চট্টগ্রাম মেডিকেলে হাড়ভাঙার রোগী পান না চিকিৎসা সরঞ্জাম, সার্জারি করান ওয়ার্ডবয়

টাকা না পেলে রোগী পেটান ওয়ার্ডবয়, বকশিস নেন আয়াও

সড়ক দুর্ঘটনায় পা ভেঙে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৬ নম্বর অর্থোপেডিকস ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন তবারক মিয়া। মিরসরাইয়ের বাসিন্দা তবারক পেশায় ড্রাইভার। তার বেডের আশপাশে চার-পাঁচজন ওয়ার্ডবয় তাকে ঘিরে পায়ের ড্রেসিং করিয়ে দিচ্ছেন। পাশেই আরেক রোগীকে কাপড় দিয়ে ঘিরে সার্জারি সারছেন আরও চার-পাঁচজন ওয়ার্ডবয়। এরপর ওষুধ, গজ, ব্যান্ডেজ, কেমিক্যাল, অক্সিজেন থেকে শুরু করে সব চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার জন্য তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হয় রোগীর স্বজনদের।

শুধু তবারক মিয়া নন, এই ওয়ার্ডের প্রত্যেক রোগীকেই চিকিৎসার সব সরঞ্জাম আনতে হয় বাইরে থেকে কিনে। অথচ প্রতিবছর চট্টগ্রাম মেডিকেলে এসব সরঞ্জামের জন্য কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হয়।

চট্টগ্রাম মেডিকেলসহ সব সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগ, জরুরি বিভাগ ও আন্তঃবিভাগে রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত সাধারণ সরঞ্জাম (ওষুধ, গজ, ব্যান্ডেজ, কেমিক্যাল, অক্সিজেন, নেবুলাইজার, এক্সরে ফিল্ম ইত্যাদি) কিনতে বড় বাজেট দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় মেডিকেল সার্জিক্যাল রিকুইজিট (এমএসআর)। শুধুমাত্র এই খাতে চট্টগ্রাম মেডিকেলে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বরাদ্দ এসেছে ৩৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেলের ২০২২-২৩ অর্থবছরের বরাদ্দ বাজেট ১৩০ কোটি ১০ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে যা ছিল ১২৯ কোটি ২৭ লাখ ১২ হাজার টাকা। সে হিসেবে এই বছর সেটি বেড়েছে ৮৩ লাখ ৭১ হাজার টাকা। কিন্তু বাজেট বাড়লেও স্টাফদের ইনক্রিমেন্ট বেড়েছে ৪ কোটি ৫ লাখ ১৫ হাজার টাকা। সেই হিসেবে এখনও ঘাটতি রয়েছে ৩ কোটি ২১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। তবে ঘাটতির জন্য বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল সূত্রে আরও জানা গেছে, সবমিলিয়ে প্রায় ১৫ কোটি ৮৪ লাখ ৮৭ হাজার টাকার ঘাটতির জন্য চাহিদাপত্র দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে সিকিউরিটি সার্ভিসের জন্য বরাদ্দ এসেছে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা, আরো চাহিদা দেওয়া হয়েছে ৪ কোটি টাকার। হাইটেক মেডিকো ইকুইপমেন্টের জন্য বর্তমান বরাদ্দ ১ কোটি টাকা, বাড়তি চাহিদাপত্র দেওয়া হয়েছে ৭ কোটি টাকার।

এছাড়াও ডেইলি লেবারের জন্য ৩ কোটি ৯ লাখ ৮৭ হাজার টাকা, কম্পিউটার কিনতে ৭৫ লাখ টাকা, ইলেক্ট্রিক্যাল আপ্লিয়ান্সের জন্য ৫০ লাখ, অন্যান্য ইকুয়েপমেন্টের জন্য ১০ লাখ টাকা, পুরস্কারের জন্য ১০ লাখ টাকা, পরিবহনের জন্য ২০ লাখ টাকা ও প্রিন্টিংয়ের জন্য ১০ লাখ টাকার চাহিদাপত্র দেওয়া হয়েছে।

