চবির ‘বাকবিতণ্ডা’ নিয়ে রহস্যের ডালপালা, হাইপ্রোফাইল সভায় কেন গোপন অডিও রেকর্ড

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে ডিনের বাকবিতণ্ডা নিয়ে ক্যাম্পাসজুড়ে তৈরি হয়েছে চাঞ্চল্য, পাশাপাশি উঠেছে নানান প্রশ্নও। এদিকে সপ্তাহ আগের অডিও রেকর্ড হঠাৎ ফাঁস হওয়ার নেপথ্যে কী আছে— এ নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। হাই-প্রোফাইল সভার কথোপকথনই বা কী উদ্দেশ্যে রেকর্ড করা হল?

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (৩ নভেম্বর) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সভাকক্ষে সমাবর্তন আয়োজন নিয়ে ডিনদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার। সেখানে ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক হেলাল উদ্দীন নিজামীর সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয় উপাচার্যের। ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পর সেই বাকবিতণ্ডার একটি অডিওর বিবরণী সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। সেই অডিও নিয়ে ডালপালা মেলছে নানা রহস্যেরও।

কেউ বলছেন, উপাচার্যের সভাকক্ষে ডিনরা গেলো, কিন্তু আলোচনা রেকর্ড করা হলো কেন? সেই রেকর্ড বাইরে প্রচার করলেনই বা কে? ওই সভায় ডিনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হাই প্রোফাইল’ প্রফেসররাই কেবল ছিলেন, তাদের কেউ কেন এই কাজ করতে গেল? কেউ কেউ আবার প্রশ্ন তুলছেন, সমাবর্তন আয়োজন নিয়ে ডাকা সভায় হেলাল নিজামী কেন সিন্ডিকেট নির্বাচনের মত অপ্রাসঙ্গিক বিষয় টেনে আনলেন, তর্ক জুড়ে দিলেন?

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, সমাবর্তন আয়োজনের সভা শেষে ব্যক্তিগতভাবে হেলাল নিজামী বা ডিনরা কি উপাচার্যের সঙ্গে এই বিষয়ে কি আলাপ করতে পারতেন না? সমাবর্তন আয়োজনের মত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয়ে ডাকা সভা পণ্ড করতেই কি আগে থেকে এই পরিকল্পনা ছিল কারও? বিনা অনুমতিতে একটি হাইপ্রোফাইল সভার কথোপকথন রেকর্ড করে সেটা ভাইরাল করার নেপথ্যে কী আছে?’

এমন পরিস্থিতিতে এমনও শোনা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কি ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে হেলাল নিজামীর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পথেও এগোতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের অভিযোগ, উপাচার্য শিরীণ আখতারের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন বিবিএ অনুষদের ডিন প্রফেসর হেলাল নিজামী। তাদের অভিযোগ. উপাচার্যকে উত্তেজিত কর‍তে নানা কায়দা করে সমাবর্তন আয়োজনের সভায় সিন্ডিকেট নির্বাচন ইস্যু টেনে আনা হয়েছে দফায় দফায়।

এদিকে এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে তীব্র ক্ষোভ।

তারা বলছেন, সমাবর্তন আয়োজন নিয়ে আলোচনার ভেতর সিন্ডিকেট নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে সভা পণ্ড করতেই প্রফেসর ড. হেলাল নিজামী উপাচার্যের সঙ্গে অসদাচরণ করেছেন। বয়োজ্যেষ্ঠ প্রফেসর ড. শিরীণ আখতারকে অসম্মান করে দফায় দফায় কথা বলায় উপাচার্য তাকে থামিয়েছেন। তবুও কথা বাড়ানোয় সেটা একপর্যায়ে বাকবিতণ্ডায় রূপ নেয়।

শিক্ষকদের অভিযোগ, সমাবর্তন একটি রাষ্ট্রীয় আয়োজন। রাষ্ট্রপতি যেহেতু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর, সে কারণে তার অনুমতিসাপেক্ষে সমাবর্তন করার নিয়ম রয়েছে। তাছাড়া রাষ্ট্রপতির উপস্থিতির বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনে নানা সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার গত ৩ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অনুষদের ডিনদের নিয়ে সভা আহবান করেন। ডিনরা যেহেতু প্রত্যেক অনুষদের একাডেমিক প্রধান, সেহেতু উপাচার্য তাদের সঙ্গে নিয়েই সমাবর্তন আয়োজনের উদ্যোগ নিতে চান।

