চট্টগ্রাম মেডিকেল ১৬ কোটি টাকার ওষুধ কেনে বছরে, বেশিরভাগই বাইরে বেচে দেয় কর্মচারীরা

চলতি বছরে ২৭ কোটি টাকার ওষুধ কেনার চাহিদাপত্র

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০২০-২১ অর্থবছরে ওষুধ কেনা হয়েছে ১৬ কোটি ৫ লাখ ১২ হাজার টাকার। অথচ রোগীদের জন্য বিনামূল্যে বরাদ্দ এই ওষুধের খুব ক্ষুদ্র একটি অংশ রোগী পর্যন্ত পৌঁছায়। বাকি সবটাই হাসপাতালের কর্মচারীসহ সংঘবদ্ধ একাধিক চক্র বাইরের ফার্মেসিগুলোতে বিক্রি করে দেয়। ফলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের রোগী ও তাদের স্বজনদের লম্বা লাইন সবসময় লেগেই থাকে হাসপাতালের নিচের ওষুধের ফার্মেসিতে। দরিদ্র রোগীরা তো বটেই, অন্যরাও ওষুধ কিনতে কিনতেই সর্বস্বান্ত হয়ে যান।

চট্টগ্রাম মেডিকেল ১৬ কোটি টাকার ওষুধ কেনে বছরে, বেশিরভাগই বাইরে বেচে দেয় কর্মচারীরা 1

চট্টগ্রামের এই প্রধান হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ডগুলোতে টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয় মেডিকেল স্টোরের পাঠানো ‘পর্যাপ্ত’ ওষুধ সরবরাহের নোটিশ। অথচ রোগীদের জন্য সরকারি বরাদ্দের সেই ওষুধ রোগীরা পায় না। কারও কারও ভাগ্যে জোটে বড়জোর ১০ টাকা মূল্যের প্যারাসিটামল।

জানা গেছে, এমন হরিলুটের মধ্যেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলতি অর্থবছরে ২৭ কোটি টাকার ওষুধ কেনার চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে।

গত সোমবার (৭ ফেব্রুয়ারি) অনেকটা বিস্ময়করভাবে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার ওষুধসহ গ্রেপ্তার হল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের দুই কর্মচারী।
গত সোমবার (৭ ফেব্রুয়ারি) অনেকটা বিস্ময়করভাবে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার ওষুধসহ গ্রেপ্তার হল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের দুই কর্মচারী।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০২০-২১ অর্থবছরে হাসপাতালের ওষুধ বাবদ বরাদ্দ ছিল ১৬ কোটি ৫ লাখ ১২ হাজার টাকা। বরাদ্দকৃত ওষুধের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ এসেনসিয়াল ড্রাগস লিমিটেড থেকে কেনা হয়েছে। এ বাবদ ব্যয় হয়েছে ১১ কোটি ২৩ লাখ ৫৮ হাজার ৪০০ টাকা। আর বাকি ৩০ ভাগ ওষুধ কেনা হয়েছে বেসরকারি বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি থেকে। আর এই বাবদে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ৪ কোটি ৮১ লাখ ৫৩ হাজার ৬০০ টাকা— যা মোট বাজেটের ৪৫ দশমিক ৬ শতাংশ।

এছাড়া এমএসআর যন্ত্রপাতি কেনা বাবদ বরাদ্দ ২০ শতাংশ— টাকার পরিমাণে যা ৭ কোটি ৪ লাখ টাকা। আবার এমএসআর যন্ত্রপাতি মেরামতের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ ৭০ লাখ ৪০ হাজার টাকা। গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা ইত্যাদি বাবদ বরাদ্দ ২ শতাংশ— টাকার অংকে যার পরিমাণ ৭০ লাখ ৪০ হাজার টাকা। লিনেন বাবদ বরাদ্দ ৩ শতাংশ— টাকার পরিমাণে যা ১ কোটি ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এক্সরে, ফিল্ম, ইসিজি পেপারসহ কেমিক্যাল রি-এজেন্ট বাবদ বরাদ্দের ১০ শতাংশ— টাকার অংকে যার পরিমাণ ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা। অক্সিজেন ও অনান্য গ্যাস সরবরাহ বাবদ বরাদ্দের পরিমাণ ৫ শতাংশ— টাকার অংকে যার পরিমাণ ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।

প্রতিটি ওয়ার্ডে হাসপাতাল থেকে রোগীদের সরবরাহযোগ্য ওষুধের তালিকায় দেখা গেছে, মজুদকৃত ওষুধের মধ্যে রয়েছে আ্যামোক্সিলিন, ক্লোক্সসিলিন, সিপ্রেডিন, ডক্সিসাইক্লিন, টেট্রাসাইক্লিন, ওমিপ্রাজোন, ট্যাবলেট এসপিরিন, এমলোডিপাইন, এলবিনডাজোল, এজিথ্রোমাইসিন, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, কনট্রিমোক্সাজোল, ক্যালসিয়াম কার্বোনেট, সিপ্রোফ্লোক্সেসিন, ক্লোনাজিপ্যাম, কারভিডিঅল, কারডিজেম, ডাইক্লোফেনাক, ফেরাস সালফেট, হালোপিরিডল, পাইরোভিখট, রিবোফ্লেবিন, ভারপামিল ইত্যাদি।

