চট্টগ্রাম মেডিকেলে সাড়ে ১৪ হাজার রোগী এক বছরে লাশ, প্রতিদিন ৪০ রোগীর মৃত্যু

সময়ক্ষেপণে মুমূর্ষু রোগীদের বাঁচানো যায় না

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ১২ নং হৃদরোগ ওয়ার্ডের গেটের সামনে একটি ট্রলি। ট্রলিতে চাদর দিয়ে মোড়ানো সামশুল ইসলামের লাশ। পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন তার পুত্রবধূ রিতা আক্তার ও মামা নূরে কাশেম। সবার বাড়ি পটিয়ার আমির ভান্ডার।

তাদের কাছে জানা যায়, সামশুল ইসলামের মাঝে মাঝে বুকে ব্যথা হত। হঠাৎ সেই ব্যথা তীব্র হলে প্রথমে পটিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে কর্তব্যরত ডাক্তার রোগীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। হাসপাতালে নিয়ে আসার পর সামশুল ইসলামকে ১২ নং হৃদরোগ ওয়ার্ডের আইসিইউ (ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট) এ ভর্তি করা হয়। হার্ট অ্যাটাক হওয়ায় তাকে ইনজেকশন পুশ করানো হয়। ওষুধ ও ইনজেকশন পেয়ে রাতে তিনি কিছুটা সুস্থ অনুভব করেন। পরদিন তাকে পোস্ট করোনারি ইউনিটে পাঠানো হয়। সেখানে পাঠানোর সাথে সাথে সাথেই সামশুল ইসলামের শ্বাসকষ্ট শুরু হয় আবার। এরপর আবার তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হলে খিঁচুনি উঠে একপর্যায়ে মারা যান সামশুল আলম।

চিকিৎসা নিতে এসে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে গত এক বছরে এভাবে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৪ হাজার ২৭০ জন। মুমূর্ষু রোগীরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসার পর তাদের বাঁচানো যাচ্ছে না। মূলত তাদের মৃত্যুই হাসপাতালের মৃত্যুর হার বাড়িয়েছে বলে চিকিৎসকদের অভিমত। তবে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, করোনাকালে রোগী মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটেছে। তাই চলতি বছরে মৃত্যুর সংখ্যা ১৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ কয়টি ওয়ার্ডে এইচডিইউ বা হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট চালু থাকলেও তাতে মুমূর্ষু রোগীদের চিকিৎসার বিশেষ কোনো সুবিধা নেই। এই কারণ ছাড়াও জরুরি সেবা পেতে বিলম্ব, ডাক্তারদের অবহেলা, চিকিৎসা সরঞ্জামাদির অভাব, রোগীকে জরুরি বিভাগ থেকে ওয়ার্ডে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে দেরি করাসহ বিভিন্ন কারণে রোগীরা চিকিৎসার শুরুতে ও মাঝপথে মৃত্যুবরণ করছেন।

চমেক হাসপাতালে হৃদরোগীদের চিকিৎসার হাল নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে হৃদরোগ ওয়ার্ডের জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. লক্ষীপদ দাশ জানান, হার্টঅ্যাটাকের রোগীকে অন্তত তিনদিন আইসিইউতে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত। কিন্তু চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে বেড রয়েছে ১৬টি। ফ্লোরে চিকিৎসা দেওয়া হয় আরও ১৬ জনকে। ৩২ জনের বেশি রোগীকে আইসিইউ ইউনিটে রাখা সম্ভব হয় না। আইসিইউতে ভর্তির পর কোন রোগী যদি সুস্থতা অনুভব করে তখন তাকে পোস্ট সিসিইউতে পাঠানো হয়। না পাঠালে নতুন রোগীকে আইসিইউতে জায়গা দেওয়া সম্ভব হয় না।

