চান্দগাঁও-বহদ্দারহাটের ‘গ্যাং’ দিন দিন বেপরোয়া, স্বভাবে নিষ্ঠুর নৃশংস

ছিনতাই থেকে চাঁদাবাজি, মাদকব্যবসা থেকে দেহব্যবসা সবই চলে

সন্ধ্যা নামতেই রাস্তায় নেমে পড়ে একদল কিশোর অপরাধী। বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে যায় তারা। কখনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে, কখনো ফ্লাইওভারের ওপর, কখনও আবার মোটরসাইকেল নিয়ে চষে বেড়ায় এলাকা এলাকা। সুযোগ বুঝে মোবাইল কিংবা নগদ টাকা ছিনিয়ে নেয়। জনমনে ভীতি জিইয়ে রাখতে খুন করতেও পিছপা হয় না তারা। তুচ্ছ বিষয়ে চালায় গুলি-চাপাতি।

যে বয়সে যাওয়ার কথা স্কুল কলেজে, সেই বয়সে অস্ত্র হাতে খুনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে একদল কিশোর। এমনকি ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধেও লিপ্ত হচ্ছে। চান্দগাঁও এলাকায় এভাবে গড়ে উঠেছে দুর্ধর্ষ সব কিশোর গ্যাং। অস্ত্র-মাদক কিংবা টাকার লোভে কিশোরদের বিপথগামী করছে কথিত বড় ভাইরা। বড় ভাইদের কেউ সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে চলে, আবার কেউ পেশাদার সন্ত্রাসী।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ দিয়েই তারা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ছিনতাই থেকে চাঁদাবাজি, জমি দখল থেকে বাইক চুরি, মাদক ব্যবসা থেকে জুয়ার আসর, এমনকি দেহব্যবসার সঙ্গেও জড়িত এসব গ্রুপ-উপগ্রুপ। এদের অপরাধের বিস্তৃতি— চান্দগাঁও থেকে বহদ্দারহাট, খাজা রোড এলাকা, পূর্ব ষোলশহর, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, অনন্যা আবাসিক থেকে বলির হাট পর্যন্ত।

চান্দগাঁও-বহদ্দারহাট এলাকার অপরাধজগতের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যে কয়েকজন, তাদের শীর্ষে রয়েছেন রাজু বাদশা ওরফে হামকা রাজু। চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও কসাই পাড়ার জয়নাল আবেদীন জুনুর ছেলে তিনি। তবে তিনি একা নন, অপরাধজগতে তার প্রধান সহযোগী ছোট ভাই মো. জুয়েল ওরফে ধামা জুয়েলও।

গেল সপ্তাহেই দেখা গেল, চাঁদার পরিমাণ বাড়াতে বহদ্দারবাড়ি মসজিদের সামনে একটি ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে তাণ্ডব চালালো সন্ত্রাসী হামকা রাজু ও তার বাহিনী।
গেল সপ্তাহেই দেখা গেল, চাঁদার পরিমাণ বাড়াতে বহদ্দারবাড়ি মসজিদের সামনে একটি ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে তাণ্ডব চালালো সন্ত্রাসী হামকা রাজু ও তার বাহিনী।

বহদ্দারহাট, খাজা রোড ও পূর্ব ষোলশহর এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই মূর্তিমান ত্রাস দুই সহোদর— হামকা রাজু ও ধামা জুয়েল। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জমি দখল, বাইক চুরি, মাদক বিক্রি, জুয়ার আসর, পতিতাবৃত্তিসহ এমন কোনো অপরাধ নেই— যেখানে এই গ্রুপ জড়িত নয়। অন্তত অর্ধশত কিশোর অপরাধী নিয়ে গড়ে উঠেছে ভয়ংকর হামকা রাজু গ্রুপ। বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যে যার দায়িত্ব পালন করছে। আর মাস শেষে প্রশাসনের অসৎ কর্তাব্যক্তিদের কাছেও পৌঁছে দেওয়া হয় মাসোহারা।

গেল সপ্তাহেই দেখা গেল, চাঁদার পরিমাণ বাড়াতে বহদ্দারবাড়ি মসজিদের সামনে একটি ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে তাণ্ডব চালালেন হামকা রাজু। করা হয় গাড়ি ভাংচুরও। আর এতে আহত হয়েছেন কয়েকজন চালক। পিস্তল ঠেকিয়ে তাদের গুলি করে হত্যার হুমকিও দেন রাজু ও তার বাহিনী। থানায় অভিযোগ করেও সুরাহা মেলেনি কোনো। উল্টো রাজুর হামলার শিকার হয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এখনও পর্যন্ত রাজু ও তার সহযোগীরা গ্রেফতার না হওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

