চাল নিয়ে চালবাজি, চট্টগ্রামে বাজারে চালের সংকট—গুদামে পাহাড়, চলছে অভিযান

চালের ভরা মৌসুমেও বড় বড় সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের গুদামে গুদামে অতিরিক্ত চাল মজুদের কারণে চট্টগ্রামে তৈরি হয়েছে চালের কৃত্রিম সংকট। এতে বাজারে বেড়ে গেছে চালের দাম। মুনাফা লোভী এসব অসাধু ব্যবসায়ীরা নিজেদের গুদামে মজুদ করে রেখেছে লাখ লাখ টন চাল। ফলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে চট্টগ্রামের চালের বাজারে।

বোরো চালের এমন ভরা মৌসুমে প্রতিবছর চালের দাম তুলনামূলকভাবে কমলেও এবার হয়েছে তার ব্যতিক্রম। এ বছর বোরো ধানের পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরেও হঠাৎ করে অস্থির হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামের চালের বাজার। চালের এমন অস্থির পরিস্থিতির জন্য মিল মালিকদের দুষছেন আড়তদাররা।

খাতুনগঞ্জের এস কে ট্রেডার্সের সত্ত্বাধিকারী শামসুল হক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মিল মালিকরা আমাদেরকে চাল দিচ্ছে না। আবার দিলেও আগের চেয়ে বাড়িয়ে নিচ্ছে দাম। তাই আমরাও বাজারে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছি। এভাবে চক্রাকারে চট্টগ্রামে চালের সংকট তৈরি হচ্ছে এবং দাম বেড়ে যাচ্ছে।’

চট্টগ্রামের অন্যতম বড় চালের বাজার খ্যাত চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ ও পাহাড়তলী সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, গত তিনদিনের ব্যবধানে ৫০ কেজি চালের বস্তাপ্রতি দাম বেড়েছে ৩৫০ টাকা থেকে ৫৫০ টাকা। পাইকারি বাজারে জিরাশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে বস্তাপ্রতি ৩২৫০ টাকা থেকে ৩৩৫০ টাকা পর্যন্ত, যা দু’সপ্তাহ আগেও বিক্রি হয়েছিল ২৭৫০ টাকা থেকে ২৮৫০ টাকায়। আবার খুচরা বাজারে একই চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৫০০ টাকা থেকে ৩৬০০ টাকা পর্যন্ত।

পাইকারি বাজারে মিনিকেট আতপ চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি বস্তা ৩১৫০ টাকা থেকে ৩৩০০ টাকা দরে, যা সপ্তাহখানেক আগেও বিক্রি হয়েছিল ২৫০০ টাকা থেকে ২৬০০ টাকায়। মোটা আতপ চাল বিক্রি হচ্ছে ২৪৫০ টাকা থেকে ২৬০০ টাকা পর্যন্ত, যা কিছুদিন আগেও বিক্রি হয়েছিল ২০০০ টাকা থেকে ২১৫০ টাকা দরে। এছাড়া একইভাবে মোটা সিদ্ধ চাল বিক্রি হচ্ছে ২১০০ টাকা থেকে ২২০০ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগেও বিক্রি হয়েছিল ১৮৫০ টাকা থেকে ১৯৫০ টাকায়।

চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে চালের বাজারের এই অস্থিরতা নজর কাড়ে সরকারের। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অসাধু মজুদদার-ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনার কথা জানায় বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ। তারই ধারাবাহিকতায় গত তিনদিনে চট্টগ্রামের অন্যতম বৃহত্তম চালের পাইকারি বাজার চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, বন্দর ও পাহাড়তলী এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। অভিযানে বেরিয়ে আসে ‘থলের বিড়াল’।

জেলা খাদ্য অফিস, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে পরিচালিত হয় জেলা প্রশাসনের অভিযান। এতে চট্টগ্রামের চালের বাজারে অস্থিরতা তৈরির অন্যতম ‘খলনায়ক’ হিসেবে ধরা পড়ে মিল মালিকদের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা আড়তদাররা।

