চমেক হাসপাতাল—ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ‘দুঃখ-গাঁথা’ জীবন কাটে অনিশ্চয়তায়

সারাদিন হাঁড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে হোস্টেলের ছোট্ট একটি কামরায় ক্যান্টিনের ডাল-ভাত। ঘুমের মধ্যে হাসপাতাল থেকে ফোন। আবার শরীরের ক্লান্তি শরীরে মাখিয়ে ওয়ার্ডে যাত্রা। কিন্তু যে ইন্টার্ন চিকিৎসক হাসপাতালের প্রাণ তাদেরই জীবন কাটে অনিশ্চয়তায়—অভাবে আর রাজনৈতিক ঝামেলায়।

তাদের অভিযোগ, ইন্টার্ন চিকিৎসকরা প্রায়শই হামলার শিকার হন। প্রতিপক্ষ তাদের বিনা উস্কানিতে বিবাদে জড়িয়ে হামলা করে। এভাবেই নিজেদের জীবন ও পেশা নিয়ে হতাশার কথা ব্যক্ত করেছেন একাধিক ইন্টার্ন চিকিৎসক। জীবনের পাশাপাশি জীবিকা নিয়েও তারা হতাশ। জানা গেছে, এক বছরে ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা ছুটি পান ১৫ দিন। মাসে ভাতা ১৫ হাজার টাকা।

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ডা. ওয়াসিম সাজ্জাত রানার উপর অতর্কিত হামলার জের ধরে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারীদের মধ্যে দুই দফায় এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কয়েকজন আহত হয়েছে। গতকালের ঘটনায় ২৮ মার্চ (বুধবার) হাসপাতালে কর্মবিরতি পালন করছে তারা। দুপুরে পরিচালকের সাথে করা মিটিং তারা বয়কট করে কর্মবিরতি অব্যাহত রেখেছেন।

জানা যায়, সদ্য এমবিবিএস পাস করা এসব চিকিৎসক হাসপাতালে যুক্ত থাকেন মূলত প্রশিক্ষণ নিতে। বাস্তবে তাঁরা পালাক্রমে ২৪ ঘণ্টাই রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছেন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নিবন্ধন পাওয়ার ক্ষেত্রে ইন্টার্নশিপ একটি পূর্বশর্ত। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার ইন্টার্ন চিকিৎসক সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেলে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. রাজিব পালিত বলেন. ইন্টার্নদের কাজের চাপ বেশি। কিন্তু তারা সহায়তা কম পান। কিন্তু তারা কাজও বেশি করেন। আবার বিভিন্ন চাপের মোকাবেলাও করতে হয় তাদের। কারণ রোগিদের অভিযোগ থাকে তাদের ঘিরেই। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঢুকলেই দেখা যায়, কম বয়সী ডাক্তারের দল স্টেথিস্কোপ গলায় নিয়ে এক বেড থেকে আরেক বেডে ঘুরছেন। রোগীর স্বজনরা ডাকলে যাচ্ছেন রোগীর কাছে।

সহকারী রেজিস্টারের রুমে তারা গোল হয়ে বসে থাকেন। পাশে থাকেন সহকারী রেজিস্টার। তার নির্দেশনায় রোগীর ওষুধ ও পরবর্তী সেবা নিয়ে আলোচনা করেন। থাকে হাজারও ঝামেলা। রোগীর স্বজনরা না বুঝে রুমের সামনে ভিড় করেন। হট্টগোল বাঁধান। সব সামলিয়ে এই ইন্টার্ন চিকিৎসকরাই হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ডাক্তারদের পরম সহায়ক হয়ে কাজ করে থাকেন।

হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের সহকারী রেজিস্টার ডা. তামান্না জানান, আমাদের মূল সহায়ক শক্তি ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। বাইরে থেকে অনেক রোগী ও তার স্বজনরা তাদের সেবা নিয়ে অভিযোগ করেন। কিন্তু তারা কখনোই ভেবে দেখেন না একটা ওয়ার্ডের দুই থেকে আড়াইশ রোগী মোটে ৩ থেকে ৪ জন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা সামাল দেন। সব ধকল পোহাতে হয় ইন্টার্ন চিকিৎসকদের।

