চট্টগ্রাম মেডিকেলে ওয়ার্ডবয় করছে নার্সের কাজ, দিচ্ছে চিকিৎসাও (ভিডিওসহ)

‘ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে এসে ইনজেকশেন দেওয়ার জন্য নার্সদের ডাকলাম। কিন্তু তারা কথা কানেই নিল না। পরে একজন ওয়ার্ডবয় এসে ইনজেকশন দিয়ে গেল। ইনজেকশন দিলে নাকি ১০০ টাকা দিতে হয়। অনেক বুঝিয়ে ৫০ টাকা দিলাম। যদি নার্স ইনজেকশন দিতো তাহলে তো ৫০ টাকা দিতে হতো না। এভাবে কত টাকা যে খরচ হয়ে যাচ্ছে, হয়রানির কথা নাই বা বললাম’— বললেন ৫০ বছর বয়সী হাসিনা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ছেলেকে নিয়ে এসেছেন সুদূর রাঙামাটি থেকে। প্রতিবেদককে তিনি জানাচ্ছিলেন চমেকে আসার পর নানা হয়রানি ও অনৈতিক অর্থ দিতে বাধ্য হওয়ার করুণ কাহিনী।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে কর্মচারীদের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ বাড়ছে দিনের পর দিন। ডাক্তার ও নার্সদের অনেক কাজই তারা করে বিনিময়ে টাকা নেয়। বাধ্যতামূলক বকশিশ নেওয়া ছাড়াও তাদের বেপরোয়া আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে রোগীরা।

রাহাত নামের এক তরুণ তার মাকে নিয়ে পাঁচদিন ধরে হাসপাতালে আছেন। তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘একজন ওয়ার্ডবয় দেখছি ডাক্তার আর নার্সের কাজ করছে। আর তার বিনিময়ে টাকা নিচ্ছে। আমি তো দেখে অবাক! কেমনে কী? তারা কিভাবে এসব করছে জানি না। তাদের নিয়ন্ত্রণ করার মত তো কাউকে দেখি না। সাপে কাটা রোগীকেও তারা চিকিৎসা করে ইনজেকশন দিয়ে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিচ্ছে। তার বিনিময়ে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে। আমি দেখছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম।

তিনি বলেন, ‘চিকিৎসা ব্যবস্থাটা কি এতই সহজ হয়ে গেছে? তাহলে দুই একদিন এসব দেখে আমিও কি একজন চিকিৎসক হয়ে যাবো?’

রাহাত আরও বলেন, ‘আমিও প্রথমে প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু নিরুপায় হয়ে করিনি। কারণ আমি প্রতিবাদ করলেও কিছু হবে না। উল্টো আরও ফাঁসিয়ে দেবে।’

অভিযোগে জানা গেছে, হাসপাতালে আউটসোর্সিং হিসেবে ওয়ার্ড বয়ের কাজ যারা করে, তাদের প্রায় সকলেই ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে রোগীদের চিকিৎসার বিভিন্ন কাজ করেন। বিশেষ করে মেডিসিন ওয়ার্ডের যে তিনটি ইউনিট আছে সেই ইউনিটে এমনটিই যেন নিয়ম। এই ওয়ার্ডবয়গুলো রোগীদের ইনজেকশন পুশ করে, রাইস টিউব করে দেন, বিষধর সাপে কাটলে তার চিকিৎসাও করেন, বিষ খাওয়া রোগীদের এমনকি ওয়াশও করে দেন। এই সকল কাজের বিনিময়ে তারা টাকা নেন। এমনকি রোগী একটু সুস্থ হলে ডাক্তারের ছাড়পত্র নেওয়ার আগেই তারা ছাড়পত্র করিয়ে দেন। এর বিনিময়েও তারা টাকা নেন।

অনুসন্ধানে ওয়ার্ড বয় থেকে রীতিমতো ‘চিকিৎসক’ হয়ে ওঠা এরকম বেশ কয়েকজনের নাম জানা গেছে। বিশেষ করে ১৬ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ডের ৩ নম্বর ইউনিটের রুবেল, সবুজ, আবদুল, খোকন, শরীফ, রাসেল, আনোয়ার ও শাহীনের নাম সবার মুখে মুখে। এছাড়া অন্যান্য ওয়ার্ডেও আরও অনেকে আছেন। এরা সকলেই আউটসোর্সিং হিসেবে কর্মরত। এদের সকলেই বেতনভুক্ত বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের এক কর্মচারী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওয়ার্ড বয়রা অনিয়ম করেই এসব কাজ করছে। এরা রাইসটিউব করতে গেলে রোগীর স্বজনদের থেকে নেয় ১৫০ টাকা, ক্যাথেটার করলে নেয় ১৫০ টাকা, বিষধর সাপ কামড় দিলে ২ হাজার টাকা, সাধারণ কোনো সাপে কামড় দিলে ১ হাজার টাকা, ইনজেকশন দিতে নেয় ৫০ থেকে ১০০ টাকা। ছাড়পত্র দিতে নেয় ২০০ টাকা।’

তিনি আরও বলেন, ‘এগুলো তো একজন ওয়ার্ড বয়ের কাজ না। একজন ওয়ার্ডবয়ের কাজ হলো রোগী আসলে তাকে ওয়ার্ডে আনা-নেওয়া করা। কিন্তু যে কাজ গুলো ডাক্তার বা নার্সের করা উচিত সে কাজগুলো ওয়ার্ড বয়রা করছে।’

ডাক্তার আর নার্সদের চোখে এসব পড়ে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চোখে পড়ে, আবার পড়েও না। কারণ কেউ যদি তাদের কাজ নিজ থেকেই করে দেয় তারা তো আরও খুশি হন। কিন্তু ওয়ার্ড বয়গুলো যে এসব কাজ করছে এর হিতে বিপরীত হলে এর দায় কে নেবে? এরা তো কোনো ডাক্তার বা নার্স নয় যে এসব তারা করবে। ওয়ার্ড বয়দের মধ্যে কিছু আছে আউটসোর্সিং, আর কিছু আছে স্পেশাল। তাদের কাজ হলো রোগীদের জরুরি বিভাগ থেকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া, ঝাড়ু দেওয়া, টয়লেট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, রোগীদের বেড ঠিক করে দেওয়া, লিফটে করে রোগী ওপরে তোলা বা নিচে নামানো ইত্যাদি। কিন্তু তারা এর একটা কাজও করে না। অন্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মেডিকেলের চারপাশ অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন। টয়লেটের গন্ধ হাসপাতালের চারপাশে ছড়াচ্ছে।’

অভিযুক্তদের মধ্যে রুবেল নামের সেই ওয়ার্ডবয়কে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি অস্বীকার করে বলেন, ‘এরকম কোনো কাজই আমরা করি না। আমাদের দায়িত্বে যে কাজ গুলো আছে আমরা সেগুলোই করি। এগুলো আমাদের কাজ না।

হাসপাতালের উপপরিচালক আখতারুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এগুলো তো তাদের কাজ নয়। নার্স আর ডাক্তারদের কাজ। এরকম কোনো অভিযোগ আমি পাইনি। যদি এরকম কাজের কোন প্রমাণ পাই তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।

এসএস/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!