চট্টগ্রাম মেডিকেলে রোগী ‘অজ্ঞান’ হয় সুইপারের হাতে, রাজুর রাজ্যে বকশিস ছাড়া কথা নেই

রোগীকে অপারেশনের আগে অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে অচেতন করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে থাকেন অধ্যাপক বা সহকারী অধ্যাপক পদমর্যাদার কোনো ডাক্তার। কিন্তু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক, কান ও গলার (ইএনটি) অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) অ্যানেসথেসিয়া দেন সুইপার রাজু মজুমদার। সেইসঙ্গে অপারেশনের পর অবশিষ্ট ওষুধ রোগীদের ফেরত না দিয়ে বাইরের দোকানে বিক্রি করে দেন তিনি। এছাড়া কথায় কথায় রোগী স্বজনদের কাছ থেকে আদায় করেন ‘বকশিস’। রাজুকে বকশিস না দিলে সেবা মেলে না রোগীদের।

চট্টগ্রাম মেডিকেলে রোগী ‘অজ্ঞান’ হয় সুইপারের হাতে, রাজুর রাজ্যে বকশিস ছাড়া কথা নেই 1

অথচ অপারেশনের আগে রোগীকে অচেতন অথবা নির্দিষ্ট কোনো অঙ্গ অবশ করা গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। এক্ষেত্রে কোন জায়গা অবশ করতে কতটুকু ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়, সেটা কেবল ডাক্তার ঠিক করেন। এ কাজে কোনোভাবেই ওয়ার্ডবয় থাকতে পারেন না বলে জানান চট্টগ্রাম মেডিকেলের অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের প্রধান ডা. মো. হারুনুর রশিদ।

জানা গেছে, ইএনটির ওটিতে ডাক্তারদের সঙ্গে থাকেন অফিস সহায়ক মামুন হাসান। তবে তিনি অফিসে অনুপস্থিত থাকলে তার কাজ করেন রাজু মজুমদার। কিন্তু ডাক্তারদের সঙ্গে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স ছাড়া কোনো অফিস সহায়ক বা সুইপারের ওটিতে থাকার নিয়ম নেই। এছাড়া ওটির যাবতীয় যন্ত্রপাতির সেটআপও করে থাকেন মামুন এবং রাজু।

সরেজমিন ইএনটির ১৯ নম্বর ওয়ার্ড এবং ওটি ঘুরে কথা হয় চিকিৎসাধীন খালেদার সঙ্গে। তিনি জানান, তার গালে একটা বিচির মত হয়েছিল। সেটি তিনি খোটালে ঘা হয়। পরে তার কান ও মুখ ফুলে যায়। হাসপাতালে ভর্তি হলে ডাক্তার অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন। অপারেশনের ওষুধে তার প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।

ওটির দুর্ভোগের কথা জানিয়ে খালেদার ভাই শিহাব বলেন, ‘আমার বোনকে অপারেশনের টেবিল থেকে নামাতে রাজু ও মামুন নামের দু’জন ২০০০ টাকা নিয়েছে। অপারেশন পর্যন্ত তাদের খুশি করতে আরও টাকা খরচ হয়েছে। রাজু কথায় কথায় রোগীদের হুমকি দেন। কথা না শুনলে রোগীর জ্ঞান ফিরবে না বলেও ধমক দেন।’

শুধু বকশিস নয়, রাজুর বিরুদ্ধে ওষুধ চুরির অভিযোগও রয়েছে। ওটিতে থাকা রোগীদের কোনো ওষুধ থেকে গেলে সেগুলো তাদের আর ফেরত দেওয়া হয় না। কৌশলে সেসব ওষুধ রাজু ও মামুন সরিয়ে নেন। এরপর সুযোগ বুঝে মেডিকেলের সামনে থাকা বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করেন।

এসব হয়রানি ছাড়াও রোগীদের আরও কষ্ট ভোগ করতে হয় ওষুধ নিয়ে। হাসপাতালের এই ওয়ার্ডে তেমন কোনো ওষুধ সরবরাহ নেই বলে জানা গেছে।

১৯ নম্বর ওয়ার্ডের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. দেবাঙ্কুর সরকার বলেন, ‘আমরা রোগীদের ভালো সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। এখানে প্রতিনিয়ত ফরেইন বডি সমস্যা নিয়ে আসে শিশুরা। প্রায়ই সময়ই শিশুরা নাক ও কানে মার্বেল, পানের বোটা, বীচি মতো জিনিস ঢুকিয়ে নেয়। এসব শিশুদের চিকিৎসা দিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ওয়ার্ডে আছে। তবে রোগীদের ওষুধ সরবরাহ অপ্রতুল হওয়ায় গরিব রোগীদের আমরা অনেক সময় ভালো সেবা দিতে পারি না।’

১৯ নম্বর ইএনটি ওয়ার্ডে প্রতিদিন ৮০ সিটের বিপরীতে ১৩০ থেকে ১৪০ জন রোগী চিকিৎসাধীন থাকেন। মূলত টনসিল, থাইরয়েড, গলার ক্যান্সার, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, কান পাকা, নাকের পলিপ, নাকের হাড় বাঁকা, ফরেন বডিসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয় এখানে। একইসঙ্গে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ জন রোগীর অপারেশন সিডিউল থাকে। তবে সোম ও শুক্রবার ওটি বন্ধ থাকে।

