চট্টগ্রাম সিটির ভোটে ৭৮ ভাগ প্রার্থীই ব্যবসায়ী, ১২ ভাগ চলেন বাড়িভাড়ায়
‘রাজনীতি এখন পুরোপুরি বাণিজ্যের গ্রাসে’
জাতীয় থেকে স্থানীয়— সব নির্বাচনে বরাবরই আধিপত্য ব্যবসায়ীদের। ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনেও দেখা যাচ্ছে সেই একই ছবি। এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ৭৮ ভাগ প্রার্থীরই পেশা ঠিকাদারি, তামাক কিংবা লাইসেন্স করা মদের ব্যবসার মতো কাজ। অন্যদিকে মাত্র ১২ ভাগ প্রার্থীর আয়ের একমাত্র উৎস বাড়িভাড়া। শুধুমাত্র স্বতন্ত্র এক কাউন্সিলর প্রার্থী তার হলফনামায় ‘রাজনীতি’কে একটি পেশা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সুশীল সমাজ বলছেন, রাজনীতি এখন পুরোপুরি বাণিজ্যের গ্রাসে।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে জমা দেওয়া ১৭৯ জন প্রার্থীর হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে সাতজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মেয়র পদে, কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছেন ১৭১ জন। একজন কাউন্সিলর প্রার্থী ইতোমধ্যে নির্বাচিত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।
২৭ জানুয়ারি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে ৪১টি ওয়ার্ডের ৭৩৫টি কেন্দ্রে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ভোটার সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ।
হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মেয়র পদের সাত প্রার্থী ছাড়াও কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে ১৩২ জন পেশায় ব্যবসায়ী। এর বাইরে কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে স্বল্পসংখ্যক রয়েছেন কৃষক, আইনজীবী, সমাজকর্মী, চিকিৎসক, সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবী। ছয়জন কাউন্সিলর প্রার্থী জানিয়েছেন পেশায় তারা কৃষক। এছাড়া প্রার্থীদের মধ্যে আইনজীবী পাওয়া গেছে দুজন, সমাজকর্মী দুজন, চিকিৎসক ও রাজনীতিবিদ একজন করে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ২৫ নম্বর রামপুর ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর প্রার্থী আব্দুস সবুর লিটনের একটি তামাক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানসহ একক ও যৌথ মালিকানায় মোট ৭টি ব্যবসা রয়েছে। সবমিলিয়ে ৯ কোটি ২৪ লাখ ৫০ হাজার ৬৭৫ টাকার অস্থাবর ও স্থাবর সম্পত্তির মালিক এই প্রার্থীর ব্যবসা থেকে বার্ষিক আয় ২৫ লাখ ৯২ হাজার টাকা।
হলফনামায় লিটনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তার সাতটি ব্যবসার প্রথমটি সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘তারা ট্রেডার্সে’র মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী তামাক ও বৈধ মালামাল সরবরাহ করা হয়। এছাড়া ‘তারা ইন্টারন্যাশনাল টোবাকো’ নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিগারেট প্রস্তুত ও বিপণন করেন তিনি। এছাড়া ‘বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোবাকো’ নামে আরও একটি সিগারেট প্রস্তুত ও বিপণন কোম্পানির কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন তিনি। তার অন্যান্য ব্যবসাগুলো হলো তারা মাল্টিমিডিয়া, তারা পেপার টোন প্রিন্টিং প্রেস, তারা বেভারেজ লিমিটেড।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বললেন, ‘রাজনীতি এখন পুরোপুরি বাণিজ্যের গ্রাসে চলে গেছে। ব্যবসায়ীরা রাজনীতি দখল করার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ব্যবসায়ীদের হাত থেকে মুক্ত ছিল। কিন্তু নির্বাচন যখন থেকে পক্ষপাতদুষ্ট হতে শুরু করল, তখন মনোনয়ন বাণিজ্যও বেড়ে গেল ব্যাপকভাবে— যা রাজনীতির জন্য খুবই অশুভ।’
তিনি বলেন, ‘জনগণের প্রতি এই ব্যবসায়ীদের কোনো জবাবদিহিতা কিংবা আনুগত্য থাকবে না। তার বদলে তারা নিজেদের জন্য আরও টাকা বানাতে তাদের অবস্থানকে ব্যবহার করবে।’
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাদের বেশিরভাগই পেশায় ঠিকাদার ও কমিশন এজেন্ট। ৩০ জন প্রার্থী ঠিকাদারির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। ১৮ জন প্রার্থী কমিশন এজেন্ট হিসেবে ব্যবসা করেন।
এছাড়া আওয়ামী লীগ সমর্থিত ৩৪ জন এবং বিএনপি সমর্থিত ২৯ জন প্রার্থী তাদের হলফনামায় ব্যবসাকে তাদের পেশা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
৭ নম্বর ওয়ার্ড পশ্চিম ষোলশহর থেকে স্বতন্ত্র কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা মোহাম্মদ এয়াকুব তার হলফনামায় রাজনীতি এবং সমাজসেবাকে তার পেশা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ৬৪ বছর বয়স্ক এই প্রার্থী হলফনামায় জানিয়েছেন, তার শিক্ষাগত যোগ্যতা দশম শ্রেণী এবং তার নামে চট্টগ্রাম সিএমএম কোর্টে একটি মামলা আছে।
এয়াকুব আরও জানাচ্ছেন, পৈতৃকসূত্রে পাওয়া বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে বছরে তিনি ১ লাখ ১৬ হাজার টাকা আয় করেন। অন্যান্য উৎস থেকে আরও আয় হয় ১ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। বর্তমানে তার নগদ ৫ হাজার টাকা এবং ব্যাংকে ৬ লাখ ৪৮ হাজার ৯৮২ টাকা জমা আছে। এছাড়া ১০ ভরি (১১.৬৪ গ্রাম) স্বর্ণ, ৫০ হাজার টাকা মূল্যের ইলেকট্রনিক সামগ্রী এবং ৫০ হাজার টাকা মূল্যের আসবাবপত্র রয়েছে। তবে তিনি নিশ্চিত করেছেন, তার নামে কোনো ঋণ নেই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার মনে করেন, ‘তৃণমূল পর্যায়ের একটি নির্বাচনে এত জন ব্যবসায়ীর অংশগ্রহণ রাজনীতিকে ব্যবসায় পরিণত করছে। এখন নির্বাচন হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনীতিকে ব্যবসায় পরিণত করার একটি শক্ত হাতিয়ার। প্রকৃত রাজনীতিবিদরা দলে থাকা ব্যবসায়ীদের হাতে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। এর ফলে তারা ক্রমেই রাজনীতিবিমুখ হয়ে উঠছে।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী প্রক্রিয়া গত কয়েক বছর ধরেই প্রশ্নবিদ্ধ। ভোটাররা তাদের ভোটাধিকারের প্রকৃত প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছেন না।’
এদিকে হলফনামায় কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে ১৫৮ জন তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা জানিয়েছেন। এদের মধ্যে ৫১ জন স্বশিক্ষিত ও শিক্ষিত। এছাড়া সপ্তম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন নয়জন প্রার্থী। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট আছে ২৪ জন প্রার্থীর। উচ্চ মাধ্যমিকের সার্টিফিকেটধারী প্রার্থীর সংখ্যা ৩৩।
অন্যদিকে ৪০ জন প্রার্থী অবশ্য উচ্চশিক্ষিত— যাদের স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে। শুধুমাত্র একজন প্রার্থীরই আছে পিএইচডি ডিগ্রি— তিনি ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের নিসার উদ্দিন আহমেদ।
সিপি
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড অবলম্বনে