চবির প্রক্টর অফিস হয়ে উঠেছিল ‘হাওয়া ভবন’, অভিযোগের পাহাড়

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে নিজের স্ত্রীকে নিয়োগ দিতে আবেদনের যোগ্যতা শিথিল করার ‘আবদার’ করেছিলেন সদ্য সাবেক প্রক্টর রবিউল হাসান ভূঁইয়া। অভিযোগ মিলেছে, সর্বশেষ সিন্ডিকেট সভার আগে অনুষ্ঠিত ছয়জন কর্মচারী নিয়োগ দিতে চাপ দিয়েছিলেন তিনি ও তার অনুসারী সহকারী প্রক্টররা। কিন্তু এসব ‘আবদার’ রক্ষা করতে না পারায় প্রক্টর ও তার অনুসারী শিক্ষকরা উপাচার্যবিরোধী একটা বলয় সৃষ্টি করেছিলেন।

সমালোচনা মাথায় নিয়ে দুই দায়িত্বেই শেষ পর্যন্ত থেকে যান ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া।
সমালোচনা মাথায় নিয়ে দুই দায়িত্বেই শেষ পর্যন্ত থেকে যান ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া।

আবার ছাত্রদের কিছু গ্রুপকে নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করা হতো। তাদের মাধ্যমে প্রশাসনের ওপর তৈরি করা হতো অস্বাভাবিক চাপও।

এমন চাঞ্চল্যকর সব অভিযোগ উঠেছে খোদ বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য দপ্তরের পক্ষ থেকে। এ নিয়ে মুখ খুলেছেন উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার নিজেই। ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া অবশ্য অভিযোগগুলোকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন।

অভিযোগ থেকে জানা গেছে, পছন্দের ঠিকাদারের হাতে টেন্ডার তুলে দেওয়া, নিজের দল ভারি করতে পছন্দের শিক্ষকদের পদোন্নতি দ্রুত দিতে চাপ প্রয়োগের পাশাপাশি অপছন্দের শিক্ষকদের পদোন্নতি ঠেকিয়ে রাখার মত নেতিবাচক ‘সংস্কৃতি’ চালু করেন প্রফেসর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া। এতে শিক্ষকদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ, পদোন্নতির ভাগ্যও নির্ধারণ হতো রবিউলের নেতৃত্বাধীন প্রক্টর অফিস থেকে।

ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা বিধান ছাড়া অন্য কোনো দায়িত্ব প্রক্টরের নেই। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতার জোর খাটিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ হতো প্রক্টর অফিস ঘিরে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এভাবে প্রক্টর অফিস গত দুই বছর ধরে হয়ে উঠেছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হাওয়া ভবন’।

গত ১২ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর পদ থেকে প্রফেসর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়াসহ ১৭ জন পদত্যাগ করেন। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দপ্তর সূত্র বলছে, গত ৯ মার্চেই প্রক্টর ও তার অনুগত সহকারী প্রক্টরদের পদত্যাগ করার নির্দেশ দেন উপাচার্য। সে অনুযায়ী ওইদিনই তারা পদত্যাগ করেন। তবে সবকিছু ‘বুঝিয়ে’ দিতে পাঁচ দিন সময় নেন তারা।

জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৯ জুন প্রফেসর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়াকে প্রক্টর পদে নিয়োগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তার আগে থেকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আব্দুর রব হলের প্রভোস্টের দায়িত্বে ছিলেন। প্রক্টরের দায়িত্বে যাওয়ার পরও প্রভোস্টের দায়িত্ব আঁকড়ে রাখা নিয়ে শুরু থেকে বিতর্ক শুরু হয় রবিউলকে নিয়ে। কিন্তু সমালোচনা মাথায় নিয়ে দুই দায়িত্বেই শেষ পর্যন্ত থেকে যান তিনি।

অভিযোগ থেকে জানা যায়, প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রবিউল জড়িয়ে পড়েন শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের মত দায়িত্ববহির্ভূত বিষয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের টেন্ডার কোন্ প্রতিষ্ঠান পাবে— সেটাও নির্ধারণ হতো রবিউলের ইচ্ছায়। রবিউলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগটি ছিল— ছাত্ররাজনীতিতে উস্কানি দেওয়া। পাশাপাশি ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপ তার বিরুদ্ধে টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ তুলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক মো. ইলিয়াস বলেন, ‘প্রক্টর অফিসকে রবিউল স্যার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হাওয়া ভবন বানিয়েছেন। যেখান থেকে বসে তিনি নিয়োগ, টেন্ডারের ভাগবাটোয়ারা করেছেন। ক্ষমতার জোরে তিনি ১ কোটি ১০ লাখ টাকার কাজ তুলে দিয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের বর্তমান যুগ্ম সম্পাদকের হাতে। ছাত্রলীগের মধ্যে যখনই কোনো সংঘাতের আশংকা হতো, তখনই আমরা রবিউল স্যারকে জানাতাম। তাকে বলতাম, দুই পক্ষকেই মারামারির আগেই যেন ডাকায়। তিনি তা না করে সংঘাত লাগানোর পরিবেশ আরও ঘি ঢালতেন। পরে উপাচার্য মহোদয়কে গিয়ে বলতেন, নিয়োগ দিতে হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়া যদি আমরা নিয়ন্ত্রণে না করি, তাহলে ক্যাম্পাসে প্রতিদিন মারামারি হবে। এভাবে তিনি নিয়োগ-টেন্ডার হাতিয়ে নিয়েছেন। আমরা অনেক আগে থেকে এসব নিয়ে ফেসবুকে লিখেছি। এতোদিন পর হলেও এই হাওয়া ভবনের আস্ফালন বন্ধ হবে। আশা করি নতুন প্রক্টর এসব কিছুর ঊর্ধ্বে থাকবেন।’

বিদায়ী প্রক্টরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘তিন মাস ধরে আমি সব জানি, প্রক্টর অফিসে বসে এরা কী করেছে। আমাকে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারী সবার কথাই ভাবতে হয়। আমার প্রশাসনের তারা কাজ করেছে। কাজ করতে নেমে তারা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে। একের পর এক অভিযোগ আসতে থাকে। সব কিছু তদন্তের পর বুঝলাম বদনাম হয়ে যাচ্ছে। তারপর তাদের ডেকে বলেছি পদত্যাগ করতে। তারা চাপ দিচ্ছিল অমুককে নিয়োগ দিতে হবে, তমুককে নিয়োগ দিতে হবে।’

বিদায়ী প্রক্টর রবিউল হাসান ভূঁইয়া তাঁর স্ত্রীকে নিয়োগ দিতে নিয়ম বদলাতে চাপ দিয়েছিলেন কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে উপাচার্য বলেন, ‘কত জন কত স্বপ্ন দেখে। এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করবো না। এটুকু বলে রাখি, বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মেই চলবে। কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করে চলা উপাচার্যের পক্ষে সম্ভব না। আমি এসব কখনও প্রশ্রয় দিইনি, দেবো না।’

এদিকে অভিযোগের নানা বিষয়ে রবিউল হাসান ভূঁইয়া বলেন, ‘শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবিদাওয়া নিয়ে সবসময় সরব থেকেছি। আমি একাডেমিক মানুষ। এই ধরনের অভিযোগ ভিত্তিহীন। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় প্রক্টরের কোনো হাত থাকে না। প্রক্টর শুধু টেন্ডার নিয়ে আইনশৃঙ্খলার অবনতি যাতে না হয় সেই বিষয়টা দেখে।’

স্ত্রীকে শিক্ষক পদে নিয়োগ দিতে নিয়ম বদলাতে চাপ দিয়েছেন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!