চসিক/ ঠিকাদারের ‘আবদার’ না শোনায় কর্মচারীকে ‘শাস্তি’ দিলেন সিইও

ঠিকাদারের আবদার না শোনায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) এক কর্মচারীকে তাৎক্ষণিক বদলি করে ‘শাস্তি’ দিলেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সামসুদ্দোহা। এ ঘটনায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পাশাপাশি একজন ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও চসিকের স্বার্থবিরোধী কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এমনকি প্রধান প্রকৌশলী স্বাক্ষরিত স্মারকের অংশ বাতিল করা হলেও তার কোনো মতামত নেওয়া হয়নি।

জানা গেছে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ‘পারফরম্যান্স গ্যারান্টি’ দিতে না পারায় প্রায় এক কোটি টাকার ‘টেন্ডার সিকিউরিটি’ বাজেয়াপ্ত করার জন্য ব্যাংককে চিঠি দেয় চসিক। গত মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) সেই চিঠি বহন করে নিয়ে যান প্রকৌশল বিভাগের পিয়ন আবদুর ছবুর জসিম। ইউসিবিএল ব্যাংকের ম্যানেজার টুংকু হুমায়ুন চিঠি পেয়ে বিষয়টি মুঠোফোনে অবগত করেন ঠিকাদার মঞ্জুরুল চৌধুরীকে। চিঠিটি ফেরত নিতে ম্যানেজারের মুঠোফোনের মাধ্যমে ঠিকাদারের সাথে কথা না বলায় বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) পিয়ন জসিমকে তাৎক্ষণিক বদলি করা হয়।

জানা যায়, ঠিকাদার মঞ্জুরুল চৌধুরী তার মুঠোফোন থেকে ওই কর্মচারীকে ব্যাংকে বসিয়ে রাখার অনুরোধ করেন। পরে ঠিকাদারসহ নিরাপত্তা কর্মকর্তা গিয়ে ওই কর্মচারীকে কর্পোরেশনে এনে অপদস্থ করা হয়। এমনই অভিযোগ উঠেছে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দোহার বিরুদ্ধে।

গত বৃহস্পতিবার সিটি কর্পোরেশনে এক অফিস আদেশে বলা হয়, স্মারক নং/প্রঃপ্র/১৬/২৩৪ মূলে জারিকৃত অফিস আদেশের ১৪ ক্রমিকে মো. আবদুর ছবুর জসিম-এর প্রযোজ্য অংশটুকু এতদ্বারা বাতিলপূর্বক তাকে ৭নং ডিভিশনে শ্রমিক হিসেবে পূর্ণ পদে ন্যস্ত করা হল। চসিকের সচিব আবু শাহেদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত আদেশটিতে কর্পোরেশনের প্রশাসনিক স্বার্থে এই আদেশ জারি করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়।

যদিও ২০১৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রধান প্রকৌশলীর স্বাক্ষরিত স্মারকের একটি অংশ বাতিল করা হয়েছে এই আদেশে। যদিও এই বিষয়ে প্রধান প্রকৌশলীর কাছ থেকে কোনো মতামত নেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে। তবে অফিস আদেশের একটি অনুলিপি তাকে ‘মার্ক’ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ।

এ প্রসঙ্গে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দোহা বলেন, ‘ওই ঠিকাদার মঞ্জু আমার রুমে ছিলেন। তখনই ব্যাংকের ম্যানেজার হুমায়ুন ওনার মুঠোফোনে কল দেন। ফোনে বলা হয়, সিটি কর্পোরেশন থেকে একজন লোক চিঠি নিয়ে ব্যাংকে গিয়েছেন। আমাকে বিষয়টি শেয়ার করেন ঠিকাদার মঞ্জু। তখন আমি ওনার ফোন থেকে ব্যাংকের ম্যানেজারের সাথে কথা বলি এবং সিটি কর্পোরেশন থেকে যাওয়া স্টাফের সাথে কথা বলতে চাই। উত্তরে জানানো হয়, ওই লোক আমার সাথে কথা বলতে অপারগতা জানান। তাই আমি সন্দেহ পোষণ করি যে, ওটা আদৌ আমাদের স্টাফ কি না? তাই আমি ব্যাংক ম্যানেজারকে বলি, ওনাকে বসিয়ে রাখার জন্য। পরে সিটি কর্পোরেশন থেকে নিরাপত্তা কর্মকর্তা গিয়ে শনাক্ত করে নিয়ে আসে।’ তবে ওই ঘটনার তাকে বদলির করার কোনো সম্পর্ক নেই দাবি করেন এ কর্মকর্তা।