চান্দগাঁও এলাকায় দিন দিন রীতিমতো নৃশংস হয়ে উঠছে হামকা রাজুসহ দাগি সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রিত বেশ কয়েকটি কিশোর গ্রুপ। কিশোর অপরাধীদের দিয়ে বহদ্দারহাট, ফরিদারপাড়া মাজার গলি, খাজা রোড ও বাস টার্মিনাল এলাকায় মাদক ব্যবসার একাধিক স্পট নিয়ন্ত্রণ করছেন এই হামকা রাজু। দেখভাল করেন রনি সরকার নামে তার এক সহযোগী। সম্প্রতি আইয়ুব নামে এই চক্রের এক মাদক বিক্রেতা ডিবি পুলিশের হাতে ইয়াবাসহ আটক হন। অন্যদিকে জমি দখল, নির্মাণাধীন ভবন, সড়ক ও ফুটপাতের চাঁদাবাজিতে সরাসরি রাজুসহ নেতৃত্ব দেন তার ভাই জুয়েলও।

কয়েক বছর আগে দুই যুবকের বাইক ভাঙচুর করে ছুরি দিয়ে মুখে কোপানোর ঘটনা আলোড়ন তুলেছিল। এমনকি চোখ পর্যন্ত উপড়ে নিয়েছিল রাজুর সহযোগীরা। রাজু এতই ভয়ংকর— রীতিমতো প্রশাসনকেই চ্যালেঞ্জ দিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কোমরে অস্ত্র নিয়ে মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে চষে বেড়ায়। সম্প্রতি মা মেয়ে জোড়া খুনের চাঞ্চল্যকর ঘটনায় অস্ত্রসহ আটক প্রধান আসামি মো. ফারুক এই হামকা রাজুর আপন চাচাতো ভাই।

গত বছর মধ্যরাতে মাদক সেবনে বাধা দেওয়ায় বহদ্দারহাট হক মার্কেটের সিকিউরিটি গার্ড আব্দুস সবুরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছিল রাজুর সেকেন্ড-ইন কমান্ড ইমন বড়ুয়াসহ চার সন্ত্রাসী। সেই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছিল সে সময়। ইমন গ্রেফতারের পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এরপর আরও দুই দফায় ইমন বড়ুয়া অস্ত্রসহ গ্রেফতার হন। সর্বশেষ গত ১৫ জুন বহদ্দারহাট এলাকা থেকে আরও দুই পেশাদার ছিনতাইকারীসহ গ্রেপ্তার হন ইমন বড়ুয়া। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।

জানা গেছে, রাজুর এই সহযোগী সন্ত্রাসী ইমন বড়ুয়ার বাবা রণজিত বড়ুয়া বহদ্দারহাট পুলিশ বক্সের ইনচার্জ এসআই রূপক কান্তি চৌধুরীর সোর্স হিসেবে কাজ করেন। সেই সুবাদে দুর্ধর্ষ এই গ্রুপ পুলিশের নানা সহায়তাও পায়— এমন অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের।

‘নাটের গুরু’ হামকা রাজু নিজেই একসময় পেশাদার ছিনতাইকারী ছিলেন। ২০১২ সালে ছিনতাই করতে গিয়ে বহদ্দারহাট ডায়মন্ড ক্লাবের সামনে ধরা পড়েন। পরে গণধোলাই দিয়ে তাকে পুলিশে সোপর্দ করে পথচারীরা। পাঁচলাইশ থানায় দ্রুত বিচার আইনে মামলা নং-২৮(৭)১২ এ মামলায় দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন রাজু। এছাড়া তার বিরুদ্ধে পাঁচলাইশ থানায় চাঁদাবাজি আইনে মামলা নং- ১৭(২)১৮, চাঁদাবাজি ও হত্যা চেষ্টার ঘটনায় চান্দগাঁও থানায় মামলা নং- ১০(১২)১৪, ৩৩(৪)১৭ সহ অসংখ্য মামলা দায়ের হয় বিভিন্ন সময়।

রাজুর ভাই জুয়েলের বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের ঘটনায় চান্দগাঁও থানার দ্রুত বিচার আইনে মামলা নং- ২৪(১২)১৫ এবং ৬(১)১৭ আছে। গত সপ্তাহে চাঁদার দাবিতে গুলি করে হত্যার হুমকি দেওয়ায় দুই ভাইয়ের নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা চান্দগাঁও থানায় জিডি নং-২৫(১০)২০ দায়ের করেন।

চান্দগাঁও এলাকায় আরেক মূর্তিমান আতঙ্ক— এসরাল বাহিনী। চান্দগাঁও থানার হাদু মাঝিপাড়া এলাকায় চাঁদা না দেওয়ায় আমজাদ হোসেন নামে এক মুরগি ব্যবসায়ী যুবকের পা ড্রিল মেশিন দিয়ে ফুটো করে দিয়ে এই বাহিনীর সন্ত্রাসীরা গত বছরের এপ্রিলে দেশজুড়ে আলোচনায় এসেছিল। ওই ঘটনায় এসরাল বাহিনীর সদস্য জালাল উদ্দিন (২৭), দিদার উদ্দিন প্রকাশ লম্বা দিদার (২৮), রাশেদ (২০), মিল্লাত (৩২), নিশান (৩৪), ইমন (২৫), বাপ্পী (২০) ও সুজন ওরফে কালা সুজনকে (৩০) চান্দগাঁও থানায় একটি হত্যা প্রচেষ্টা মামলাও (নম্বর ৫/১৩১) হয়েছিল।