ইএনটির দু’ইউনিটে ছয়জন চিকিৎসক কাজ করেন। ইউনিট-১ এ কাজ করেন ডা. অতনু সাহা, ডা. সেলিম কাশেম, ডা. রাশেদ চাকমা। ইউনিট-২ তে আছেন ডা. দেবাঙ্কুর সরকার, আশিকুর রহমান নিপু, ডা. মোহাম্মদ ইমরান।

প্রতি ওটিতে একজন নার্স ইনচার্জ ও দু’জন সিনিয়র স্টাফ নার্স রয়েছেন। আর চিকিৎসক সহকারী রেজিস্ট্রার, আইএমও (ইনডোর মেডিকের অফিসার) এবং ট্রেইনি মিলে পাঁচ থেকে ছয়জন চিকিৎসক ওটিতে প্রতিদিন অপারেশন করে থাকেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অ্যানেসথিওলজিস্ট ডা. মো. হারুনুর রশিদ বলেন, ‘অ্যানেসথেসিয়া বলতে সাধারণত মানুষ বোঝে তাকে অজ্ঞান করা হবে। কিন্তু এটি অজ্ঞান করা না। রোগীকে ব্যথামুক্ত এবং যে অংশে অপারেশন হবে, সে অংশ যাতে কোনোভাবে নাড়াচাড়া করতে না পারে সে অবস্থা তৈরি করে দেওয়া।’

অ্যানেসথেসিয়া পদ্ধতিকে দু’ভাগে ভাগ করা হয় জানিয়ে ডা. হারুনুর রশিদ বলেন, প্রথমটা জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া। যেটির মাধ্যমে সে অজ্ঞানও থাকবে, ব্যথামুক্তও থাকবে, কিন্তু নাড়াচাড়া করতে পারবে না। রোগীর পুরো শরীর নিয়ন্ত্রণ হবে মেশিনের মাধ্যমে। মেশিনের মাধ্যমে তার শ্বাস-প্রশ্বাস পরিচালনা করা। ওষুধের মাধ্যমে তার শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন ঠিকভাবে কাজ করে সেগুলো মনিটরিংয়ের মাধ্যমে আমরা ঠিক রাখি। আর দ্বিতীয়টি রিজোনাল অ্যানেসথেসিয়া। এটির আবার একটি হলো সেন্ট্রাল ব্লক, যেটা সিজারিয়ান অপারেশনের ক্ষেত্রে আমরা করে থাকি। তবে, এক্ষেত্রে শরীরের সমস্ত অঙ্গ মনিটরিং করা খুবই জরুরি। আরেকটি লোকাল ব্লক, যেটির মাধ্যমে আমরা ব্লক করে অপারেশন করে থাকি। যেমন আমরা একটা আঙুলে অপারেশন করতে চাই, সেক্ষেত্রে তার নার্ভ ব্লক করে দেই। সেসময় আঙুলে আর ব্যথা পাবে না।’

এ কাজে ঝুঁকি বা কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই থাকে। আপনি নরমালভাবে চলছেন। আপনার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিজস্ব গতিতে চলছে। সেই গতিটা পরিবর্তন করতে হয় ওষুধের মাধ্যমে। সেসময়ে কি পরিমাণ পরিবর্তন করতে হয় এবং ওষুধটা তার শরীরে কাজ করবে কিনা সে নিশ্চয়তা দিতে পারি না। এক্ষেত্রে একটা অঘটনও ঘটতে পারে। সেজন্য ওষুধ দেওয়ার সময় নলেজে থাকতে হবে। কি কি হতে পারে, তা মাথায় নিয়ে ওষুধ দিতে হয়।’

তিনি বলেন, ‘এজন্য একজন অ্যানেসথিওলজিস্টের সঙ্গে একটা সাপোর্টিভ গ্রুপে দক্ষ নার্স থাকতে হয়। কিন্তু সেটা ওয়ার্ডবয় বা অফিস সহায়ক নয়।’

দক্ষ নার্সের জন্য পরিচালক বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে জানিয়ে ডা. হারুনুর রশিদ বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিচালক বরাবরে চিঠি দিয়েছি ওটিতে দক্ষ নার্সের জন্য। কোনভাবেই ওয়ার্ডবয়কে সেখানে অ্যালাউ করা যাবে না।’

অভিযোগের বিষয়ে সুইপার রাজু মজুমদার বলেন, ‘আমি সুইপার হলেও ওটিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করি। ডাক্তার স্যারদের সঙ্গে থেকে রোগীকে অজ্ঞানের কাজে আমাকে সহযোগিতা করতে হয়।’

বকশিস আদায় এবং ওষুধ চুরির বিষয়ে রাজু বলেন, ‘এসব ইনটারনাল বিষয়। এসব ব্যাপারে কথা বলা আমার নিষেধ আছে।’

অফিস সহায়ক মামুন হাসান বলেন, ‘আমি ছুটিতে ছিলাম। আসলে রাজু সুইপার হলেও মেশিনারিজ সেটআপ সে করে। ওটিতে লোকবল কম, তাই সুইপার হলেও তাকেই কাজে লাগাতে হয়।’

ইএনটির সহকারী রেজিস্ট্রার অতনু সাহার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমি অবহিত হলাম। আমি দেখব।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!