চট্টগ্রাম সিটি কলেজে প্রশ্নপত্রে ভুল, ‘মিসটেক’ বলে দায় সারছে কর্তৃপক্ষ

চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের ২০২০ সালের অনুষ্ঠেয় উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পূর্বপ্রস্তুতির নির্বাচনী পরীক্ষার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের বহুনির্বাচনী প্রশ্ন পেয়েই চমকে গেলেন পরীক্ষার্থীরা। তাতে দেখা গেল, ক্রমানুসারে ক্রমিক নম্বরের ভুল। এই ভুলের জেরে অন্তত পৌনে ঘন্টা ধরে পরীক্ষা কার্যত বন্ধ ছিল। পরে শিক্ষকরা প্রশ্নপত্র সংশোধনের উদ্যোগ নিলেও বিড়ম্বনায় পড়া শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ জানিয়েছে কর্তৃপক্ষের অবহেলায়। তবে এই ভুলকে ‘প্রিন্টিং ভুল’ বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা।

প্রশ্নপত্র প্রণয়নে অবহেলা ও দায়িত্বহীনতায় বুধবার (২০ নভেম্বর) চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজে ঘটেছে এমন কাণ্ড।

অংক আর ইংরেজি বিষয়ের পর শিক্ষার্থীদের কাছে রীতিমতো আতঙ্কের বিষয় আইসিটি (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়)। আর এ বছরের অনুষ্ঠিত এইচএসসি পরীক্ষায় ইংরেজি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে খারাপ ফলাফলের কারণে গতবারের তুলনায় দশমিক ৫৪ শতাংশ কমেছে পাশের হার। যার মধ্যে মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের পরীক্ষার্থীদের ইংরেজি ও আইসিটি (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) বিষয়ে খারাপ হওয়ায় সার্বিকভাবে ফলাফলে প্রভাব পড়েছে।

দেখা যায়, নির্বাচনী পরীক্ষার বহুনির্বাচনী প্রশ্নোত্তরে পূর্ণমান ২৫ নম্বরের বহুনির্বাচনী প্রশ্নে রয়েছে ২৭টি প্রশ্ন। নম্বরের ক্রমানুসারে ৪ এর পরেই ৫ এর পরিবর্তে ৬ এবং তারপর আবারও ৫ ও ৬ নম্বর প্রশ্ন করা হয়েছে। একইভাবে ২০ নম্বরের পর ২১ এর পরিবর্তে ২২ নম্বর প্রশ্ন করা হয়। এ ছাড়াও ২২ এর পরে কোনো ক্রমিক নম্বর না দিয়েই আরেকটি প্রশ্ন করা হয়। পরবর্তীতে ক্রমানুসারে ২৫ পর্যন্ত বহুনির্বাচনী প্রশ্নোত্তর রাখা হয়। যদিও এই ভুলকে সহজভাবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা। তবে এ নিয়ে অভিভাবক এবং ছাত্রছাত্রীদের ভেতর মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।

চট্টগ্রাম সিটি কলেজে প্রশ্নপত্রে ভুল, 'মিসটেক' বলে দায় সারছে কর্তৃপক্ষ 1

দ্বাদশ শ্রেণির মানবিক বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এমনিতেই ইংরেজির পর এই বিষয়ের প্রতি ভয় কাজ করে। প্রশ্ন এমন দেখে আমরা কনফিউশানে পড়ে গেলাম। মাথায় কাজ করছিলো না ঠিক কী করা উচিত! একদিকে সময় চলে যাচ্ছে অন্যদিকে ওএমআর শিট পূরণ করে জমা দিতে হবে। কিন্তু সিরিয়াল মেইনটেইন করতে পারছি না। প্রায় আধাঘন্টা পরে স্যাররা আমাদের হলে এলে জানালেন। এটার কারণে জানা প্রশ্নগুলোর উত্তর সঠিকভাবে লিখতে পারিনি আবার সময়ও নষ্ট হয়েছে।’

আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এটা নিয়ে পরীক্ষার হলে সবাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। প্রায় ১৫ মিনিট কেউই লিখতে পারিনি। যতক্ষণ না সমাধান দিয়েছেন। স্যাররা আমাদেরকে বলেছেন নাম্বার দিয়ে দেবেন। কিন্তু আমরা তো ভুল করে ফেলেছি। একটার জায়গায় অন্যটা বৃত্ত ভরাট করেছি। বিশ্বাস করবেন না, মাথা পুরো এলোমেলো হয়ে গেছে তখন। জানি না এখন কী হবে? একবিষয়ে খারাপ হলেও পরীক্ষা দিতে দেবে না বলে দিয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে সরকারি সিটি কলেজের আইসিটির শিক্ষক মো. জামাল চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘না আসলে আমি ভুলটা বলছি না। আমাদের মান্নান স্যার এমসিকিউ (বহুনির্বাচনী) প্রশ্নটা করেছেন। ওখানে সিরিয়াল নাম্বার দিতে গিয়ে ভুলটা হয়েছে। পরবর্তীতে ক্লাসে প্রতিটা স্টুডেন্টকে প্রতিটি রুমে গিয়ে গিয়ে ইনফর্ম করা হয়— সিরিয়ালটা তোমরাই দিয়ে দাও এক থেকে পঁচিশ পর্যন্ত। আর যে দুটো বাড়তি এসেছে ওটা আমরা ক্লোজ করে দিয়েছি।’