বাজেটে ঘাটতির বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, ‘২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেট বাড়লেও তা হাসপাতাল স্টাফদের বেতন-ভাতায় ব্যয় হয়েছে। প্রতিবছর ইনক্রিমেন্ট বাবদ একটা বড় অংকের টাকাও দিতে হয়েছে স্টাফদের। তবে টাকার ঘাটতি হয়েছে হাসপাতাল কার্যক্রমে। যারমধ্যে রোগীর সেবা ও ওষুধ কেনায় ঘাটতি রয়েছে। তাই মন্ত্রণালয়ে বাড়তি ৩ কোটি টাকার চাহিদাপত্র দিয়েছি।’

এদিকে ২৬ নম্বর ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, ওয়ার্ডজুড়ে রোগীর চাপ ও ওয়ার্ডবয়দের হুড়োহুড়ি। মেঝেতেও রোগীর ছড়াছড়ি, সঙ্গে রয়েছে রোগীর স্বজন। একজন রোগীর সঙ্গে তিন থেকে চারজন। মেঝেতে বসেই রোগী ও স্বজনদের খাবার সারছেন। এক রোগীর সঙ্গে ট্রাকশন (ইট) নিয়ে দরদাম করছে ওয়ার্ডবয়রা। প্রতি ইট বাবদ তারা রোগীর কাছ থেকে চাইছেন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। রোগীর ওষুধ, গজ, ব্যান্ডেজ, রড, পরীক্ষা-নিরীক্ষা সব করতে হয় রোগীদের নিজের টাকায়। রোগীকে প্রতিবার ড্রেসিংয়ের জন্য ওয়ার্ডবয়কে দিতে হয় ৫০০ টাকা। ওয়ার্ডেবয়ের সঙ্গে থাকা আয়াকে দিতে হয় ২০০ টাকা।

রোগীর ও স্বজনদের অনেকেই ক্ষোভ ঝেরে জানান, ওয়ার্ডবয়দের হাতে জিম্মি তারা। কাটাছেঁড়া ও ড্রেসিংয়ের কাজে গুনতে হয় নগদ টাকা। আর ওয়ার্ডবয়দের চাহিদামতো টাকা না দিলে খারাপ ব্যবহার করে।

২৬ নম্বর অর্থোপেডিকস ওয়ার্ডে ৮৮টি সিটের বিপরীতে রোগী ভর্তি আছে ২৪৪ জন। কোনো কোনোদিন সেটি ২৬০ থেকে ২৭০ জন ছাড়িয়ে যায়। এই ওয়ার্ডে ২০-২৫ জন ওয়ার্ডবয় সার্জারির কাজ সারেন। ওয়ার্ডে সহকারী রেজিস্ট্রার, ইনডোর মেডিকেল অফিসার, এমডি শিক্ষার্থী, ইন্টার্ন চিকিৎসকসহ কর্মরত আছেন ২৫ জন চিকিৎসক। প্রতি শিফটে তাদের দায়িত্ব পালনের নিয়ম থাকলেও তারা তা করেন না।

২৬ নম্বর অর্থোপেডিকস সার্জারি ওয়ার্ডের সামনে রয়েছে মিনি অপারেশন থিয়েটার (ওটি)। সেখানে দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের নিয়ে সার্জারি করার কথা চিকিৎসকদের। কিন্তু সেখানে সার্জারি কারান ওয়ার্ড সর্দার আব্দুর রউফ, সুইপার তপন দাশসহ আরো ১০-১২ জন এলএমএসএস কর্মচারী, তাদের সঙ্গে থাকেন ওয়ার্ডবয়রাও। এই ওয়ার্ডে পাঁচ-সাতজন হাসপাতাল থেকে সংযুক্ত হলেও বাকিরা চুক্তিভিত্তিক।

এদের একজন রবিউল। পুরো ওয়ার্ডজুড়ে তার হাঁকডাক। রোগী কথা না শুনলে গায়ে হাত তোলার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া ড্রেসিং করতে এসে প্লাস্টারের জায়গায় তিনি ক্ষত তৈরি করে দেন বলেও জানান রোগীর স্বজনরা।

অর্থোপেডিকস সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান চন্দন কুমার দাশের কাছে রোগীদের অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি মেডিকেলের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!