জবরদস্তি/ চসিকের স্কুলে পরীক্ষার চাপে দিশেহারা শিক্ষার্থীরা

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাও উপেক্ষিত

‘সামনে জেএসসি পরীক্ষা। সকালে স্কুল, ক্লাস পরীক্ষা, কোচিংয়ের পাশাপাশি সেখানে পরীক্ষা, গৃহশিক্ষকের কাছে পাঠগ্রহণের পাশাপাশি সেখানেও আবার পরীক্ষা। মনে হচ্ছে আমার জীবনটাই পরীক্ষায় পরীক্ষায় যাবে।’

সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাজিবা সুলতানা। লেখাপড়ায় খুব মনোযোগী। ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিতি, অংশগ্রহণ—সব চোখে পড়ার মতন। শিক্ষকদেরও স্নেহভাজন। কিন্তু সে অনুপাতে ভালো ফলাফল করতে পারে না নাজিবা। নাজিবার মা জানান, পরীক্ষাভীতির কারণে ভালো ফলাফল করতে পারে না। পুরো সিলেবাস শেষ করেও পরীক্ষার হলে গিয়ে ঠিকমতো লিখতে পারে না। পরীক্ষায় বসলেই তার মধ্যে অদ্ভূত ভীতি কাজ করে। প্রশ্নপত্র হাতে পেলেই হাত-পা ভয়ে ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

নাজিবার সব উত্তরই জানা, কিন্তু লিখতে পারে না। লিখতে লিখতে তার ভাবনা কাজ করে সময় চলে যাচ্ছে এতে ভয় আরো বেড়ে যায়। এর ফলে নাজিবার এমনও হয়েছে হঠাৎ শরীর খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণে পুরো পরীক্ষা শেষ না করেই কেন্দ্র থেকে বের হয়ে যায়। এমন ঘটনা যে শুধু নাজিবা সুলতানার, তা নয়। নাজিবার মতো এমন অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে যাদের মেধা থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষাভীতির কারণে ভালো ফলাফল না হওয়ায় পিছিয়ে পড়েছে সকলের চেয়ে।

গত কয়েক বছরে স্কুলের শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষা বেড়েছে দুটি। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত ছিল শুধু এসএসসি ও এসএইচসি পরীক্ষা। নতুন মাত্রায় যোগ হলো পঞ্চম শ্রেণি (পিএসসি) ও অষ্টম শ্রেণি (জেএসসি)। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের চারটি পাবলিক পরীক্ষার মোকাবেলা করতে হয়। বিদ্যালয়ভিত্তিক ক্লাসেও এখন বেড়েছে পরীক্ষার সংখ্যা। শুধু তাই নয়, একদশকে বইয়ের ভারও বেড়েছে অনেক বেশি। তারপর বাড়তি যোগ সৃজনশীল পরীক্ষার ব্যবস্থা। এতো এতো পরীক্ষার ভীড়ে রীতিমতো অসহনীয় চাপের মুখে পড়েছে শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীদের বাড়তি চাপ আর পরীক্ষাভীতি কমাতে মাউশির (মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর) নীতিমালা অনুযায়ী বছরে দুটি পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। প্রথম পরীক্ষা জুনের শেষের দিকে এবং শেষ (বার্ষিক) পরীক্ষা নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে, অথবা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। পাশাপাশি ৩০ নাম্বারের বিদ্যালয়ভিত্তিক মূল্যায়নও (এসবিএ) চালু রয়েছে। কিস্তু এসব নিয়ম উপেক্ষা করে শ্রেণি অভীক্ষার নামে ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নিচ্ছে চসিক নিয়ন্ত্রিত স্কুলগুলো। সাধারণত শ্রেণি অভীক্ষা ১০-২৫ নম্বরের হয়ে থাকে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির নির্বাচনী বা বার্ষিক পরীক্ষার আগে ১০০ নম্বরের দুটি শ্রেণি অভীক্ষা চালু হয়। অর্ধবার্ষিকীর চাপ সামাল দিয়ে না উঠতেই আবারও প্রতি বিষয়ে ১০০ নাম্বার করে বার্ষিক পরীক্ষার আগে ২০০ নম্বরের পরীক্ষার চাপের মুখে চসিক নিয়ন্ত্রিত স্কুলের শিক্ষার্থীরা।

নোটিশে দেখা যায়, চসিক পরিচালিত মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলতি শিক্ষাবর্ষে পড়ালেখার গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে চসিকের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সুমন বড়ুয়া স্বাক্ষরিত ২৭ জুনের এক নোটিশে শ্রেণি অভীক্ষার ব্যাপারে জানানো হয়। গত ১২ মে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য রক্ষা স্ট্যান্ডিং কমিটির সভা এবং ২০ মে সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে নোটিশটি দেওয়া হয় বলে তাতে জানানো হয়।

