চট্টগ্রাম মেডিকেলে রোগীদের খাবার মুখে তোলা যায় না, মাছের ক্যালরি মুরগিতে ‘ম্যানেজ’

ঠিকাদার ও খাদ্যবিভাগের কারসাজি

প্লেটে ডাল ঢাললে সেখানে সাঁতার কাটে ভাত। এক টুকরো মুরগির মাংস কিংবা বিস্বাদ সবজি তখন যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। চট্টগ্রামের প্রধান সরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের অনেকেরই অভিযোগ, প্রতিদিন দুপুর-রাতে মেলে এমনই খাবার। প্রতিদিন রোগী পিছু সরকারি বরাদ্দ ১৮০ টাকারও বেশি। অথচ রোগীরা ১০০ টাকার খাবারই পান কিনা সন্দেহ। তবু এভাবেই চলছে হাসপাতালের আহার। দিনের পর দিন। বছরের পর বছর।

রোগীদের জন্য বরাদ্দ খাবারের তালিকা নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলছে খেয়ালখুশির অদ্ভূত কাণ্ড। পুষ্টিবিদদের পরামর্শ নিয়ে রোগীদের খাদ্যতালিকা নির্ধারিত থাকলেও বাস্তবে রোগীরা খাবার পাচ্ছে ঠিকাদার ও খাদ্যবিভাগের কর্মচারীদের ইচ্ছেমতো। ফলে দেখা যায়, রোগীদের যেখানে মাছ দেওয়ার কথা সেখানে মুরগি দিয়েই দায়সারা হচ্ছে। আবার হৃদরোগী বা ডায়াবেটিক রোগী থেকে শুরু করে সাধারণ রোগীর জন্যও ক্ষতিকর জেনে সবজিতে দেওয়া হয় মুরগির চর্বি। খাবারের মানও খুবই নিম্নমানের, স্বাদহীন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের জন্য বরাদ্দ খাদ্যতালিকায় থাকলেও সচরাচর মাছের দেখাই পায় না রোগীরা। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় দুপুরে মুরগি ও রাতে সপ্তাহে পাঁচ দিন মাছ দেওয়ার কথা থাকলেও সেই মাছের দেখা মেলে সপ্তাহে দু-একদিন। কোনো কোনো সপ্তাহে একেবারেই নয়। রোগীদের অভিযোগ, প্রতিদিন ওই এক বয়লার মুরগি দিয়েই খাবার দেওয়া হয়। অথচ এই করোনাকালে মাছ থাকলে রোগীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়তো।

মাছ ও মুরগির পুষ্টিবিচার

পুষ্টিবিষয়ক ওয়েব জার্নাল থেকে জানা যায়, খাদ্যগুণ এবং রোগ প্রতিরোধকারী মাছের মধ্যে রয়েছে রুই। ১০০ গ্রাম ওজনের রুই মাছে প্রোটিন আছে ১৮.৩৫ শতাংশ, ফ্যাট ৯.৫৬ শতাংশ, জলীয় অংশ ৭৪.৬ শতাংশ, ক্যালসিয়াম ৬৫০ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ২৮৮ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ১০১ মিলিগ্রাম, কলিন ৮১৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সিএমসিজি, ফসফরাস, আয়রন ইত্যাদি পাওয়া যায়। এর তাপমূল্য ৯৭ ক্যালরি। খাওয়ার তিন ঘন্টার মধ্যে হজম হয় এই মাছ।

অন্যদিকে ১০০ গ্রামের মৃগেল মাছে প্রোটিন আছে ১৮.০৭ শতাংশ, ফ্যাট ০.৩৩ শতাংশ, জলীয় অংশ ৭৯.১ শতাংশ, কার্বোহাইড্রেট ৩ শতাংশ, ক্যালসিয়াম ৩৫০ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ২৮০ মিলিগ্রাম, আয়রণ ১.৯ মিলিগ্রাম, কলিন ৪০০ মিলিগ্রাম। মৃগেল মাছ মানবশরীরের পিত্তজনিত বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্ত করে রাখে। অপেক্ষাকৃত কম সময়ের মধ্যে হজম হয়ে থাকে এ মাছ।

অথচ এর বিপরীতে প্রতি ১০০ গ্রাম মুরগিতে পানিই থাকে ৭৪ শতাংশ। এতে ১২১ ক্যালরি, ২০ গ্রাম প্রোটিন, ৪ গ্রাম চর্বি, ১৪ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৭ মিলিগ্রাম লৌহ, ০.১ মিািলগ্রাম ভিটামিন বি-১, ০.১৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-২, ১১ দশমিক ৬ মিলিগ্রাম নায়াসিন থাকে।

রোগীভর্তি বরাদ্দ কতো?

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, রোগীদের জন্য ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়া খাদ্যতালিকায় সকালের জন্য বরাদ্দ ১০০ গ্রামের পাউরুটির দাম রাখা হয়েছে ১০ টাকা ২৫ পয়সা, ডিম ৯ টাকা ৭০ পয়সা, সাগর কলা একটি ৬ টাকাসহ রোগীপ্রতি বরাদ্দ রয়েছে ২৫ টাকা ৯৫ পয়সা।

দুপুরের খাবারে চাউল (পাইজাম), মশুর ডাল, সয়াবিন তেল, পিয়াজ, মটর ডাল, সবজি, মুরগি ও মসলাসহ বরাদ্দ আছে ৫১ টাকা। বিকেলের খাবারে দুধ ও পাউরুটিসহ বরাদ্দ ৫৬ টাকা ৪৫ পয়সা। অন্যদিকে রাতের খাবারে চাল, ডাল মশুর, তেল, পেঁয়াজ, মটর ডাল, সবজি, মসলা, মুরগি (সপ্তাহে ২দিন), মৃগেল মাছ সপ্তাহে একদিন, রুই মাছ সপ্তাহে দুই দিন, নাইলোটিকা সপ্তাহে দুই দিনসহ বরাদ্দ রয়েছে ৪৮ টাকা ৫ পয়সা।

