থেকে রাজকোট যেতেই প্রত্যাবর্তনের গল্প। সবটাই অবশ্য ভারতের। রাজকোটে রাজকীয় জয়ের পর নাগপুরে জিতে সিরিজ জিতে নিল রোহিত শর্মার দল।

১৭৫ রানের টার্গেট। নাগপুরের পিচ বিবেচনায় যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। এমন টার্গেটে শুরুটা যেমন হওয়া দরকার, মোটেও তেমনটা হয়নি। তিন ওভার আর স্কোরবোর্ড দুই অঙ্ক (১২) ছুঁতেই দুই উইকেট হাওয়া। ফলে শুরুর চ্যালেঞ্জটা আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং দাঁড়ায় বাংলাদেশের সামনে।

চাহারে চুরমার বাংলাদেশের সিরিজ জয়ের স্বপ্ন 2
নাইম শেখ ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক ফিফটিকে আশির ঘরে নিয়ে বাংলাদেশকে দেখিয়েছিলেন স্বপ্ন। কিন্তু আর কেউ ব্যাট হাতে নিজের নামের সুবিচার করতে পারেননি।

তবে শুরুর ধাক্কাটা আর বড় হতে দেননি নাঈম শেখ। তার দুর্দান্ত ফিফটিতে ট্র্যাকে ফেরে বাংলাদেশ। মাত্র ৩৩ বলে ফিফটি পূরণ করেন ২০ বছর বয়সী এ তরুণ। ধীরে ব্যাট চালালেও তাকে ভালো সঙ্গ দেন মোহাম্মদ মিঠুন। দুজনে মিলে জুটিতে ৬১ বলে তোলেন ৯৮ রান। যার মধ্যে নাঈমেরই ৬৮।

নাঈম-মিঠুনের জুটি লম্বা হওয়ার সঙ্গে ম্যাচও ক্রমেই বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকতে থাকে। চাপ বাড়ে ভারতীয় বোলার-ফিল্ডারদের উপর। ভারতীয়দের শারীরিক ভাষায়ও সেটা স্পষ্ট ছিল। একটা সময় মনেই হয়নি, এই ম্যাচ বাংলাদেশ হারতে পারে, তাও আবার এমন ব্যবধানে!

কিন্তু এরমধ্যেই বড় শট খেলতে গিয়ে আউট হয়ে যান মিঠুন। দীপক চাহারকে উড়িয়ে খেলতে গিয়ে মিডঅফে কেএল রাহুলের হাতে ধরা পড়েন। তার ২৭ রানের চেয়ে মোকাবেলা করা বলের সংখ্যা বেশি (২৯)।

মিঠুন ফিরলেও ম্যাচেই থাকত বাংলাদেশ। কিন্তু বিপদ বাড়ে মুশফিকুর রহিমের আউটে। প্রথম ম্যাচের হিরো, এই ম্যাচে জিরো। সিভম দুবের বলে লেটকাট করতে গিয়ে উইকেটেই বল টেনে আউট হন মুশি।

অন্যরা আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকলেও নাঈম ছিলেন নিজের মতো। একের পর এক চোখ জুড়ানো শটে মাতাতে থাকেন তিনি। যে যুজবেন্দ্র চাহাল আগের দুই ম্যাচে ভুগিয়েছেন, তাকেও টানা তিনটি চার মারেন। কিন্তু মুশফিকের মতো তিনিও ধরাশায়ী ধীরগতির দুবের। সরাসরি বোল্ড হন। যাওয়ার আগে অবশ্য ৪৮ বলে দশ চার দুই ছক্কায় ৮১ রানের ইনিংস খেলে যান।

ছোট-বড় মিলিয়ে চারটি জুটি ভারতকে বড় স্কোর গড়তে সাহায্য করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ এখানেও পিছিয়ে পড়ে। নাঈম-মিঠুনের ওই একটা জুটি ছাড়া আর কোনো জুটি কুরির ঘরও ছাড়াতে পারেননি।

হতাশ করেন উঠতি তারকা আফিফ হোসেনও। সৌম্য-মুশফিকের পর তিনি ফেরেন শূন্য রানে। ১১০-১২৬, এই ১৬ রানের ব্যবধানে মিডঅর্ডারের তিন উইকেট হারিয়ে চরম বিপদে পড়ে বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত ১৪৪ রানেই গুটিয়ে যায় ইনিংস।

এর আগে আট বলে লিটন দাস করে যান ৯ রান। এরপরই বিপদ বাড়ান সৌম্য সরকার। এক বলের বেশি খেলতে পারেননি তিনি।

দীপক চাহারের বলে দুবের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন সৌম্য। এক বলের বেশি না খেলতে পারায় রানের খাতাও খুলতে পারেননি তিনি। ওয়াশিংটন সুন্দরের ক্যাচ বানিয়ে সৌম্যকেও ফেরান চাহার।

চাহারের ৬ উইকেট ছাড়াও দুবে তিনটি ও চাহাল একটি উইকেট নেন।

তিন ম্যাচের সিরিজ ফলাফল ভারত ২, বাংলাদেশ ১। এরপর শুরু হবে দুদলের দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ। যার প্রথমটি শুরু ১৪ নভেম্বর, ইন্দোরে। পরেরটা ২২ নভেম্বর ইডেনে।

সংক্ষিপ্ত স্কোর
ভারত: ২০ ওভারে ১৭৪/৫ ( রোহিত ২, ধাওয়ান ১৯, রাহুল ৫২, শ্রেয়াস ৬২, পান্ত ৬, মনিশ ২২*, দুবে ৯*; আল আমিন ১/২২, শফিউল ২/৩২, মুস্তাফিজ ০/৪২, আমিনুল ০/২৯ ও সৌম্য ২/২৯)।
বাংলাদেশ: ১৯.৫ ওভারে ১৪৪/১০ (লিটন ৯, নাঈম ৮১, সৌম্য ০, মিঠুন ২৭, মুশফিক ০, মাহমুদউল্লাহ ৮, আফিফ ০, আমিনুল ৯, শফিউল ৪, মুস্তাফিজ ১, আল আমিন ০*; চাহার ৬/৭, চাহাল ১/৪৩, দুবে ৩/৩০)।
ফল: ভারত ৩০ রানে জয়ী।
ম্যাচ সেরা: দিপক চাহার।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!