চলে গেলেন শহীদ জায়া মুশতারী শফী

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক, সাহিত্যিক, নারীনেত্রী, উদীচী চট্টগ্রামের সভাপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফী মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।

সোমবার (২০ ডিসেম্বর) বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

বেগম মুশতারী শফী ছিলেন বাংলা একাডেমি ফেলো এবং বেগম রোকেয়া পদকপ্রাপ্ত। চট্টগ্রামে নারী অধিকার আদায় ও ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রসৈনিক ও সংগঠক।

মরহুমার মেয়ে রুমানা শফী বলেন- ‘সোমবার বিকেল সোয়া ৫টায় মারা যান আম্মা। তাকে চট্টগ্রামে দাফন করা হবে। তবে কয়টায় জানাজা এবং দাফন করা হবে, সেটি এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। পারিবারিকভাবে আলোচনা করে চূড়ান্ত করা হবে।’

কিডনি, রক্তে ইনফেকশনসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন জটিলতায় তাকে প্রথমে চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে গত ২ ডিসেম্বর ঢাকায় সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন।

৮৩ বছর বয়সী বেগম মুশতারী শফী দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছিলেন। এ ছাড়া বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগও ছিল। মৃত্যুকালে তিনি দুই ছেলে ও চার মেয়েসহ অসংখ্য স্বজন রেখে গেছেন।

একাত্তরের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, নারীনেত্রী ও সাহিত্যিক শহীদজায়া মুশতারী শফীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও নাগরিক আন্দোলনে মুশতারী শফির অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী মরহুমার আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

শহীদ জায়া মুশতারী শফীর মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনেও।

মুশতারী শফী ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস ফরিদপুর জেলায়। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর স্বামী মোহাম্মদ শফী এবং ছোট ভাই এহসানকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁর পরিবার একাত্তরে চট্টগ্রামে স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধের পুরোসময় তিনি ওই বেতারকেন্দ্রের শব্দসৈনিক হিসেবে কাজ করেন।

ষাটের দশক থেকে তিনি নারী আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন। নব্বইয়ের দশকে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন জোরদার হলে তিনি নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠনে ভূমিকা পালনের পাশাপাশি তিনি এতে নেতৃত্বও দেন। শহীদজননী জাহানারা ইমামের প্রয়াণের পর দেশজুড়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনের মূল নেতৃত্বেও ছিলেন তিনি।

বেগম মুশতারী শফী দীর্ঘসময় ধরে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও নাগরিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। একযুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি উদীচী চট্টগ্রামের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার বেগম মুশতারী শফী দেশে প্রগতিশীল চেতনার বাতিঘর হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন।

তিনি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কয়েকটি অসাধারণ গ্রন্থ লিখেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী, চিঠি, জাহানারা ইমামকে ও স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন। এছাড়াও তিনি প্রবন্ধ, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি, কিশোর গল্পগ্রন্থ, স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থও লিখেছেন।

১৯৬০-এর দশকে তিনি চট্টগ্রামে ‘বান্ধবী সংঘ’ নামে নারীদের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংগঠন থেকে তিনি ‘বান্ধবী’ নামে একটি নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশ করেন ও ‘মেয়েদের প্রেস’ নামে একটি ছাপাখানা চালু করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য ভূমিকা পালনের জন্য বাংলা একাডেমি ২০১৬ সালে তাঁকে ‘ফেলোশিপ’ প্রদান করে। তিনি গত বছর ২০২০ সালে পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘রোকেয়া পদক’।

আরএম/কেএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!