চবির পাহাড়ে প্রতিশোধের আগুন, নেপথ্যে কারা?

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাহাড় কাটার অপরাধে পরিবেশ অধিদফতরের জরিমানা করার পরদিন থেকেই একের পর এক পাহাড়ে আগুন দেওয়া শুরু হয়। তাই সংক্ষুব্ধ হয়ে পাহাড়ে দুর্বৃত্তরা নাশকতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করছে সংশ্লিষ্টরা। এখন পর্যন্ত এ ঘটনার একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গাছ ও পাহাড়খেকোদের হুমকিতে তটস্থ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পাঁচটি পাহাড় পুড়ে ‘অঙ্গার’ হলেও পুলিশও রয়েছে নীরব ভূমিকায়।

এদিকে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দূর্বলতার সুযোগে পাহাড় ও প্রকৃতি ধ্বংস করছে পাহাড়খেকোরা। আবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের যোগসাজশও আছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী হুসাইন আল মামুন বলেন, ‘সরকার যখন মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করছে ঠিক সে সময়ই প্রকৃতির অপূর্ব আধার চবির পাহাড়ে গাছগুলোতে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটছে। চবির ছাত্ররা যখন পাহাড়খেকো এবং গাছখেকো সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করল তখন পরিবেশ অধিদপ্তর দুই ব্যবসায়ী ও চবি প্রশাসনকে জরিমানা করে। জরিমানার দুই দিন পরই মোট ৫টি পাহাড়ে আগুন দেওয়া হল। এটি সুস্পষ্ট নাশকতা।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রশাসনের লোকজনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া এমন নাশকতা করা সম্ভব নয়। পাঁচবার আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটার পরেও প্রশাসনের ভূমিকা দৃশ্যমান নয়। বর্তমান প্রশাসন ক্যাম্পাসে ছাত্র এবং পাহাড়-প্রকৃতির নিরাপত্তা বিধানে চরমভাবে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে।’

জানা গেছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি গাছ কাটা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করে। এ কমিটির আহবায়ক করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর প্রফেসর এসএম মনিরুল হাসানকে। সদস্য ছিলেন সহকারী প্রক্টর জিয়াউল ইসলাম সজল, মোহাম্মদ রিফাত রহমান সম্পত্তি (এস্টেট) শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহাবুব হারুন চৌধুরী, সেকশন অফিসার মো. বদিউল আলম ও মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। গাছ কাটার সঙ্গে জড়িতদের হুমকিতে মাত্র ২৫ দিনের মাথায় প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা এ কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। এ পদত্যাগের ঘটনাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দুর্বলতা হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না নিয়ে পাহাড় কাটায় গত ৯ মার্চ দুই ব্যবসায়ী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ১২ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এরপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে পাহাড় পোড়ানোর উৎসব। প্রায় প্রতিদিনই পোড়ানো হচ্ছে ক্যাম্পাসের কোন না কোন পাহাড়। পাহাড় কাটার অপরাধে দণ্ডিত হওয়ার ক্ষোভ থেকেই পাহাড়ে আগুন দিচ্ছে পাহাড় ও গাছ কাটার চক্রটি।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না নিয়ে পাহাড় কাটায় গত ৯ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও দুই গাছ ব্যবসায়ীকে শুনানির জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ে ডাকা হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূসম্পত্তি (এস্টেট) শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহবুব হারুন চৌধুরী, নিরাপত্তা প্রধান মো. বজল হক, গাছ ব্যবসায়ী মো. হানিফ ও মো. বজল উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দেন। তাঁরা প্রত্যেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করার বিষয়টি স্বীকার করেন।

পরে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এর ধারা ৭ অনুযায়ী, পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতিসাধনের জন্য প্রাথমিকভাবে ১২ লাখ ২৫ হাজার টাকা পরিবেশগত ক্ষতি মূল্যায়ন করা হয়। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ৯ লাখ ৫ হাজার, মো. হানিফ ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা ও মো. বজলকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

এই আদেশের দুই দিন পর ১১ মার্চ থেকে শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পাহাড়ে আগুন দেওয়ার মহোৎসব। ১০ দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫টি পাহাড়ে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

এদিকে একের পর এক পাহাড়ে আগুন দেওয়ার ঘটনায় হুমকির মুখে পড়ছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। নির্বিচারে পাহাড় পোড়ানো ও গাছ কাটার ফলে বিরূপ প্রভাব পড়েছে প্রকৃতির উপর। পাহাড়ে আগুনের ফলে বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্ষাকালে এ কারণে শুকর-বানর-সাপ-হরিণসহ চবির সমতলে নেমে আসতে পারে আশংকা করছে শিক্ষার্থীরা।

যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান বলেন, ‘আদা চাষের জন্য জমি লিজ দিলে যাদের লাভ হয় কিংবা দেশি জীববৈচিত্র্যের জঙ্গল পুড়িয়ে বিদেশি বৃক্ষ লাগানোর জন্য যারা ফান্ড পায়, যারা সেসব বিদেশি বৃক্ষ নিয়ে ব্যবসা করে তারাই পাহাড়ে আগুন দেওয়ার কথা। আবার জরিমানার ক্ষোভ থেকেও এ আগুন দিতে পারে কেউ কেউ।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মোহাম্মদ মোয়াজ্জম হোসাইন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আগুন দেওয়ার বিষয়টি জানা নেই।’ এরপর তিনি চট্টগ্রাম জেলার উ-পরিচালক জমির উদ্দীনের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। এ বিষয়ে জমির উদ্দীনকে মুঠোফোনে কয়েকবার ফোন করলেও তিনি সাড়া দেননি।

চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মশিউদ্দৌলা রেজা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাকে চট্টগ্রাম উত্তর জেলার নয়টি থানা দেখতে হয় বলে এসব ঘটনার গভীরে আমি যেতে পারি না।’ তিনি এ বিষয়ে হাটহাজারী থানার ওসির সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।

হাটহাজারী মডেল থানার ওসি মাসুদ আলম বলেন, ‘আমরা এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়েছি। আগুন দিয়েছে এ ধরনের কাউকে পেলে আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসবো। অভিযান চলছে। তবে কাউকে আটক করা হয়নি।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এস এম মনিরুল হাসান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পাহাড়ে কয়েকটা কারণে আগুন লাগতে পারে। যারা কাঠুরিয়া বা ক্ষেত-খামারে কাজ করেন তাদের সিগারেটের ফেলা দেওয়া অংশ থেকেও আগুন লাগতে পারে। অথবা পাহাড়ে চাষাবাদ করার জন্য কেউ আগুন লাগাতে পারে। এছাড়া অন্য কারণও থাকতে পারে। তবে আমরা নির্দিষ্ট করে কোন কারণ এখনও বলতে পারবো না। আমরা এটা বের করার জন্য কাজ করছি।’

এমএফও/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!