এক প্রশ্নের জবাবে ভুল স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘এটা আসলে প্রেস থেকে পাঠানো হয়নি তো। স্যারেরাও ব্যস্ত ছিলেন। অবশ্য অনেকগুলো পরীক্ষা ছিল। এলএলবি চলছে, অনার্সের পরীক্ষা চলছে, মিডটার্ম চলছে। গণিত বিভাগের স্যারকে (আবদুল মান্নান) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এমসিকিউর। তাড়াহুড়ো করে চেক করতে পারেননি। আমি সৃজনশীল প্রশ্নটা করেছি। স্যার পরে অবশ্য স্যরিও বলেছেন। আমরা তখনই সিরিয়াল ঠিক করে দিয়েছি। এখন প্রবলেমটা হবে না। এটা সিম্পল বিষয়।’

এদিকে বহুনির্বাচনী প্রশ্নকারী গণিত বিভাগের শিক্ষক আবদুল মান্নান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা আসলে প্রিন্টিং মিসটেক। এটা প্রশ্নে মাঝেমাঝে প্রিন্টিং ঝামেলা হয়। তাই একটু প্রবলেম হয়েছিল। এটা আমরা ক্লাসে সমাধান দিয়ে দিয়েছি। পরীক্ষার রুমেই সমাধান দিয়েছি। ওটাতে বলেছি স্টুডেন্টদের কিছু হবে না। দুইটা এমসিকিউতে প্রবলেম ছিল। এটা ওভাবে বিবেচনা করব।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওই দুইটাকে মাথায় রেখে আমরা ম্যানুয়ালি করবো। এটা আসলে ইন্টারনাল পরীক্ষা। অনলাইনে হবে না, ম্যানুয়ালি হবে। এই দুইটা এমসিকিউতে ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ হিসেবে স্টুডেন্ট যাতে পায় সেটা হবে।’

অভিভাবক কে নাহার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা মোটেও দায়িত্বশীলতার পরিচয় না। বাচ্চাদের পরীক্ষা নির্ভর করছে তাদের ওপর। খারাপ করলে তারা নিজেরাই তো চান্স দেবে না। কয়েকদিন আগে অভিভাবক সমাবেশে বারবার আমাদেরকে বলেছে অথচ নিজেরাই ভুল করছে। একটা সরকারি কলেজের শিক্ষকদের কাছে এটা আশা করা যায় না। উনাদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন।’

আরেক অভিভাবক সুলতানা বেগম বলেন, ‘মেয়েটা এসে বললো পরীক্ষাটা ভালো হয়নি। জানতে চাইলে বলে প্রশ্নে ভুল ছিল। পরে দেখলাম আসলেই ভুল। একটা সরকারি কলেজে এমন ভুল! উনারা যে দায়িত্বশীল না তারই প্রমাণ এটা। সত্যিই কিছু বলার নেই।’

এ প্রসঙ্গে সরকারি সিটি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মঞ্জুর আহমদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি একটা ট্রেনিংয়ে গত দুইদিন ছুটিতে আছি। আমি এখন শুনলাম। এর আগে তো জানতাম না। ঠিক আছে আমি খবর নিয়ে দেখি, কার দায়িত্বে অবহেলা ছিল বা এই প্রশ্নটা কারা করেছে। আমি এটুকু বলতে পারি আমাদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে বা আমাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো ভুল হয়ে থাকে তাহলে আমি বিষয়টা অবশ্যই দেখবো সিরিয়াসলি। প্লাস এই ভুলের জন্য যদি কোন পরীক্ষার্থীর ক্ষতি হয়ে থাকে আমি আবার তাকে বাড়তি সুযোগ করে দেবো।’

এদিকে নির্বাচনী পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষার প্রশ্নে এমন ভুলে প্রশ্ন প্রণয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দায়িত্বশীলতার অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন অভিভাবকরা। যার ফলে সহজ বিষয়টিও অনেক সময় ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় শিক্ষার্থীদের মাঝে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!