চাঁদাবাজি পথে পথে, ৮ টাকার সবজি চট্টগ্রামে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই ৮০ টাকা

৭০ টাকাই চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্ত্বভোগী ও চাঁদার পেছনে

ঘামেভেজা শ্রমে যে কৃষকের জমিতে ফুলকপির চাষ হয়, সেই কৃষক প্রতি পিস ফুলকপির দাম পান মাত্র ৮ থেকে ১০ টাকা। ১০ টাকার সেই ফুলকপি বাজারে আসতে আসতে কেজিপ্রতি দাম ওঠে যায় ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। ফুলকপি গড়ে ১ কেজি থেকে দেড় কেজি ওজনের হয়ে থাকে। এ হিসাবে ১০ টাকার ফুলকপি কিনতে ক্রেতার পকেট থেকে বেরিয়ে যায় ৭০ থেকে ১০০ টাকা। কেবল হাতবদল করেই মাঝখানের এই ৬০ থেকে ৯০ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা। এর বড় অংশই চলে যাচ্ছে চাঁদাবাজিতে। বগুড়া থেকে চট্টগ্রামে আসার পথে পথে দিতে হয় এই চাঁদা।

ফুলকপি কেবল এক উদাহরণ, সব সবজিই ক্ষেত থেকে উঠে আসার পর জায়গায় জায়গায় হাতবদল হতে হতে ক্রেতার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে দাম বেড়ে যাচ্ছে ১০ থেকে ২০ গুণ। দামের এই পাগলাঘোড়ার কবলে পড়ে নিম্নবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তের পকেটও খালি হয়ে যায় নিমেষেই।

ঘাটে ঘাটে বাড়ে দাম

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রামের বাজারে আসা কাঁচা সবজির বড় একটি অংশ আসে বগুড়া, নরসিংদী, পাবনা, যশোর, মেহেরপুর, রাজশাহীসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে। অন্যদিকে কাঁচা সবজির উল্লেখযোগ্য একটি অংশ চট্টগ্রাম নগরীতে আসে কক্সবাজারের চকরিয়া, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, দোহাজারী, সাতকানিয়া, বাঁশখালী, রাঙ্গুনিয়া ও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বগুড়ার মহাস্থান হাট ও সোনাতলা বাজার থেকে শীতকালীন সবজি থেকে শুরু করে সারা বছর নানা সবজি আসে চট্টগ্রামে। ওই এলাকার কৃষকরা প্রতি কেজি বেগুনের দাম পান ৫ থেকে ৭ টাকা। সেই বেগুন মাত্র এক হাত বদলে উপজেলা বাজারে আসামাত্র দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১০ থেকে ১৩ টাকা। উপজেলা বাজার থেকে ট্রাকে করে চট্টগ্রামে আনা হয় বেগুন। চট্টগ্রামের বড় পাইকারি বাজার রিয়াজউদ্দিন বাজারে ওই বেগুন আসার পর দাম বেড়ে দাঁড়ায় ২০ থেকে ২৫ টাকায়। এরপর খুচরা বিক্রেতার হাতে যাওয়ার আগে সেই বেগুনের দাম হয়ে যায় দ্বিগুণেরও বেশি। খুচরা বিক্রেতারা রিয়াজউদ্দিন বাজার থেকে বেগুন সংগ্রহ করে বিক্রি করেন ৫০ থেকে ৬০ টাকায়।

বগুড়ায় ফুলকপি বিক্রি হয় প্রতি পিস ৮ থেকে ১০ টাকায়। সেই ফুলকপি চট্টগ্রামে ভোক্তাদের হাতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে কেজিতে দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ থেকে ৮০ টাকা। বগুড়ায় যে বাঁধাকপি বিক্রি হয় প্রতি পিস ৪ থেকে ৬ টাকা, সেই একই বাঁধাকপি চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারে আসার পর কেজি বিক্রি হয় ১০ থেকে ১৫ টাকায়। কিন্তু কয়েক হাত ঘুরে চট্টগ্রামের খুচরা ক্রেতাদের সেই বাঁধাকপি কিনতে হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। এভাবে সব সবজিরই অস্বাভাবিক দামের পেছনে আছে কেবলই হাতবদল আর মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের লম্বা হাত।