এমন বদলি নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে গেলে ১৫ দিন পর এই বদলি আদেশ প্রত্যাহার করা হবে বলে সিটি কর্পোরেশন শ্রমিক কর্মচারী লীগকে আশ্বাস দিয়েছেন এই কর্মকর্তা। সিবিএর সভাপতি ফরিদ আহমদ বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে প্রতিবাদ জানাতে যাই। তখন তিনি তার সাথে ফোনে কথা না বলার বিষয়টি বলেন। আমরা জসিমের পক্ষ থেকে ওনার কাছে দুঃখ প্রকাশ করি। পিয়ন জসিম একজন বাহক এবং তিনি দায়িত্ব পালনকালে অন্যের সাথে কথা বলতে পারেন না। তবে ঠিকাদারের ফোনে যে প্রধান নির্বাহী ছিলেন, সেটা জসিম অবগত না হওয়ায় ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। তবে প্রধান নির্বাহী আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন, ১৫ দিন পর তাকে আবার প্রকৌশল বিভাগের পিয়ন হিসেবে ফিরিয়ে আনা হবে এবং বর্তমান বদলি আদেশ বাতিল করা হবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলেন ইউসিবিএল ব্যাংকের কদমতলী শাখার ম্যানেজার টুংকু হুমায়ুন বলেন, ‘আমার কাছে একজন ভদ্রলোক সিটি কর্পোরেশন থেকে চিঠি নিয়ে এসেছিলেন। তখন আমি মিটিংয়ে ছিলাম। পরে ওনার সাথে দেখা করে চিঠিটি রিসিভ করি।’ ওইদিন আর কোনো ঘটনা ঘটেছিল কিনা—এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান তিনি।

তবে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার দিন ঠিকাদারকে জানানোর পর চিঠিটি গ্রহণ করেননি ওই ব্যাংক ম্যানেজার। পরে আরেকজন পিয়ন দিয়ে পুনরায় পাঠানো হলে সেটি গ্রহণ করেন।

প্রকৌশল বিভাগের পিয়ন আবদুর ছবুর জসিম বলেন, ‘আমাকে প্রধান প্রকৌশলী একটি চিঠি নিয়ে ইউসিবিএল ব্যাংকের কদমতলী শাখায় পাঠান। আমি যথারীতি চিঠিটি নিয়ে ব্যাংকে যাই। ম্যানেজারকে চিঠিটি দিয়ে সম্মানের সাথে রিসিভ কপি চাই। তখন তিনি চিঠিটি খুলে দেখে আমাকে বসতে বলেন এবং মুঠোফোনে কথা বলার জন্য রুম থেকে বের হন। গ্লাস দিয়ে ওনি কার সাথে যেন কথা বলছিলেন।’

আবদুর ছবুর জসিম বলেন, ‘কথা শেষ করে ওনার সাথে আরেকজন ব্যাংক কর্মকর্তা আমার দিকে মোবাইল ফোন এগিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ঠিকাদারের সাথে কথা বলুন।’ তখন আমি কথা বলতে অপারগতা জানাই। কেননা আমি গিয়েছি চিঠির বাহক হিসেবে। চিঠির ভেতরে কী আছে সেটা দেখা বা ঠিকাদারের সাথে কথা বলার কোনো এখতিয়ার আমার নেই। ওই কর্মকর্তা ফোনটি কেটে দিয়ে আলাদা করে কথা বলেন। একটু পর ম্যানেজার এসে আমাকে বলেন, আপনি বসে থাকেন। সিটি কর্পোরেশন থেকে লোক আসছে আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। উনি আর চিঠি রিসিভ করেননি।’

পিয়ন জসিম আরো বলেন, ‘প্রায় দেড়ঘণ্টা আমাকে বসিয়ে রাখার পর আসলেন আমাদের নিরাপত্তা কর্মকর্তা কামাল স্যার। ওনার সাথে ছিলেন ঠিকাদার মঞ্জু। ওনারা আমাকে নিয়ে কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আসেন। সেখানে এসে আমি জানতে পারি ফোনে প্রধান নির্বাহী স্যার কথা বলতে চেয়েছিলেন। তবে আমাকে জানানো হয়নি এবং যখন মোবাইলটি আমার দিকে এগিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তখন মোবাইলের স্ক্রিনে মঞ্জু নাম দিয়ে সেভ করা নাম দেখি। তারপরও আমি আমার ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছি। কিন্তু আমাকে গতকাল হঠাৎ বদলি করা হয়েছে।’

তবে এই কর্মচারী প্রতিবেদকের কাছে বক্তব্য উপস্থাপন করায় নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার কথা জানান।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নিরাপত্তা কর্মকর্তা মো. কামাল উদ্দীন বলেন, ‘ওইদিন আমাকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইউসিবিএল ব্যাংকের কদমতলী শাখায় যেতে বলেন। কেননা ওখানে একজন সিটি কর্পোরেশনের স্টাফ রয়েছে। যার সাথে উনি মুঠোফোনে কথা বলতে চাইলে ওই স্টাফ অপারগতা জানান। তাই সেখানে গিয়ে ওই স্টাফকে সিটি কর্পোরেশনে নিয়ে আসার জন্য আমাকে পাঠানো হয়।’

তিনি বলেন, “ব্যাংক চিনিয়ে দেওয়ার জন্য আমার সাথে ঠিকাদার মঞ্জুকে সাথে পাঠান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ওনাকে সাথে গিয়ে আমি ব্যাংকে যাই। সেখানে দেখি আমাদের স্টাফ বসে রয়েছেন। পরে তাকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষে নিয়ে আসি। সেখানে আসার পর জসিম জানান, ‘ফোনে প্রধান নির্বাহী ছিলেন সেটা জানতাম না, আমাকে ব্যাংক কর্মকর্তা বলেছেন ঠিকাদারের সাথে কথা বলতে। তাই আমি না করেছি, কেননা আমি ঠিকাদারের সাথে কথা বলার এখতিয়ার রাখি না।’ পরে জসিম প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে ভুলের জন্য ক্ষমা চান।”

এডি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!