চান্দগাঁও থানা এলাকায় গত এক বছরে তিনটি হত্যাকাণ্ড চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর চান্দগাঁও দর্জিপাড়ায় চাঁদা না পেয়ে জিয়াদ নামে এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এরপর প্রধান অভিযুক্ত রাসেল পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। ফরিদের পাড়ায় দিনেদুপুরে হত্যা করা হয় নুরুল ইসলাম নামের এক যুবককে।

নৃশংস এসব ঘটনায় জড়িতরা ছিল কিশোর অপরাধীরা। তাদের ‘বড় ভাই’ হিসেবে পরিচিত যুবলীগ নামধারী এসরারুর হক এসরাল। গত বছর নগর পুলিশের তৈরি করা কিশোর গ্যাং গডফাদারের ৪৮ জনের তালিকায় নাম আছে এসরালের। এছাড়া বিভিন্ন সংস্থার সন্ত্রাসী তালিকায়ও নাম আছে তার। গত বছর দেশব্যাপী শুদ্ধি অভিযান শুরু হলে এসরাল আত্মগোপনে চলে যান। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পালিয়ে যান তিনি। অভিযান কিছুটা নিষ্ক্রিয় হওয়ায় আবার ফিরেও আসেন এলাকায়।

অভিযোগ আছে, বহদ্দারহাট চান্দগাঁও এলাকায় রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে দীর্ঘদিন একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করে আসছেন এসরাল। চাঁদাবাজি, জায়গা দখলসহ সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত বছরের পর বছর। তার আছে একাধিক কিশোর গ্যাং। মূলত তাদের দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করছেন অপরাধ সাম্রাজ্য। অস্ত্রসহ খুলশী থেকে র‍্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়া একটি মামলায় ১৭ বছর সাজা হয় এসরালের। পরে হাইকোর্টের জামিনে বেরিয়ে যান। এর আগেও দুইবার অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়েছিলেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী এই এসরারুল হক ওরফে এসরাল বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয় ও চাঁদাবাজি করে তোলা বিপুল অংকের অর্থের ভাগ পুলিশকে দিয়ে দোর্দণ্ড প্রতাপে চলাফেরা করছেন এলাকায়।

তার নিয়ন্ত্রিত কিশোর গ্যাংগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছে বহদ্দারহাটে ফ্রুট সোহেল, পুরাতন চান্দগাঁওয়ে শুভ নাথ, আজাদ, খাজা রোডে রিপন, অদুর পাড়ায় রাশেদ, দিদার, বিসিক শিল্প এলাকায় জাহেদ ওরফে উজ্জ্বলসহ ২০-৩০ জন।

এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়াও স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বহদ্দারহাটসহ চান্দগাঁও-পাঁচলাইশ এলাকায় ছিনতাইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শাহাদাত হোসেন ওরফে লেংড়া রিফাত, মফিজুর রহমান, আরমান হোসেন, ইমন বড়ুয়া, হৃদয় বড়ুয়া, কামরুল, হামিদ সিকদার, বিধান ধর ও ওয়াসিফ। মোটরসাইকেল নিয়ে ভাসমান ছিনতাইয়েও জড়িত এরা। বারাইপাড়ার প্রবেশমুখেই নগরের সবচেয়ে বড় জুয়ার আসর পরিচালনা করছেন রুবেল ও ইয়াবা দিদার।

চান্দগাঁও এলাকায় আরেক আতঙ্ক— ইকবাল হোসেন জিকু। তার বিরুদ্ধে চান্দগাঁও ও ফটিকছড়ি থানায় রয়েছে চারটি মামলা। মন্দিরে মেয়ে ধর্ষণের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা হয় তিন বছর আগে। হিজড়া দিয়ে ইয়াবাসহ মাদক বিক্রির অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। তার আপন ভাই ইমরান হোসেন জনিকে দিয়ে একটি কিশোর গ্যাংও নিয়ন্ত্রণ করেন এই জিকু। জানা গেছে, চার-পাঁচদিন আগে র‍্যাব তাকে ধরতে আসলে হিজড়াদের দিয়ে তিনি কৌশলী প্রতিরোধ গড়ে তুলে পালিয়ে যান।

বেপরোয়া সন্ত্রাস ও কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত প্রসঙ্গে চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান খন্দকার বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে যেসব ছোট ভাই-বড় ভাই আছে সবার বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!