চবিতে আড়াই লাখের ‘নাটকে’ উপাচার্যকন্যা আলোচনায়, সন্দেহের তীরে বিদ্ধ দাবিদার

ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে উপাচার্যবিরোধীদের ‘তুরুপের তাস’?

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকন্যা রিফাত মোস্তফা টিনার কাছ থেকে আড়াই লাখ টাকা পাওনা দাবি করে তাকে চিঠি দিয়েছেন আসহাব উদ্দিন খালেদ নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত এক শিক্ষক।

ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন এন্ড রিসার্চের (আইইআর) সাবেক এই শিক্ষকের দাবি, তিনি এই টাকা উপাচার্য কন্যাকে ‘ধার’ দিয়েছিলেন ১৪ মাস আগে। টাকা ফেরত না দেওয়ায় তিনি এই চিঠি দিয়েছেন। তবে তিনি কোনো প্রমাণ উল্লেখ করতে পারেননি ওই চিঠিতে।

ব্যক্তিগত এই চিঠিটি এখন ঘুরছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার হাতে হাতে। পাশাপাশি তৈরি হয়েছে নানা কৌতূহল ও প্রশ্নও।

সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, উপাচার্য কন্যাকে কেনই বা একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক টাকা ধার দেবেন? আর হঠাৎ করে আসহাব উদ্দিন খালেদও তাঁর ব্যক্তিগত চিঠি কেন সবার হাতে হাতে দেবেন? তিনি গত ২ জানুয়ারি একই পাওনা চেয়ে চিঠি দিয়েছিলেন, সেই চিঠি কেন সবার হাতে হাতে গিয়েছিল? কেউ যদি সত্যিকার অর্থেই টাকা পায় তাহলে এভাবে কি খোলা চিঠি দেয়? এর পেছনে অন্য কোনো ‘চাল’ কি আছে?

কারও কারও প্রশ্ন, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ধার যে দিয়েছেন তার কি কোনো ডকুমেন্ট আছে? চেক কিংবা জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে কি কোনো চুক্তি হয়েছে? যদি তা না হয়ে থাকে, তাহলে এই পাওনা দাবির সত্যতা কতটুকু? উপাচার্যকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতেই কি কিছুদিন পর পর এমন চিঠি প্রকাশ্যে দেওয়া হচ্ছে সবার হাতে? তিনি কি উপাচার্যবিরোধী শিক্ষকদের ‘তুরুপের তাস’ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছেন?

শিক্ষকদের অনেকে সন্দেহের তীর ছুঁড়ে প্রশ্ন রেখেছেন, আসহাব উদ্দিন খালেদের কাছ থেকে মাত্র আড়াই লাখ টাকা যদি উপাচার্যের পরিবারের কেউ ধার নিয়ে থাকেন, তাহলে ওই টাকা পরিশোধের সুযোগ কি উপাচার্যের নেই? আড়াই লাখ টাকার জন্য মানসম্মান হারানোর ঝুঁকি কেন নেবেন উপাচার্য বা তার পরিবারের কেউ?

আসহাব উদ্দিন খালেদ তাঁর চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, তিনি আরও আড়াই লাখ টাকা উপাচার্যের পরিবারকে ‘উপহার’ দিয়েছেন। শিক্ষকদের প্রশ্ন, উপাচার্য পরিবারকে তিনি কেন এবং কোন্ উদ্দেশ্যে ওই টাকা ‘উপহার’ দিলেন?

তারা বলছেন, যদি আসহাব উদ্দিন খালেদের কথা সত্য বলেও ধরে নেওয়া হয়, এমন অনৈতিক কর্মকাণ্ড তিনি ঘটালেন কেন? তাছাড়া টাকা যদি তিনি দিয়েই থাকেন, তাহলে টাকার বিনিময়ে তিনি কী ধরনের ‘সুযোগ’ প্রত্যাশা করছিলেন তা চিঠিতে স্পষ্ট করেননি কেন?

এমন সব প্রশ্নের উত্তর মেলাতে না পেরে অনেকে বলছেন, আসহাব উদ্দিন খালেদ আসলে কোনো টাকাই দেননি উপাচার্য পরিবারকে। কারও প্ররোচনায় শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যকে বিব্রত করতেই এই কাজ করে বেড়াচ্ছেন।

এদিকে এসব প্রশ্নের উত্তর মেলাতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে পিলে চমকানো তথ্য। অর্ধযুগেরও আগের ঘটনার সঙ্গে যোগসূত্র পাওয়া গেছে এই ঘটনার সঙ্গে। এ বিষয়ে মুখ খুললেন স্বয়ং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার।

তিনি বলেন, ‘আইইআর’র একজন নারী শিক্ষক ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর উপাচার্য দপ্তরে আসহাব উদ্দিন খালেদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। তাতে আসহাব উদ্দিন খালেদের বিরুদ্ধে অশালীন, কুরুচিপূর্ণ ও আপত্তিকর আচরণের অভিযোগ আনেন ওই নারী শিক্ষক। এছাড়া ওই নারী শিক্ষক উপাচার্যকে দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, ২০০১-২০০২ সালের দিকে এ ধরনের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় আসহাব উদ্দিন খালেদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল। এই অভিযোগ দেওয়ার পর থেকেই ওই নারী শিক্ষকের দ্বন্দ্ব শুরু হয় আসহাব উদ্দিন খালেদের।’