‘কৃষি বিপণন আইন ২০২১’ অনুসারে কৃষি পণ্যের বিভিন্ন শ্রেণীতে খুচরা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ মুনাফা করার আইন রয়েছে। আইন থাকলেও বাস্তবে বাজারে ঘটছে তার উল্টোটা।

অস্বাভাবিক লাভ খুচরা বিক্রেতাদের

উৎপাদনস্থল থেকে বাজারে আসতে আসতে কেন এভাবে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায় দাম— এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারের কাঁচা সবজির আড়তদার মেসার্স নিউ একতা বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী আবু তৈয়ব চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গাড়ি ভাড়া বেশি। বগুড়া থেকে এক ট্রাক সবজি আনতে পরিবহন খরচ যায় ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা। প্রতি বস্তা সবজি আনতে খরচ পড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। আনুষঙ্গিক খরচ মিটিয়ে যে লাভ আড়তদাররা করে, তা কোনোভাবেই অযৌক্তিক নয়।’

আড়তদাররা বরং খুচরা বিক্রেতাদের ওপর দোষ চাপিয়ে বলছেন, রিয়াজউদ্দিন বাজার থেকে ২০ টাকায় বেগুন কিনে খুচরা বিক্রেতারা মানুষের কাছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করছে। খুচরা বিক্রেতারাই অস্বাভাবিক লাভ করছে। খুচরা বিক্রেতাদের তেমন পরিবহন খরচ যায় না। তবুও তারা অতিরিক্ত মুনাফা করছে।

তবে চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজারের খুচরা বিক্রেতা সজিব হোসেন আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, ‘দোকান ভাড়া বেশি। সবজি কিনে আনার পর অনেক সবজি পচে যায়। যার কারণে দাম একটু বেশি।’

পথে পথে চাঁদাবাজি, সঙ্গে বাড়তে থাকে দামও

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বগুড়া বা উত্তরবঙ্গ থেকে চট্টগ্রামে আসতে প্রায় ৪৫০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। পথের মধ্যে ট্রাফিক পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ ও বিভিন্ন জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। যার প্রভাব পড়ছে সবজির দামে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাইওয়ে পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ ছাড়াও পথে পথে বিভিন্ন থানার পুলিশকেও চাঁদা দিতে হয় পণ্যবাহী প্রতিটি ট্রাককে। এর বাইরে আছে ওজন স্টেশনের চাঁদা, বাজার কমিটির চাঁদা, পরিবহন সংগঠন ও শ্রমিক ইউনিয়নের চাঁদা। সবমিলিয়ে ট্রাকপ্রতি এই চাঁদাই দিতে হয় গড়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে হাইওয়ে, ট্রাফিক ও থানা পুলিশকে চাঁদা দিতে হয় গড়ে ১০ হাজার টাকা। মহাসড়কের পরিমাণ যন্ত্রের ওজন স্টেশনে দিতে হয় গড়ে দুই থেকে তিন হাজার টাকা। প্রতি ট্রিপে গাড়ির দালালদেরকে দিতে হয় দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। বাকি চাঁদা বিভিন্ন সংগঠন ও ইউনিয়নকে দিতে হয়। বগুড়ার মহাস্থান হাট থেকে চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার পর্যন্ত ৪৩৯ কিলোমিটার দূরত্ব পার হতে বিশাল অংকের এই চাঁদা দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

চট্টগ্রামের সদরঘাটের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ট্রাক মালিক বলেন, ‘উত্তরবঙ্গ থেকে চট্টগ্রামে আসতে প্রায় ২৫ হাজার টাকা শুধু চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। কাঁচামাল পচে যাওয়ার ভয়ে না দিয়েও উপায় নেই। এছাড়া প্রতি ট্রিপে গাড়ির দালালদেরকে দিতে হয় দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। দালাল ছাড়া ভাড়াও পাওয়া যায় না।’

সড়কপথে বিভিন্ন সংগঠন, পুলিশ ও ব্যক্তির নামে পরিবহন থেকে চাঁদাবাজি বন্ধের দাবিতে গত ২৬ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করে পরিবহন চালক ও মালিকপক্ষ। ওই বৈঠকে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নামে প্রতি ট্রিপে ৩০ টাকা করে মোট ৬০ টাকা আদায় করা যাবে— এমন সিদ্ধান্ত হয়। প্রতিটি জেলায় নির্দিষ্ট স্থানে এ চাঁদা আদায় করবেন দুই সংগঠনের প্রতিনিধিরা। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেও পরিবহনে পথে পথে চাঁদাবাজি হয়ে আসছে।