ওই শিক্ষকদের অভিযোগ, সমাবর্তন আয়োজনের আলোচনার ভেতরেই অপ্রাসঙ্গিকভাবে সিন্ডিকেট নির্বাচন দেওয়ার দাবি তোলেন হেলাল নিজামী। এ সময় তিনি পুরো সভায় হট্টগোল বাধানোর চেষ্টা করেন বলেও অভিযোগ করেছেন কয়েকজন শিক্ষক।

সভায় উপস্থিত একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক জানান, সমাবর্তন আয়োজনের সঙ্গে সিন্ডিকেট নির্বাচনের কোনো প্রাসঙ্গিক যোগসূত্র না থাকলেও হেলাল নিজামী দফায় দফায় এই বিষয়টিই বলতে থাকেন। একপর্যায়ে উপাচার্য শিরীণ আখতার সিন্ডিকেট নির্বাচনও হবে বলে জানান। কিন্তু এরপরও উঁচু স্বরে হেলাল নিজামী উপাচার্যকে অনেকটা ধমকের সুরে কথা বলতে থাকেন। তখন উপাচার্য তাকে থামার জন্য অনুরোধ করতে থাকেন। কথোপকথনের একপর্যায়ে পুরো সভাটি পণ্ড হয়ে যায়।

ওই শিক্ষক বলেন, ‘এই সভার আলোচনা ডিজিটাল ডিভাইস দ্বারা যদি রেকর্ড হয়ে থাকে তাহলে তা অবশ্যই ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন অনুযায়ী অপরাধ এবং এ ঘটনায় মামলা হওয়াও জরুরি।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক জানান, করোনা মহামারির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন আয়োজন করা সম্ভব হয়নি কয়েক বছর। বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য হিসেবে প্রফেসর শিরীন আখতার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই সমাবর্তন আয়োজন করতে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। ওই সময় করোনা মহামারি আকার ধারণ করলে বন্ধ হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম। মাসের পর মাস বন্ধ ছিল ক্লাস-পরীক্ষা।

বর্তমানে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সমাবর্তন আয়োজনের চিন্তাভাবনা শুরু করা হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গত সাড়ে তিন বছর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছি আমরা। কোনো জটিলতা হয়নি। এ সময়ের মধ্যে কোনো ছাত্র অসন্তোষ হয়নি। উন্নয়ন প্রকল্প স্বাভাবিক গতিতে চলছে। করোনার ধকল সামলে উঠেছে বিভাগগুলো। সেশনজট যাতে না হয় সে জন্য সবকিছু মনিটরিং করছি আমরা। এসব কারণে যাদের হিংসা হচ্ছে তারা প্রশাসনের যেকোনো ভাল উদ্যোগকে সবসময় বিতর্কিত করতে উঠেপড়ে লাগে। সমাবর্তনের মত আয়োজনের সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সামনে নির্বাচনী সমীকরণেও এই আয়োজন ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আমরা সবদিক বিবেচনায় নিয়ে সমাবর্তন করার প্রাক-প্রস্তুতি শুরু করতে চাইছি।’

তিনি বলেন, ‘ডিনরা যেহেতু একাডেমিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল সেহেতু তাদের নিয়েই আমি মিটিং ডাকলাম। সেখানে বিবিএর ডিন সাহেব অসৌজন্যমূলক ও মানহানিকর মন্তব্য জুড়ে দেওয়া শুরু করলেন। সমাবর্তনের মত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মাঝেই তিনি বারবার অন্য আলোচনা এনে আমার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ দেখাতে শুরু করলেন।’

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে উপাচার্য আরও বলেন, ‘উনি (বিবিএর ডিন) আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে আসলেন সমাবর্তন উপলক্ষে ডাকা এই সভা পণ্ড করতে। ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে এই সভার কথোপকথন রেকর্ড করে একটা অস্থিতিশীল ও অস্বস্তিকর পরিবেশ তিনি তৈরি করতে আসলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সবকিছু স্বাভাবিক আছে— এটাই ওনার মত কয়েকজনের গাত্রদাহের কারণ। ডিনের মত পদ হোল্ড করে মিটিংয়ের কথা রেকর্ড করা কেমন মানসিকতা আপনারাই বলেন। এমন কাজ সভ্য কেউ কি করবে কখনও? কাউকে অসম্মান করা অন্তত বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের কোনো সদস্যের কাছে কাম্য নয়।’

এদিকে ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক হেলাল উদ্দীন নিজামী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, সভায় অডিও রেকর্ড কে করেছে সেটা তার জানা নেই।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!