চট্টগ্রাম নগরীতে মাত্র চার দশক আগেও পাহাড় ছিল প্রায় ২০০টি। এর মধ্যে ১২০টিই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মাত্র ৩২ বছরে নগরীর ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে। বাকি যে কয়টি পাহাড় এখনও অবশিষ্ট আছে, সেগুলোও নিশ্চিহ্ন করছে চিহ্নিত পাহাড়খেকোরা। এ নিয়ে বরাবরই নিশ্চুপ প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর। কারণ পাহাড় কাটার বাণিজ্যে ভাগ থাকে তাদেরও। অন্যদিকে পাহাড় যারা কাটছেন, তারাও প্রভাবশালী— বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জনপ্রতিনিধিরা এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
২০১২ সালে পাহাড় রক্ষায় পরিবেশবাদী সংগঠন বেলার দায়ের করা এক মামলায় সুনির্দিষ্ট রায় দেন হাইকোর্ট। ওই রায়ে পাহাড় কর্তনকারীদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি পাহাড়ে নির্মিত স্থাপনাসমূহ গুড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও স্থানীয় প্রশাসন সেই আদেশ বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক এসএম সিরাজুল হকের গবেষণাপত্র ‘হিল কাটিং ইন অ্যান্ড অ্যারাউন্ড চিটাগং সিটি’তেও ওঠে এসেছে পাহাড় নিধনের ভয়াবহ চিত্র।
১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচটি থানা এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে সেটা কমে দাঁড়ায় ১৪ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটার। মাঝের ৩২ বছরে ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়— যা মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খালেদ মেসবাহুজ্জামানের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ৪০ বছর আগেও চট্টগ্রামে ২০০টি পাহাড় ছিল। আর এখন এর মধ্যে ১২০টিই বিলুপ্ত হয়ে গেছে পাহাড়খেকোদের লোভে পড়ে।
পাঁচলাইশে সবচেয়ে বেশি পাহাড়নিধন
গবেষণায় দেখা গেছে, এসব পাহাড় কাটা হয়েছে নগরীর বায়েজিদ, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালী ও পাহাড়তলী থানা এলাকায়। এই পাঁচটি এলাকায় ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ৯৫টি পাহাড় আংশিক কাটা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ পাহাড় কাটা হয়েছে পাঁচলাইশ এলাকায়।
বর্তমানে লালখানবাজার মতিঝর্না, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, ওয়ার সিমেট্রি, ফয়’স লেক, ষোলশহর, এমইএস কলেজ সংলগ্ন পাহাড়গুলো অনেকটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছে।
নগর উন্নয়নের নামে খোদ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) একাই চার বছরে অন্তত ২০টি পাহাড় কেটেছে ফৌজদারহাট-বায়েজিদ বাইপাস সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে। পরে শর্ত লঙ্ঘন করার অভিযোগে পরিবেশ অধিদপ্তর সিডিএকে প্রায় ১০ কোটি টাকা জরিমানা করে। তবে ফৌজদারহাট-বায়েজিদ বাইপাস সড়ক নির্মাণের পর ওই এলাকায় নতুন করে পাহাড় কাটার মহোৎসব শুরু হয়েছে। অন্যদিকে প্রশাসনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মুরাদপুর বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের চারটি পাহাড় কেটে বহুতল ভবন নির্মাণ করছে সানমার প্রপার্টিজ।
পাহাড়খেকোরা বেপরোয়া
চট্টগ্রাম নগরীতে পাহাড়খেকোরা চিহ্নিত। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না প্রশাসন কিংবা পরিবেশ অধিদপ্তরকে। অভিযোগ রয়েছে, পাহাড় কাটার বাণিজ্যে তাদেরও ভাগ থাকে। চট্টগ্রামে যারা পাহাড় কাটছেন, তারাও প্রভাবশালী— বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জনপ্রতিনিধিরা এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (২৬ জানুয়ারি) পাহাড় কেটে খাল ভরাটের খবর পেয়ে চট্টগ্রাম নগরীর আকবরশাহ থানার উত্তর পাহাড়তলী এলাকায় গিয়েছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)-র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তখন তার গাড়িবহরে হামলা হয়। হামলায় নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে খবর পেয়ে আমরা পরিদর্শনে গেলে স্থানীয় কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম নিজেই ঘটনাস্থলে আসেন। আমাদের স্থানীয় লোকজন বলেছেন, কাউন্সিলর নিজে পাহাড় কেটে কালির ছড়াখাল ভরাট করছেন। সেখানে তিনি প্লট করে বিক্রি করছেন। কাউন্সিলর ক্ষমতাবান হওয়ার কারণে স্থানীয়রা তাকে কিছু বলতে পারছেন না। শুধু স্থানীয় লোকজনই আমাদের বলেনি, সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর তদন্ত করে কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে স্থানীয় মামলাও করেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, এই ধরনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়ার কথা, কিন্তু সেটা হচ্ছে না৷ কাউন্সিলরকে জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনার কথা, সেটাও হয়নি। আমাদের গাড়িটি কাউন্সিলরের লোকজন আটকে রেখেছিল। তাদের হাতে দেশীয় অস্ত্র ছিল। পরে থানায় ফোন দিলে একদল পুলিশ এসে গাড়ি এবং ড্রাইভারকে উদ্ধার করে। এ সময় কাউন্সিলর বিভিন্ন মাধ্যমে আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমি কথা বলিনি। পরে আমরা গাড়িতে ওঠার সময় কাউন্সিলরের লোকজন হামলা করে।’
এ ঘটনায় রিজওয়ানা হাসান বাদি হয়ে নগরীর আকবরশাহ থানায় মামলা করেছেন। বৃহস্পতিবার (২৬ জানুয়ারি) রাতে সেই মামলা হলেও এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হননি। তবে আকবরশাহ থানার ওসি ওয়ালিউদ্দিন আকবর সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘মামলায় যাদের নাম দেওয়া হয়েছে, পূর্ণাঙ্গ পরিচয় না থাকায় গ্রেপ্তার প্রক্রিয়ায় যেতে পারিনি।’
সিপি