তিনি আরো বলেন, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ডিউটি শুরু হয় প্রতিদিন সকাল আটটায়। তখন থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের (অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট, রেজিস্ট্রার) সঙ্গে ইন্টার্নরা কাজ করেন। মাঝরাতে নয়টায় ডিউটি পালাবদল হয়। এছাড়া সরকারি ছুটির দিনেও তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। কিন্তু তাদের উপর কথায় কথায় বহিরাগতদের হামলা মেনে নেয়া যায় না। তবে কর্মবিরতিতে না গিয়ে সঠিক আলোচনার মাধ্যমে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কাজে ফেরার তাগিদ দেন এই চিকিৎসক।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকদের অনেকেই না্ম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, আমাদের সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা নিয়ে কলেজ ও হাসপাতাল প্রশাসন কোন কথা বলে না। আমরা প্রায় দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই হাসপাতালে পড়ে থাকি। কোভিড সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও সমানভাবে কাজ করে যাচ্ছি। তার ওপর গতকাল হামলা হলো। আবার হাসপাতাল প্রশাসন হামলাকারীদের সাথে আমাদের মিটিংয়ে বসতে বলে। যা আমরা মেনে নেয়নি।

জানা যায়, এমবিবিএস কোর্সের পাঠ্যসূচিতে বলা আছে, এমবিবিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা এক বছরের জন্য হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে প্রশিক্ষণ নেবেন। এর মধ্যে ১১ মাস তাঁরা হাসপাতালে কাজ করবেন। ১৫ দিন কাজ করবেন একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এক বছরে তাঁরা ছুটি পান ১৫ দিন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. শাহেনা আক্তার বলেন, এত এত দায়িত্ব যখন ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ওপর বর্তানো আছে, সেখানে তারা কথায় কথায় হাসপাতালে কর্মবিরতির ঘোষণা চিকিৎসকদের নীতিতে পড়ে না। হাসপাতালে হাজার হাজার রোগী বেকায়দায় পড়েছে তাদের ধর্মঘটে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসক রয়েছেন ২৭০ থেকে ২৮০ জন। আমরা তাদের সহযোগিতা করি না এটা ঠিক না।

তাদের কাজের পরিধি ব্যাখা করতে গিয়ে চমেক ইন্টার্ন চিকিৎসক আসোসিয়শেনের আহ্ব্বায়ক মো: ওসমান গণি বলেন, রোগী দেখা ছোড়াও পরের দিন অধ্যাপকের জন্য নোট তৈরী করে রাখতে হয়। কোনো কাজে না বলার সুযোগ নেই। অন্যদিকে ছুটিও কম।

তিনি বলেন, মাস শেষে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের মাত্র ১৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু দূর্মূল্যের বাজারে এটা কিছু না। একজন গ্রাজুয়েট চিকিৎসক কোনভাবেই এত কম টাকায় পরিবার ও তার নিজের খরচ বহন করতে পারে না। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা তাদের নিজেদের জীবন নিয়ে নিরাপত্তা।

ওসমান গণি আরো বলেন, আমরা এমবিবিএস পাস করে ইন্টার্নশিপ করছি। আমাদের ওপর বহিরাগত ছেলেরা এসে হামলা করবে, অহেতুক ভাষায় গালি–গালাজ করবে এটা তো মেনে নেয়া যায় না। আমাদের ইন্টার্ন চিকিৎসক আসোসিয়েশনের কোন দলগত ভাগ নেই। আমরা বারবার বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হই। রাজনৈতিক নেতা, আমলারা তাদের আত্মীয় স্বজনের চিকিৎসায় অহেতুক ভূল খুঁজে ওয়ার্ডে আমাদের ওপর চড়াও হয়। ক্ষমতার দাপট দেখায়। প্রশাসন আমাদের ব্যাপারে আন্তরিক না।

তিনি আরো বলেন, ‘কিছুদিন আগে চকবাজারে আমি বহিরাগতদের হামলায় আহত হয়েছিলাম। গতকাল আবারও হলাম। সারাদিন পরিশ্রম করে এসব কি অন্যায় আচরণ আমাদের সাথে? জীবন ও পেশার নিরাপত্তা না দিলে কাজে না ফেরার কথা জানান এই আহ্বায়ক।

জানা যায়, মঙ্গলবারের হামলার ঘটনায় ২৮ এপ্রিল (বুধবার) কলেজ ও হাসপাতাল প্রশাসন ইন্টার্ন চিকিসকদের নিয়ে মিটিংয়ে বসেছিলেন। কিন্তু তারা এ মিটিং বয়কট করেছেন বলে জানান ইন্টার্ন চিকিৎসক নেতৃবৃন্দরা। কলেজ ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের হামলায় দুই ইন্টার্ন চিকিৎসক ডা. হাবিব, ডা. ওসমান আহত হন। কিন্তু আজকের মিটিংয়ে হাসপাতাল পরিচালক কালকের হামলাকারী বহিরাগত ছাত্রদেরও মিটিংয়ে আসতে বলেন কনফারেন্স রুমে। বহিরাগতদের সাথে মিটিংয়ে তারা বসতে রাজি না বলে জানান আহবাবায়ক ওসমান গনি। তারা মিটিং বয়কট করে হাসপাতালে কর্মবিরতি অব্যাহত রেখেছেন বলে জানিয়েছেন।

কেএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!