উপাচার্য আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক ন্যায্যতার ভিত্তিতেই সম্মান পান, অধিকার পান। এটুকু নিশ্চিত করা প্রশাসনের দায়িত্ব। আসহাব উদ্দিন খালেদের সঙ্গে ওই নারী শিক্ষকের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। তাই বলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ওই নারী শিক্ষককে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। আসহাব উদ্দিন খালেদ আমাদের ওপর চাপ দিচ্ছিলেন, যেন ওই নারী শিক্ষককে যোগদান করতে দেওয়া না হয়। আইইআর থেকে চাকরি যাওয়া শিক্ষকদের মধ্যে ওই নারী শিক্ষকও ছিলেন। আদালতের আদেশে চাকরি ফিরে পান তারা।’

ড. শিরীণ আখতার বলেন, ‘আসহাব উদ্দিন খালেদের আবদার রাখতে গিয়ে আরেকজন শিক্ষককে যোগদান করতে না দেওয়ার তো কোনো সুযোগ নেই। এটা তো সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে। আদালতের আদেশের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় তো ন্যায্যতার ভিত্তিতেই পরিচালিত হবে। এখানে কারও ব্যক্তিগত আক্রোশকে গুরুত্ব দিয়ে আরেকজনকে কষ্ট দেওয়ার তো সুযোগ নেই। আমরা আসহাব উদ্দিন খালেদের আবদার অনুযায়ী ওই নারী শিক্ষকের অধিকার হরণ করিনি বলেই তিনি কয়দিন পরপর টাকা চেয়ে চিঠি দিচ্ছেন, যেন আমরা বিব্রত হই। এই চিঠি তিনি সবাইকে দিয়ে বেড়াচ্ছেন। আমার এমন পরিস্থিতি হয়ে যায়নি যে আমাকে কারও কাছ থেকে টাকা ধার চাইতে হবে। আর তার কাছ থেকে ধার চাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। উনি কেনই বা আমাদের আড়াই লাখ টাকা উপহার দিতে যাবেন?’

তিনি আরও বলেন, ‘আইইআর’র তিনজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চবি স্কুল এন্ড কলেজে যোগদান করে। আদালতের আদেশ আসার পর তাদেরও আমরা আইইআর-এ পাঠাই। আদালতের আদেশের বাইরে তো আমরা যেতে পারবো না। আসহাব উদ্দিন খালেদের দাবি ছিল, এই তিনজন শিক্ষককে যেন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করতে না দিই। ওনার কথা মত এসব হয়নি দেখে উনি ষড়যন্ত্রে নেমেছেন।’

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কন্যা রিফাত মোস্তফা টিনা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আসহাব উদ্দিন খালেদ স্যারের বিরুদ্ধে যে নারী শিক্ষক অতীতে অভিযোগ করেছিলেন, তাকে যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে যোগদান করতে বাধা দেওয়া হয় সে আবদার তিনি রাখেন আম্মুর কাছে। আবার অন্য তিনজন শিক্ষককেও যেন যোগদান করতে দেওয়া না হয় সে কথা বলেন আম্মুকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিষয়েই যেহেতু সম্পৃক্ত নই, সেহেতু আমি এ বিষয়ে ওনার সামনে কোনো কথা বলিনি। ওনার কথাবার্তাগুলো হুমকিস্বরূপ। একপর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, ওই নারী শিক্ষককে যোগদান করালে তিনি সেটা মেনে নেবেন না। ওনার কথামত এসব হয়নি বলে তিনি টাকা পাওনার মত ডাহা মিথ্যা ও অবান্তর কথা বলে সবাইকে চিঠি দিয়ে বেড়াচ্ছেন। যা খুবই ন্যাক্কারজনক। আমার আম্মু যেহেতু উপাচার্যের দায়িত্বে আছেন, সেহেতু আমাকে টেনে এনে তিনি আম্মুকে বিব্রত করতে চাইছেন।’

এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন এন্ড রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আসহাব উদ্দিন খালেদেকে কল দেওয়া হলেও সংযোগ স্থাপন সম্ভব হয়নি। তবে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘উনি আমার কাছ থেকে ইনডিরেক্টলি টাকা চেয়েছেন ড. উদিতি দাশের মাধ্যমে। তার মোবাইলে কল দিয়ে উপাচার্য বলেছেন, খালেদ ভাইকে বল আমার মেয়েকে লাখ দুয়েক টাকা দেওয়ার জন্য। আমাকে উদিতি দাশ লাউড স্পিকারে শোনাচ্ছিলেন এই কথা। আমি এমনিতে মানুষকে টাকা-পয়সা ধার দিই। আমি কোনো ডকুমেন্টস রাখি নাই। আমি যাকে বিশ্বাস করি, তাকে এরকম দিই। আমি তো তাদের বিশ্বাস করে দিয়েছি। আমার আড়াই লক্ষ টাকা তারা ধার নিয়ে এখনও দিচ্ছে না। এটা হলো আসল ঘটনা। আমি বুঝতে পারছি না কেন এই টাকা দিচ্ছে না। এগুলো কি আমার কাছ থেকে উনি চাঁদা নিয়েছেন?’

তবে আসহাব উদ্দিন খালেদের দাবিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উল্লেখ করে ড. উদিতি দাশ বলেন, ‘এ সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা। সবই মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তিকর তথ্য।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!