শিশুদের খাবারের তালিকায় তরল দুধ, চিনি, ডিমসহ খাবার ধরা আছে ১২৪ টাকা ৯৮ পয়সা।

তালিকায় আছে, বাস্তবে নেই

সরেজমিন অনুসন্ধান এবং রোগী ও তাদের স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রোগীদের জন্য ওয়ার্ডে পাউরুটি, ডিম নিয়ে আসলেও ঝুড়িতে কলা থাকে না।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের খাদ্যবিভাগ থেকে জেনারেল, কেবিন ও পেয়িং ওয়ার্ডের রোগীদের খাবার দেওয়া হয়ে থাকে। চমেক হাসপাতালের সপ্তম তলায় খাদ্যবিভাগের রেজিস্টার খাতা ঘেটে দেখা গেছে, গত অক্টোবর মাসজুড়ে অল্প কয়েকদিন মাত্র রোগীদের খাবারে মাছ দেওয়া হয়েছে।

রেজিস্টার খাতার হিসাব অনুযায়ী, গত অক্টোবর মাসের ১০ তারিখে দুপুর ও রাতে মুরগি দেওয়া হয়েছে। একই মাসের ১৫ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত টানা কয়েকদিন মুরগি খেতে দেয়া হয়েছে রোগীদের। ২১ থেকে ৩১ তারিখের মধ্যে মাত্র দুইদিন রোগীরা মাছ পেয়েছে।

সবশেষ নভেম্বর মাসের ৭ তারিখে রাতে মাছ, ৮ তারিখে দুপুর ও রাতে মুরগি, ১৯ তারিখেও দুপুর ও রাতে মুরগি এবং ২০ তারিখেও দুপুরে মুরগি ও রাতে মাছ দেওয়া হয়েছে। এর আগে কেবল ১০ তারিখ রাতে মাছ দেওয়া হয়েছিল রোগীদের।

আবার নভেম্বরের ২৩ থেকে ২৮ তারিখের মধ্যে শুধুমাত্র ২৩ তারিখ রাতে মাছ খেতে দেওয়া হয়েছে রোগীদের। ২৯ নভেম্বর রাতে রোগীদের দেওয়া হয়েছে রুই মাছ।

খাদ্যবিভাগ সূত্রে জানা যায়, সবজিতে দেওয়া হয় মুরগির চর্বি। ডাল পর্যাপ্ত দেয়া হলেও তা স্বাদহীন। বয়লার মুরগির মাঝারি সাইজের এক পিস থাকে খাদ্যতালিকায়। কিন্তু সেই মুরগির মাংসে প্রয়োজনীয় মসলা পর্যাপ্ত থাকে না। ডালের মত এ মাংসটাও অনেকটাই স্বাদহীন— অভিযোগ রোগীদের।

রোগীর খাবার নিয়ে নৈরাজ্য

গত রোববার (২৯ নভেম্বর) দুপুরে ১৪ নং মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন নবাব আলীর স্ত্রী জোবায়দা বললেন, ‘হাসপাতাল থেকে দেওয়া খাবার আমার স্বামী খেতে পারে না। মুরগিতে ঝাল একটু কম দিয়ে মসলা দিয়ে রান্না করলে রোগীরা ভালো করে খেতে পারতো। আর প্রতিদিন মুরগি খেতে চায় না আমার স্বামী। প্রায় নয় দিন ভর্তি এ ওয়ার্ডে। মাত্র একদিন মাছ পেয়েছি রাতের খাবারে।’

পুষ্টিবিদদের পরামর্শ না মেনে খাদ্যতালিকা নিয়ে কেন এমন নৈরাজ্য— এমন প্রশ্নে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের খাদ্যবিভাগের স্টুয়ার্ড আ ন ম আব্দুস সাত্তার বললেন, ‘সমস্যা নেই। মাছের ক্যালরি মুরগি দিয়ে ম্যানেজ করা হচ্ছে।’

চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালের পুষ্টিবিদ ইকবাল হোসেন স্পষ্ট করেই বলছেন, ‘মাছের ক্যালরি মুরগি দিয়ে ম্যানেজ করলে তাতে উল্টো রোগীর ক্ষতিই হয়।’

তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিভিন্ন ধরনের রোগী ভর্তি থাকে। তাদের কথা ভেবেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুষ্টিবিদদের নিয়ে খাদ্যতালিকা তৈরি করে। পুষ্টিগুণের কথা মাথায় রেখেই সপ্তাহে পাঁচদিন রোগীদের জন্য খাদ্যতালিকায় মাছ রাখা হয়েছে।’

পুষ্টিবিদ ইকবাল হোসেন বললেন, ‘মাছ ও মাংস দুটোতেই প্রোটিন থাকে। কিন্তু মুরগির প্রোটিন অনেক রোগীর ক্ষেত্রে ভালো ফল দেয় না। তাছাড়া মুরগির চর্বি কখনোই ভালো হয় না। হৃদরোগী, ডায়াবেটিক রোগী থেকে শুরু করে সাধারণ রোগীর জন্য এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষতিকর। তাই মাছ খেতে দেওয়া প্রয়োজন রোগীদের।’

বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মোহাম্মদ আফতাবুল ইসলাম বলেন, ‘খাদ্যতালিকা অনুযায়ী রোগীদের খাবার সরবরাহ করতে ঠিকাদাররা বাধ্য। রোগীরা যেন খাদ্যতালিকা অনুযায়ী খাবার পান সেটা আমি দেখবো।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!