তার কথার সূত্র ধরে জানা যায়, রক্তনালী ব্লক হওয়াকেই সরল ভাষায় হার্টঅ্যাটাক বলা হয়। হার্টঅ্যাটাক তখনই হয়, যখন হার্ট বা হৃদযন্ত্র নিজেই আক্রান্ত হয়। তখন রোগীকে স্ট্রেপটোকাইনেস ইনজেকশন দিয়ে রক্তনালীর মধ্যে যে রক্ত জমাট হয়ে থাকে, তা গলিয়ে দেওয়া হয়। তাৎক্ষণিকভাবে এটা কাজ করে না। এটা ১ থেকে ১২ ঘন্টার মধ্যে কাজ করে। ১২ ঘন্টার মধ্যে এটি কাজ না করলে নাভির ইনজেকশন দেওয়া হয়। এ চিকিৎসাও ব্যর্থ হলে রোগীকে আর বাঁচানো সম্ভব হয় না।

জানা গেছে, এই ধরনের বেশিরভাগ রোগীর কপালেই তাৎক্ষণিক চিকিৎসা মেলে না। হাসপাতালে চার হাজার টাকা দামের স্ট্রেপটোকাইনেস ইনজেকশনের সরবরাহ না থাকায় অনেক রোগীর আত্মীয়স্বজনই ইনজেকশন ও ওষুধসহ ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা তৎক্ষণাৎ খরচ করার সামর্থ্য রাখেন না। এর ফলেও অনেক রোগী মারা যান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাধারন রোগী মারা গেছে ১৩ হাজার ৩ জন। পুলিশ কেসে রোগী মারা গেছে ১ হাজার ২৮২ জন। এ হিসেবে প্রতি ২৪ ঘন্টায় ওই এক হাসপাতালেই মারা যাচ্ছে ৪০ জন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার সূত্রে জানা গেছে, মৃত্যুর সংখ্যা লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ১২ নং হৃদরোগ ওয়ার্ড, ৩২ নং নিউনেটাল বা নবজাতক ওয়ার্ড, ২৬ ও ২৭ নং সার্জারি ওয়ার্ড, ২৮ নং নিউরোসার্জারি ও ৩১, ৩২, ৩৩ নং গাইনি ওয়ার্ড, ১৩, ১৪, ১৬ নং মেডিসিন ওয়ার্ড, ১৭ নং কিডনি ওয়ার্ড এবং শিশু বিভাগ থেকে রোগী মৃত্যুর তথ্য বেশি পান।

পৃথক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগী মারা গেছে ৪৮ জন। এদের বেশিরভাগই নবজাতক ও হৃদরোগ ওয়ার্ডের রোগী।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে চমেক হাসপাতালে সাধারণ রোগী মারা গেছে ১ হাজার ২৮২ জন। ফেব্রুয়ারিতে মারা গেছে ১ হাজার ১৬২ জন। অন্যদিকে মার্চে মারা গেছে ১ হাজার ৩৭৩ জন। এভাবে প্রতি মাসেই হাজারের ওপরে রোগীর মৃত্যু ঘটেছে। তবে ২০২০ সালে পুলিশ কেসে রোগী মারা গেছে জানুয়ারিতে ১৬০ জন। ফেব্রুয়ারিতে ১২০ জন।

বয়সভিত্তিক রোগী মৃত্যুর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি শূন্য থেকে ৪ বছরের মধ্যে পুরুষ শিশু মারা গেছে ৬ জন এবং মেয়ে শিশুর মৃত্যু হয়েছে ৩ জন। ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সের মধ্যে পুরুষ মারা গেছে ১৬ জন এবং মেয়ের মৃত্যু হয়েছে ৩ জন। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সের মধ্যে পুরুষ মারা গেছেন ২ জন এবং মেয়ের মৃত্যু হয়েছে ৬ জন। ২৫ থেকে ৪৯ বয়সীর মধ্যে পুরুষ মারা গেছেন ৬ জন আর মেয়ের মৃত্যু হয়েছে ৪ জন। ৪০ বয়সীর উপরে মৃত রোগীর মধ্যে রয়েছে পুরুষ মারা গেছেন ২৮ জন ও মেয়ের মৃত্যু হয়েছে ১২ জন।

হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার রুমে রোগী মৃত্যুর রেজিস্টার ঘেঁটে সম্প্রতি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে মৃত্যুবরণকারী শেখ আহমেদ নামের এক ব্যক্তির পরিবারের ফোন নম্বর পাওয়া গেল। তার ছেলে জুয়েল আহমেদের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তার বাবার হার্টের সমস্যা ছিলো। রাতে বাবার ব্যথা উঠলে সেই রাতেই তিনটায় পটিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার ডাক্তার রোগীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। সকালে তার বাবাকে নিয়ে এসে হৃদরোগ ওয়ার্ডের আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়। ইনজেকশন পুশ করার পরপরই তার বাবা খিঁচুনি দিয়ে মারা যান।

হাসপাতালের ৩২ নং নবজাতক ওয়ার্ড সূত্রে জানা গেছে, নবজাতক মৃত্যুর হার এ ওয়ার্ডে বেশি হওয়ার কারণ হাসপাতালের ৩৩ নং ওয়ার্ডে নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে সন্তান জন্ম নেওয়ার পরপরই নানা অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হন। তাদেরকে পরবর্তীতে নিউনেটাল বা নবজাতক ওয়ার্ডে ভর্তি ওয়ার্ডে করালেও বাঁচানো সম্ভব হয় না।

চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা গেল আরেক চিত্র। আত্মহত্যা, ছুরিকাঘাত, সড়ক দুর্ঘটনার মতো পুলিশ কেসের রোগী আসলে রোগীর ঠিকানা জানতে পুলিশ ফাঁড়ি থেকে সময়ক্ষেপণ করা হয়। তারপর রোগীর ভীড়ে জরুরি মেডিকেল অফিসার রোগীকে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণেও সময়ক্ষেপণ করেন। এরপর রোগীকে ওয়ার্ডে ভর্তি দিলেও ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য আয়া ও ওয়ার্ডবয়রা ট্রলিবাবদ দরদাম শুরু করেন। ট্রলিভেদে দরদাম ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। তারপর থাকে লিফটের জন্য অপেক্ষা। জরুরি বিভাগে রোগী আসার পর এভাবেই সময়ক্ষেপণ করে ঘন্টাখানেক পর রোগী ওয়ার্ডে পৌঁছান।

জানা গেছে, রোগী ওয়ার্ডে পৌঁছানোর পরও ইন্টার্ন ডাক্তারকে ডাকতে গিয়ে রোগীর স্বজনদের আরেক দফা অপেক্ষা করতে হয়। ডাক্তার যখন এসে রোগীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ শুরু করেন রোগীর অবস্থা তখন ক্রমশ খারাপের দিকে। হাসপাতাল থেকে ইনজেকশান ও ওষুধ সরবরাহ না থাকায় রোগীর স্বজনদের সিঁড়ি ভেঙে ওষুধ নিতে নিচে নামতে হয়। ওষুধ নিয়ে ডাক্তার যখন রোগীর চিকিৎসা শুরু করেন, তখন সময় পার হয়ে যায় অন্তত দুই ঘন্টা, কখনওবা তারও বেশি। এভাবে চিকিৎসা দিতে দেরি হওয়ায় অনেক রোগীকেই আর বাঁচানো সম্ভব হয় না। কয়েকদিনের অনুসন্ধানে চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে কয়েকটি ওয়ার্ড ঘুরে রোগী মৃত্যুর কারণ হিসেবে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক আফতাবুল ইসলাম জানান, হাসপাতালের পক্ষ থেকে রোগী সুস্থ করতে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তারপরও যে কোনো মৃত্যু অনাকাঙ্খিত। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্নভাবে ওয়ার্ডে নজরদারি অব্যাহত রেখেছি, যাতে জরুরি ও মুমূর্ষু রোগীদের সেবা পেতে কোনো বিলম্ব না হয়।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!