অপর্ণাচরণ সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সামনে জেএসসি পরীক্ষা। সকালে স্কুল, ক্লাস পরীক্ষা, কোচিংয়ের পাশাপাশি সেখানে পরীক্ষা, গৃহশিক্ষকের কাছে পাঠগ্রহণের পাশাপাশি সেখানেও আবার পরীক্ষা। মনে হচ্ছে আমার জীবনটাই পরীক্ষায় পরীক্ষায় যাবে। ঘুমানোর সময় পাই না পরীক্ষার পড়া রেডির ভয়ে। খারাপ করলে তো রক্ষা নেই। ভালো লাগে না আর পড়াশোনা করতে। পরীক্ষাটা না নিলে কী এমন ক্ষতি হয়!’

আরেক শিক্ষার্থী আসমাউল হুসনা বলেন,‘ পরীক্ষার কথা শুনলেই আমার গায়ে জর আসে। এই দেখেন হাত কাঁপছে। পরীক্ষার হলে আমার হাত চলে না। ঘেমে ভিজে যায়। সব কমন প্রশ্নের উত্তর পারলেও ফুল আনসার (উত্তর) করতে পারি না।’

অভিভাবক নেছার উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সব ছেলেমেয়ের পড়াশোনার ধরন একরকম নয়। আইকিউর দিক থেকে মাঝারি বা খাটো পড়ুয়ারা কোনো কিছু জানার ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহী হয় না। পড়ার বই তো বটেই, গল্পের বই পড়ার ক্ষেত্রেও তাদের অনীহা থাকে। তাদের মধ্যে অনেকে নিচু ক্লাসে ভালো রেজাল্ট করলেও যতই ওপরের ক্লাসে উঠতে থাকে, ততই তাদের রেজাল্ট খারাপ হতে থাকে। আমরা চাই আমাদের সন্তান ভালো রেজাল্ট করুক কিন্তু তার ক্যাপাসিটি (সক্ষমতা) কতটুকুন তা দেখি না। এটা খুবই অমানবিক কিন্তু কী আর করা!’

আরেক অভিভাবক বলেন, ‘সারা দিন বই খুলে বসে থাকলেও পরীক্ষার সময় কিছুতেই সুবিধা করতে পারে না। স্বাভাবিক বুদ্ধির ছাত্রছাত্রীর একদল সারা বছরই কমবেশি খাটে, ফলে তারা পরীক্ষার সময় বাড়তি কোনো টেনশনে ভোগে না। অন্য দল সারা বছর ফাঁকি দিলেও পরীক্ষার কিছুদিন আগে থেকে দিন-রাত এক করে পড়াশোনা করে। যেহেতু অল্প কিছুদিনের মধ্যে অনেকটা পড়া তৈরি করতে হয়, ফলে তাদের অনেকেই পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারবে কি না তা নিয়ে আশঙ্কায় থাকে। বুদ্ধির দিক থেকে যারা উঁচু ধাপে থাকে, পড়ার পেছনে অনেক কম সময় দিয়েও তারা ভালো রেজাল্ট করার ক্ষমতা রাখে।’

ওই অভিভাবক বলেন, ‘মজার কথা, পড়াশোনার নিজস্ব ধরন-ধারণটা ছেলেমেয়েরা সাধারণত পাল্টাতে চায় না। পরীক্ষায় টেনশনের মুহূর্তে যারা প্রতিজ্ঞা করে, পরের বছর থেকে তারা নিয়মিত পড়াশোনা করবে। কিন্তু পরীক্ষা শেষ হতেই তা তারা বেমালুম ভুলে যায়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কে থাকি। চাপ কমার পরিবর্তে বেড়েই চলেছে।’

দুই পরীক্ষার মাঝে বাড়তি ১০০ নাম্বারের দুটো পরীক্ষা প্রসঙ্গে জামালখান কুসুম কুমারী সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা চম্পা মজুমদার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা আসলে সিটি করপোরেশনের নির্দেশনা মেনেই চলি। উনারা যেমন নির্দেশ দিয়েছে তেমনই হবে। এটা নতুন সিলেবাস তো না। বার্ষিক পরীক্ষার সিলেবাসের ভেতরেই আছে। তাছাড়া আমাদের মেয়েরা তো তেমন কিছুই বলছে না। যদি বলে তাহলে কর্তৃপক্ষকে জানাবো।’

