কাস্টমের কড়াকড়িতে অবৈধ চালান ছাড়াতে অভিনব সব জালিয়াতি

৫ আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টের জালিয়াতি ধরা

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে কড়াকড়ির কারণে আটকেপড়া পণ্য চালান খালাস নিতে ভিন্ন পথে হাঁটছে আমদানিকারক ও সংশ্লিষ্ট সিএন্ডএফ এজেন্টরা। ঘোষণাবর্হিভূত পণ্য চালান খালাসে তদবিরে ব্যর্থ হয়ে আশ্রয় নিচ্ছে নানা জালিয়াতির। এমনকি কাস্টমসের রাসায়নিক পরীক্ষার সনদ জালিয়াতি করেও পণ্য খালাসের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

সম্প্রতি কয়েকটি পণ্য চালানে রাসায়নিক পরীক্ষার সনদ জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ। এসব ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে সংস্থাটি। এই ঘটনার সঙ্গে আরও কোন আমদানিকারক কিংবা সিএন্ডএফ এজেন্ট জড়িত আছে কিনা অনুসন্ধান করছে কাস্টম হাউজ।

জানা গেছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত এক বছরে কাস্টম হাউজের রাসায়নিক পরীক্ষাগার থেকে কী পরিমাণ সনদ দেওয়া হয়েছে সেগুলো পণ্যের সংশ্লিষ্ট গ্রুপের সঙ্গে পুনরায় মিলিয়ে দেখা হবে। এসব জালিয়াতির সঙ্গে যেসব প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ।

কাস্টম হাউজের গত কয়েক মাসের পণ্য চালানের আটকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে তৈরি পোশাক শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত গার্মেন্টসগুলো ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য নিয়ে আসছে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে চেষ্টা তদবির করে এসব পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস নিতে না পেরে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক এবং সিএন্ডএফ এজেন্ট রাসায়নিক পরীক্ষার সনদ পরিবর্তন করে সংশ্লিষ্ট শাখায় সরবরাহ করে চালানগুলো খালাসের পরিবেশ তৈরি করে। এরকম কয়েকটি চালান খালাস নেওয়ার চেষ্টার সময় প্রতারণার বিষয়টি নজরে আসে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।

কাস্টম হাউজ সূত্রে জানা গেছে, ছয়টি পণ্যের রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদনে এমন জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। ওই চালানগুলোতে কম শুল্ক দিয়ে পণ্য চালানের খালাস নিতে চেয়েছিল অভিযুক্তরা। পরীক্ষার প্রতিবেদন কাস্টম কর্মকর্তাদের সন্দেহ হওয়ায় ওই প্রতিবেদন রাসায়নিক পরীক্ষাগারে সংরক্ষিত প্রতিবেদনের সাথে মিলিয়ে দেখার পর জালিয়াতির প্রমাণ মেলে।

কাস্টম হাউজের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কাস্টম রাসায়নিক পরীক্ষাগারের ছয়টি প্রতিবেদন জালিয়াতির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট গ্রুপে জমা দেয় অভিযুক্তরা। এর মধ্যে চলতি বছরের জুন মাসে একটি এবং জুলাই মাসে পাঁচটি প্রতিবেদন জালিয়াতি করে আমদানিকারক এবং সিএন্ডএফ এজেন্টরা। পাঁচটি বিল অফ এন্ট্রিতে এসব জালিয়াতির আশ্রয় নেয় সংশ্লিষ্টরা। বন্দরে আটক এসব কনসাইনমেন্টে (চালান) বন্ড সুবিধায় আনা তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য আমদানিকৃত বিভিন্ন রকমের কাপড় ছিল।

সূত্র জানায়, চলতি বছরের ২৩ জুন রাসায়নিক পরীক্ষার সনদ জালিয়াতির ঘটনাটি ধরা পড়ে। এরপর জুলাই মাসের ১, ২ ও ৮ তারিখে আরও পাঁচটি রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন পরিবর্তনের ঘটনা ধরা পড়ে।

যেভাবে ধরা পড়ে ভুয়া প্রতিবেদন
নিয়ম অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য পৌঁছার পর আমদানিকারকের পক্ষে বিল অব এট্রি দাখিল করে সিএন্ডএফ এজেন্ট। কাস্টমস কর্তৃপক্ষের পণ্য চালান নিয়ে নিয়ে সন্দেহ হলে এআইআর (অডিট ইনভেস্টিগেশন এন্ড রিসার্চ ইউনিট) সেসব চালান লক করে। এরপর কাস্টমস পণ্যের নমুনা করে পরে সেটা পরীক্ষার জন্য রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠায়। সে অনুযায়ী আটককৃত সেসব পণ্যের নমুনা পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। পরে পরীক্ষাগারের কেমিস্ট আব্দুল হান্নান স্বাক্ষরিত প্রতিবেদন প্রদান করা হয়।

পরীক্ষাগারের কেমিস্ট যে প্রতিবেদন দেন, সেটি সংশ্লিষ্ট আমদানি শাখায় না দিয়ে স্বাক্ষর সিল জাল করে সিএন্ডএফ এজেন্ট তাদের পক্ষে ভুয়া প্রতিবেদন দাখিল করে। কাস্টমসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ওই প্রতিবেদন নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় পুনরায় রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হলে ধরা পড়ে জালিয়াতির বিষয়টি। সেখানে দেখা যায় কেমিস্টের স্বাক্ষর সিল জালিয়াতি করে ভুয়া প্রতিবেদন জমা দেয় সংশ্লিষ্ট সিএন্ডএফ এজেন্ট।

জালিয়াতিতে জড়িত যেসব আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্ট
রাসায়নিক পরীক্ষাগারের সনদ জালিয়াতির সাথে জড়িত আমদানিকারক এএমএইচ অ্যাপারেলস লিমিটেড ও নাছরিন জামান কিন্টওয়্যারস লিমিটেড। তাদের পক্ষে সিএন্ডএফ এজেন্ট হিসেবে কাজ করে এসএ চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি, এইচএ ইন্টারন্যাশনাল ও তানিয়া কার্গো সার্ভিস।

যা বললেন পরীক্ষাগারের পরীক্ষক
কাস্টমস রাসায়নিক পরীক্ষাগারের পরীক্ষক আবদুল হান্নান বলেন, ‘আমার স্বাক্ষর এবং সিল জালিয়াতি করে অভিযুক্তরা পণ্য খালাসের চেষ্টা করে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট গ্রুপের কর্মকর্তাদের নজরে আসে। প্রতিবেদন সিএন্ডএফ এজেন্টদের দেওয়া হলেও এর কপি পরীক্ষাগারের কম্পিউটারে রক্ষিত থাকে। এ ধরনের প্রতারণা প্রতিরোধে অনলাইনে সংশ্লিষ্ট শাখায় প্রতিবেদন দেওয়া হচ্ছে। ফলে পরবর্তীতে এ ধরনের জালিয়াতির সুযোগ থাকছে না।’

তদন্ত করা হচ্ছে এক বছরের সনদ
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, ‘জালিয়াতির মাধ্যমে রাসায়নিক পরীক্ষার সনদ পরিবর্তন করার ঘটনায় আর কোন প্রতিষ্ঠান জড়িত আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখতে গত এক বছরে যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে সেগুলো সংশ্লিষ্ট শাখার মাধ্যমে নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনায় যেসব প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকবে তাদের বিরুদ্ধে কাস্টম আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এসসি/এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!