আড়তে চাল মজুদ নীতি অমান্য করে অতিরিক্ত পরিমাণে চাল মজুদ করার দায়ে পাহাড়তলী চালের বাজারের ৪ প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন পরিমাণে জরিমানা করা হয় এবং ফুড গ্রেইন লাইসেন্স না থাকায় ‘আমেনা ট্রেডার্স’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এদিকে চালের দাম বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত চাল মজুদের অপরাধে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ এলাকার তিনটি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন পরিমাণে জরিমানা করা হয়। এছাড়া ‘আল্লাহর দান চাউল ভাণ্ডার’ নামে অপর একটি আড়তদার প্রতিষ্ঠানকে জরিমানার পাশাপাশি সিলগালা করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই অভিযানে বন্দর মার্কেট এলাকার তিন আড়তদারকে বিভিন্ন পরিমাণে জরিমানা করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আড়তদার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের অধিকাংশ মিল মালিক ও আড়তদাররা অনেক চাল মজুদ করে রেখেছে। তাদের মতে, সামনে জাতীয় নির্বাচনসহ বেশ কিছু দেশীয় ও ধর্মীয় প্রোগ্রাম রয়েছে, এসবের মধ্যে যদি চালের বাজারে সংকট তৈরি করে অস্থিতিশীল করে তোলা যায় তাহলে বেড়ে যাবে চালের দাম। আর এতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন এই মজুদদাররা। তাই অধিকাংশ ব্যবসায়ী এই অবৈধ মজুদের পন্থা অবলম্বন করছেন। তবে গত তিনদিনের অভিযানে তারা অনেকটা বিচলিত হয়ে পড়েছে। অনেকেই আড়ৎ থেকে দ্রুত সরিয়ে ফেলছে এসব চাল।’

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) উমর ফারুক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘অসাধু মজুদদার ব্যবসায়ীরা চাল মজুদের বিধিনিষেধ না মেনে অতিরিক্ত পরিমাণে চাল মজুদ করে বাজারে চালের সংকট তৈরি করছে। এছাড়া তারা দাম বাড়িয়ে চালের বাজার অস্থিতিশীল করে তোলার পাঁয়তারা করছে। চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, বন্দর ও পাহাড়তলী এলাকায় অভিযানে দেখা গেছে, আড়তদাররা চাল মজুদ করার লাইসেন্সের চেয়ে বেশি পরিমাণে চাল মজুদ করে বেশি দামে বিক্রি করছে। বাজারে চালের দাম স্বাভাবিক রাখতে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রেখেছি।’

এদিকে প্রান্তিক কৃষকরা তাদের ধানের ন্যায্য মূল্য না পেলেও চাল নিয়ে চালবাজি করে কোটি কোটি টাকার মুনাফা করছে অবৈধ মজুদদাররা। তাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থানে জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘বেআইনিভাবে চাল মজুদকারীদের কোনো রকমের ছাড় দেওয়া হবে না। যদি এসব অবৈধ মজুদকারী ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগেরও হয় তাও ছাড় পাবে না। তাদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চলমান থাকবে।’

ব্যবসায়ীদের একটা অংশ বলছে, সরকার চাল আমদানি বন্ধ করে দিবে এমন আশঙ্কা থেকে চাল মজুদে ঝুকেছে প্রান্তিক কৃষক থেকে থেকে শুরু করে মিল মালিক ও আড়তদাররা। কারণ চাল আমদানি বন্ধ করে দিলে চালের বাজারে সংকট দেখা দেবে। তখন অতিরিক্ত মজুদকৃত চালের দাম বাড়িয়ে অধিক পরিমাণে মুনাফা করা যাবে।

অথচ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে চাহিদার তুলনায় ধান উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় গত এক বছর ধরে চাল আমদানি সীমিত করা হয়েছে। দেশে চালের বাজারে বিদেশ থেকে আমদানি করার মতো ঘাটতি নেই। এছাড়া ভবিষ্যতে চালের সংকট যেন দেখা না দেয় সেজন্যে চাল রপ্তানির অনুমতি দিচ্ছে না সরকার। চাল রপ্তানির জন্য অনুমতি চেয়ে শতাধিক ব্যবসায়ী আবেদন করলে তা বাতিল করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!