চট্টগ্রাম মেডিকেলে ৯ মাসে ৪৮ লাখ টাকা হাওয়া শ্রেফ টোনারের কারসাজিতে

৭০০ টাকার টোনার গছিয়ে ৩৬০০ টাকা বিল

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে প্রিন্টারের নিম্নমানের টোনার দিয়ে প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। দরপত্রে ভালো মানের টোনারের দামের কথা উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে দেওয়া হচ্ছে কম দামের নিম্নমানের টোনার। দরপত্র ঘোষণার পর এ পর্যন্ত গত ৯ মাসে এমন জালিয়াতির মাধ্যমে কমপক্ষে ৪৮ লাখ টাকা ঢুকেছে ঠিকাদারদের পকেটে। আর এ টাকার ভাগ গেছে মেডিকেল ও লিলেন স্টোর এবং দরপত্র শাখার কিছু অসাধু কর্মচারীর পকেটেও।

টোনার নিয়ে এ অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান।

জানা গেছে, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ৯০ লাখ টাকায় সর্বোচ্চ দরদাতা হন এমএম অ্যাসোসিয়েট। তারা প্রতিটি ৩ হাজার ৬০০ টাকা দামের টোনার দেবে বলে জানায় দরপত্রে। কিন্তু শুরু থেকে তারা ৭০০ থেকে ১১০০ টাকা দামের নিম্নমানের টোনার (৮৫এ মডেল) দিয়ে আসছে। এর ফলে কিছুদিন পরপর প্রিন্টার নষ্ট হচ্ছে মেডিকেলে। বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেলে প্রায় ৪৫টি প্রিন্টার ব্যবহৃত হয় প্রতিদিন। এসব প্রিন্টারের জন্য এ পর্যন্ত প্রায় ১৯০০ টোনার সরবরাহ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

এভাবে প্রতিটি টোনার থেকে গড়ে ২৫০০ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমএম অ্যাসোসিয়েট। এ কাজে সিনিয়র স্টোর অফিসার হুমায়ুন কবির, লিলেন স্টোর অফিসার তৌহিদুল ইসলাম, টেন্ডার শাখার অফিস সহায়ক জুয়েল মিয়ার যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ টাকার ভাগ পান এসব কর্মচারীরাও।

মেডিকেল সূত্রে জানা গেছে, দরপত্রের পর প্রথম পর্যায়ে মেডিকেলের বিভিন্ন বিভাগের ৪৫টি প্রিন্টারের জন্য ৪৫টি টোনার কেনা হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেলের কম্পিউটার প্রিন্টারের জন্য যেসব টোনার সরবরাহ করা হয় সেগুলো খুবই নিম্নমানের। বাজারে এসব টোনারের দাম ৭০০ থেকে ১১০০ টাকার মধ্যে। এসব নিম্নমানের টোনারের কারণে প্রিন্ট ভালো আসে না। অনেক সময় টোনারে কাগজ আটকে প্রিন্টার নষ্ট হয়ে যায়। এসব টোনার এক সপ্তাহও ব্যবহার করা যায় না। দরপত্রের হিসেবে প্রতিটি টোনার থেকে গড়ে ২৫০০ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

এ হিসেবে এ পর্যন্ত ১৯০০ টোনার থেকে প্রায় ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ টাকা থেকে ভাগ পান সিনিয়র মেডিকেল স্টোর অফিসার হুমায়ুন কবির, লিলেন স্টোর অফিসার তৌহিদুল ইসলাম ও টেন্ডার শাখার অফিস সহায়ক জুয়েল মিয়া।

এদিকে লিলেন স্টোরকিপার তৌহিদুল ইসলাম তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক। মেয়াদ চলে গেলেও এখন বহাল তবিয়তে আছেন কমিটির এ দায়িত্বে। আর এ দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই দরপত্র শাখার অনেক ঠিকাদারের সঙ্গে গোপন আঁতাত গড়ে তোলেন। ঠিকাদারের কাছ থেকে এসব টোনার রিসিভ করেন তৌহিদুল।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে এমএম অ্যাসোসিয়েটের স্বত্বাধিকারী মিথুনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

তবে অভিযোগ স্বীকার করে লিলেন স্টোরকিপার তৌহিদুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের ঠিকাদার যে টোনার সরবরাহ করে, সেটিই আমরা মেডিকেলে দিই। ৭০০ টাকার যেটি দেওয়া হচ্ছে, সেই টোনারটি বেটার বলেই জানি।’

কিন্তু দরপত্রে টোনারপ্রতি তিন হাজার ৬০০ টাকা দাম নির্ধারণের বিষয়ে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’

টেন্ডার শাখার অফিস সহকারী জুয়েল মিয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে যোগোযোগ করতে বলেন তিনি।

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আসলে টোনারের দরপত্রটি গত পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীরের সময়ে হয়েছিল। এ বিষয়ে আমি অবগত নই। তবে আমি বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে টোনারের বিল করা মূল্য ও সরবরাহকৃত টোনারের দামের মধ্যে ফারাক পেয়েছি। জানতে পেরেছি, ঠিকাদার ৭০০ টাকার টোনার কিনে ৩ হাজার ৬০০ টাকা বিল করেছে।’

তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে এখন অবগত হলাম। এ কাজে কারা জড়িত, আমি খুঁজে বের করবো। কারণ ঠিকাদার একা এ অনিয়ম করার সাহস পায়নি। যাদের ইন্ধনে করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা আমি ব্যবস্থা নেব।’

এর আগে হাসপাতালটির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা ও সরবরাহে দুর্নীতি এবং অনিয়মের চিত্র ওঠে এসেছিল দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে। দুদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রায় এক যুগ ধরে চট্টগ্রাম মেডিকেলে যন্ত্রপাতি, মনিহারি দ্রব্য কেনা, রোগীর খাবার সরবরাহ এবং চুক্তিভিত্তিক লোক নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করছে কিছু প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃশ্যমান কোনো কর্মকাণ্ড না থাকলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ‘ম্যানেজ’ করে তারা দরপত্র বাগিয়ে নেয়।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!