এ প্রসঙ্গে অভিভাবক বা শিক্ষার্থীদের সাথে মতবিনিময়ের কথা জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘না আমরা তাদের থেকে মতামত জানতে চাইনি।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের শিক্ষা কর্মকর্তা সুমন বড়ুয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এবারে বাচ্চাদের ফলাফল বিপর্যয় ঘটেছে তাই পড়ালেখার গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া। বার্ষিক পরীক্ষার সিলেবাসকে তিনভাগ করেই এ পরীক্ষাটা নেওয়া হবে। এখানে তো পাস ফেলের কিছুই নেই। বাচ্চাদের চাপ কমানোর জন্যই এমন করা যাতে তারা পড়াশোনায় মনোযোগী হয়। তাদের কষ্ট বা চাপ দেওয়ার জন্য আমরা পরীক্ষা নিচ্ছি না। পড়ালেখামুখী করার জন্যই এ অভীক্ষা নেয়া। যদি তারা চাপ মনে করে বা আমাদেরকে জানায় তাহলে পরীক্ষা নেবো না। ওদের ভালোর জন্যই আসলে এ ব্যবস্থা। এমনও না যে আমরা পরীক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করছি। যা প্রয়োজন কেবল সেটুকুই নিচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটা আসলে শিক্ষকদের অভিযোগ বাচ্চাদের না। ১০০ নম্বর হলে তো ফাঁকিবাজি করতে পারবে না। খাতা কাটতে হবে। তাই বাচ্চাদের বাহানা দিচ্ছে।’

বাড়তি পরীক্ষা নেওয়া ব্যাপারে জানতে চাইলে সাহিত্যিক শিক্ষাবিদ সাবেক অধ্যক্ষ ড. আনোয়ারা আলম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পরীক্ষা নিচ্ছে তা খারাপ না। কিন্তু নম্বর ডিস্ট্রিবিউশনটা ১০০ হলে তো বাচ্চাদের অনেক চাপ পড়বে। তারা পড়বেই বা কখন যদি পরীক্ষামুখী হয়? এটা যুক্তিসংগত হচ্ছে না। এভাবে যদি পরীক্ষার চাপ থাকে তাহলে মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। এটা খুবই দুঃখজনক। সব এক্সপেরিমেন্ট (পরীক্ষা) আমরা বাচ্চাদের দিয়েই করছি। শিক্ষাব্যবস্থা যদি পরীক্ষামুখীই হয়ে যায় এটা ওদের জন্য বড় ধরনের চাপ হবে। শিক্ষার আসল আনন্দটুকুই থেমে যাবে। আনন্দের মধ্যে ভীতিকর পরিবেশ চলে এলে বাচ্চাদের শৈশব কৈশোর বিষিয়ে উঠবে।’

অন্যদিকে, এ প্রসঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তরের (মাউশি) আঞ্চলিক পরিচালক প্রফেসর প্রদীপ চক্রবর্তী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় তো সব দিক বিবেচনা করেই শিক্ষার্থীদের চাপ কমানোর জন্য তিনটের পরিবর্তে দুটো পরীক্ষা নিচ্ছে। এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন তো আলাদা না। শ্রেণি অভীক্ষা ১০-২০ নাম্বারের হওয়ার কথা। নিতে চাইলে ২০ নাম্বারের পরীক্ষা নিতে পারে। ১০০ নাম্বার গ্রহণযোগ্য না। ১০০ নাম্বারের নিতে গেলে তো ৪৫ মিনিটের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের ৩ ঘন্টা বসিয়ে রাখতে হবে। তাহলে পড়বে কখন? এসবিএর (বিদ্যালয়ভিত্তিক মূল্যায়ন) কাজ তো আছেই ৩০ নাম্বারের। এটা অবশ্যই বাড়তি চাপ।’

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর চসিকের শিক্ষা বিভাগ থেকে একটি অফিস আদেশ জারি করা হয়। এ অফিস আদেশ পত্রাকারে চসিক পরিচালিত সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠানো হয়েছিল। তাতে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের ওপর পড়ালেখার চাপ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বছরে তিনটি পরীক্ষার পরিবর্তে দুটি পরীক্ষা নেয়ার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। অথচ এ সময়েও সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইচ্ছাকৃতভাবে শিক্ষার্থীদের দুটো পরীক্ষার পাশাপাশি ১০০ নাম্বারের আরও দুটো শ্রেণি অভীক্ষা পরীক্ষা নিচ্ছে। যা কোনোভাবে কাম্য নয়। এছাড়াও এ পত্রে সরকারি নীতিমালা বহির্ভূত মডেল টেস্ট পরীক্ষা নেওয়া থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ প্রদান করা হয়।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!