অন্যদিকে ইনজেকশনের মধ্যে রয়েছে— এমিকাসিন, এমপিসিলিন, ডায়াজিপাম, মেট্রো, প্রোসাইক্লিডিন, রেনিটিডিন, সালবিউটামল ইত্যাদি। এছাড়া সিরাপ ও ড্রপের মধ্যে রয়েছে এমোক্সিলিন, সালবিউটামল ছাড়াও গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা, স্যাভলন, হেক্সিসল, ভায়োডিন, এমআরআই/সিটি ফিল্ম ইউসল ইত্যাদি পর্যাপ্ত রয়েছে বলে নোটিশে উল্লেখ রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মজুদ ওষুধের তালিকা সম্বলিত এই নোটিশ হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ডে টাঙ্গিয়ে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও টাঙ্গানো আছে কেবল হাতেগোনা কয়েকটি ওয়ার্ডে। আবার কোনো কোনো ওয়ার্ডে টাঙানো হলেও ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড মাস্টার, ওয়ার্ডবয়রা ওই নোটিশ ছিঁড়ে ফেলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

টাঙানো হোক বা না হোক, ওই তালিকার সাথে ওয়ার্ডের বাস্তবচিত্রের কোনো মিল নেই। প্রকৃতপক্ষে এক প্যারাসিটামল ছাড়া আর কোনো ওষুধই রোগীদের দেওয়া হয় না। রোগী ও তাদের স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগে মিলেছে এর সত্যতাও। কয়েকদিনের সরেজমিন অনুসন্ধানে হাসপাতালের নিচে নায্যমূল্যের দোকান স্বপ্না মেডিকেল স্টোরের সামনে অবস্থান করেও দেখা গেছে, চিকিৎসাধীন রোগীকে ডাক্তারের দেওয়া স্লিপে লেখা সব ওষুধই বাইরে থেকে কিনে আনতে হয় বাধ্যতামূলকভাবে।

২৮ নং নিউরো সার্জারি ওয়ার্ডে দেখা গেছে, এই ওয়ার্ড থেকে কোনো ওষুধই রোগীরা পাচ্ছেন না। এক্সিপিন ইনজেকশন, সেফট্রান, ওরাডেক্সন, সেফার্ডসহ কোনো ইনজেকশনই রোগীরা পান না। অথচ হাসপাতাল থেকে টাঙানো তালিকায় রোগীদের জন্য এসব ওষুধের পর্যাপ্ত মজুদ আছে বলে জানানো হয়েছে।

এমন অবস্থা অন্য সব ওয়ার্ডেও। অথচ সরকারি বরাদ্দের ওষুধ নিয়ে এমন হরিলুটের সবকিছু জেনেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সবসময়ই থাকে চুপচাপ। দেখেও না দেখার ভান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিনামূল্যের ওষুধ বাইরে বিক্রি করে শুধু কর্মচারীরাই লাভবান হন না, ওই টাকার ভাগ অনেক ওপর পর্যন্তও যায়।

এমন পরিস্থিতির মধ্যেই গত সোমবার (৭ ফেব্রুয়ারি) অনেকটা বিস্ময়করভাবে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার ওষুধসহ গ্রেপ্তার হল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের দুই কর্মচারী। চমেক হাসপাতালের গোলচত্বর থেকে গ্রেপ্তার ওই দুই কর্মচারী একজন ২৬ নং ওয়ার্ডে কর্মরত স্থায়ী কর্মচারী আশু চক্রবর্তী (৩৫)। গ্রেপ্তার হওয়া অপরজন মো. সৈয়দ (৬২) কাজ করছিলেন আউটসোর্সিংয়ের ভিত্তিতে। এ সময় এই দুই কর্মচারীর সঙ্গে থাকা ব্যাগ তল্লাশি করে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ পাওয়া যায়, যার মূল্য প্রায় এক লাখ ১০ হাজার টাকা। পরে আশু চক্রবর্তীর বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় আরও দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা মূল্যের ওষুধ। এই সব ওষুধই হাসপাতালের রোগীদের জন্য বরাদ্দ বিনামূল্যের ওষুধ। এসব ওষুধের পাতায় দেওয়া আছে ‘বিনামূল্যের সরকারি ওষুধ’ সিলও। গ্রেপ্তার দুই কর্মচারী পুলিশকে জানিয়েছেন, জব্দ করা ওষুধগুলো ২৬ নম্বর অর্থোপেডিকস ওয়ার্ড থেকে চুরি করা হয়েছিল।

এই ঘটনার তদন্তে নেমে মঙ্গলবার (৮ ফেব্রুয়ারি) পুলিশ জানিয়েছে, হাসপাতালের কর্মচারী, আউটসোর্সিং ভিত্তিক কর্মচারী, বহিরাগত দালাল ছাড়াও হাসপাতালের বাইরের বিভিন্ন ফার্মেসির মালিক ও কর্মচারীদের সমন্বয়ে প্রায় ১৫টি চক্রের অস্তিত্ব তারা পেয়েছে, যারা রোগীদের জন্য বরাদ্দ বিনামূল্যের ওষুধ চুরিতে জড়িত।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!