বাংলাদেশ ট্রাক চালক শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওয়াজি উল্লাহ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চাঁদাবাজি বন্ধে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আমাদের বৈঠক হয়েছে। সবার সম্মতিক্রমে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নামে প্রতি ট্রিপে ৩০ টাকা করে মোট ৬০ টাকা আদায় করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সেটা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। যত দ্রুত সম্ভব এটি বাস্তবায়ন হোক। সেটি বাস্তবায়ন হলে চাঁদাবাজি অনেকটা কমে যাবে।’

ট্রাকচালক আজিম বলেন, ‘পথে টাকা না দিলে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। নিরুপায় হয়ে টাকা দিতে হয়।’

শীতের দিনেও সবজির বাজার গরম

এদিকে বাজারে শীতকালীন সবজির সরবরাহ বাড়লেও দাম আশানুরূপ কমেনি। নগরে অগ্রহায়ণের শীত নামলেও শীতল হয়নি সবজির বাজার। বাজারে ৫০ টাকার নিচে সবজি বলতে গেলে নেই-ই।

চট্টগ্রামে সবজির পাইকারি বাজার রিয়াজউদ্দিন বাজার, কাজীর দেউড়ি, বহদ্দারহাট, চকবাজার, মুরাদপুর ও আগ্রাবাদসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, কাঁচা সবজির দাম পাইকারি বাজারের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। রিয়াজউদ্দিন বাজারে কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে আসা বেগুন বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ টাকা। সেই বেগুন সাধারণ মানুষকে কিনতে হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। একই বাজারে পাইকারিতে যে বাঁধাকপি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৮ থেকে ১০ টাকা, খুচরা বাজারে সেটাই বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়।

রিয়াজউদ্দিন বাজার থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার দূরত্বের আন্দরকিল্লা এলাকায়ও বেশি দামে সবজি বিক্রি হতে দেখা যায়। এ যেন একচেটিয়া মুনাফা হাতিয়ে নেওয়ার মহোৎসব।

সবচেয়ে বেশি ঠকে কৃষকরা

জানা গেছে, উত্তরবঙ্গ ছাড়াও চট্টগ্রাম নগরীতে কাঁচা সবজি আসে কক্সবাজারের চকরিয়া, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, দোহাজারী, সাতকানিয়া, বাঁশখালী, রাঙ্গুনিয়া ও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে।

চকরিয়ার বিভিন্ন বাজার থেকে প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১৫ ট্রাক সবজি আসে চট্টগ্রাম নগরীতে। চকরিয়ার গৌবিন্দপুর এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, প্রতি বছর শীতকালীন সবজি চাষ করেন তিনি। এ বছর মানভেদে এক মণ বেগুনের দাম পেয়েছেন ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। খুচরা বাজারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সেই বেগুনের মণপ্রতি দাম ঠেকছে ১৩০০ থেকে ১৬০০ টাকায়।

কম দাম পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে দোহাজারীর শঙ্খচরের চাষী মোতালেব মিয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা ক্ষেত থেকে বাজারে এক ভার (দুই বাঁশের ঝুড়ি) মুলা বিক্রি করি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দামে। এক ভার মুলার ওজন গড়ে ৪০ থেকে ৬০ কেজি হয়।’

মোতালেব মিয়া গড়ে প্রতি কেজি মূলার দাম পান ১১ টাকা। অনেক সময় এর চেয়ে কম দামেও বিক্রি করতে হয় তাকে। যথাযথ বাজার তদারকির অভাবে এমনটা হচ্ছে বলে অভিযোগ সাধারণ ভোক্তাদের।

হুঁশিয়ারি কেবলই কথার কথা

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। আমাদের লোকবল কম। সবসময় বাজার তদারকি করা সম্ভব নয়। বাজারে শীতকালীন সবজির সরবরাহ বাড়লে দাম আরও কমবে। কেউ অতিরিক্ত মুনাফা করছে— এমন তথ্য পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

ক্ষেত থেকে উঠে আসার পর বাজারে আসতে আসতে যে সবজি ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি দামে কেনেন যেসব ক্রেতা, তাদের প্রায় সবারই একই মত— ভোক্তা অধিকারের হুঁশিয়ারি কেবলই কথার কথা। বাস্তবে কোনো তৎপরতাই দেখা যায় না।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!