চট্টগ্রাম মেডিকেলে ডাক্তার-নার্সদের ‘করোনাভীতি’র শিকার আগুনে পোড়া রোগীরা

লাঠিতে তুলা বেধে চলে ড্রেসিং, হাসপাতাল ছাড়তে চাপ দেন নার্সরা

অটোরিকশার গ্যারেজে গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণে ভীষণভাবে পুড়ে যায় ওরা ছয়জন। বয়সে সবাই কিশোর। কক্সবাজারের পেকুয়ায় গত শুক্রবারের (২ জুলাই) বিস্ফোরণে গুরুতর আহত এই ছয় কিশোরকে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামে এনে ভর্তি করা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। কিন্তু এমন অসহনীয় ব্যথা নিয়ে বার্ন ইউনিটে ভর্তি হওয়ার পর আগুনে পোড়া এই রোগীদের কাছে ডাক্তার ও নার্স গিয়েছিলেন ঘন্টাখানেক পর। এর কারণ আর কিছু নয়। ডাক্তার-নার্সরা জেনেছিলেন, অগ্নিদগ্ধ ছয় রোগীর মধ্যে দুজনের জ্বর ছিল আগে থেকেই। এতেই করোনাভীতি পেয়ে বসে তাদের।

শেষমেশ পরদিন শনিবার বিকেলে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয় এসব কিশোরকে। নাম যাদের শামীম (১৪), রুহুল আমিন (৪০), নুরুল আলম (১৫), তানিম (১২), তৌহিদ (১৪) ও তারেক (১৩)। ওয়ার্ড থেকে তাদের শুধু জানিয়ে দেওয়া হয়, প্রেসক্রিপশন লেখা ওষুধগুলো কিনে খেতে হবে আর বাড়ির পাশের কোনো ফার্মেসি থেকে পুড়ে যাওয়া স্থানে ড্রেসিং করিয়ে নিতে হবে।

ওই বিস্ফোরণে পুড়ে যাওয়া তৌহিদের ভাই জোবায়ের মুঠোফোনে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার ভাইকে ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করানোর পর সারাদিন কোনো ডাক্তার-নার্স আমার ভাইকে দেখেননি। ওয়ার্ডবয় এসে একটা স্যালাইন পুশ করে দিয়ে চলে যায়। বাধ্য হয়ে আমরা রোগী নিয়ে চলে আসছি। আর নার্সরাও চাপ দিচ্ছিলেন রোগীকে বাড়ি নিয়ে যেতে। আমাদের বলেছে, লকডাউনে ডাক্তার আসবে না। এখন আমার ভাইকে কক্সবাজারে এনে একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করিয়েছি।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে এভাবেই ডাক্তার-নার্সদের করোনাভীতির শিকার হচ্ছে আগুনে পুড়ে চিকিৎসা নিতে আসা গুরুতর রোগীরা। এমনকি ‘করোনা লাগা’র ভয়ে লাঠির সাথে তুলা বেধে রোগীদের ড্রেসিং করানোর মতো অভিযোগও শোনা গেল অহরহ।

৩৬ নং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন সালমা বেগম গ্যাসের আগুনে পুড়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১৪ দিন ধরে। এই ১৪ দিনে তার ড্রেসিং করা হয়েছে মাত্র দুদিন। সালমা বেগম অভিযোগ করে বলেন, তার শরীরে লাঠির সাথে তুলা বেঁধে খোঁচা দিয়ে দিয়ে ড্রেসিং করানো হয়েছে।

আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা জরুরিভিত্তিতে তাৎক্ষণিক দেওয়ার নিয়ম থাকলেও হাসপাতালের ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে সেটি না পাওয়ার অভিযোগই বেশি শোনা গেছে রোগী ও তার স্বজনদের কাছ থেকে। সরেজমিন ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, ডাক্তার-নার্সদের করোনাভীতির শিকার হয়ে আগুনে পোড়া রোগীর বেদনাবিধূর দুর্ভোগের চিত্র।

৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে বেশিরভাগ রোগীকেই তড়িঘড়ি ছাড়পত্র দিয়ে ‘বিদায়’ করায় ওয়ার্ডে এখন রোগী ভর্তি আছে মাত্র ৩০ জন। এর আগে ডাক্তার-নার্সদের করোনাভীতির কারণে রোগী ভর্তিই বন্ধ ছিল পুরোপুরি।

অথচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, আগুনে পোড়া রোগীদের শরীরে জ্বর ও ব্যাথা চলে আসে সাধারণত ঘটনার পরপরই। অনেক রোগীর ঠান্ডাও লেগে যায়। এগুলো সাধারণ উপসর্গ। কিন্তু করোনাভাইরাসের উপসর্গও যেহেতু জ্বর-সর্দি-কাশি, ফলে আগুনে পুড়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলের ওয়ার্ডে আসা রোগীদের চিকিৎসা দিতে বিব্রতবোধ করছেন ডাক্তার ও নার্সরা।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নেই আলাদা করোনা ইউনিট। তাছাড়া হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আগুনে পোড়া রোগীদের করোনার র‍্যাপিড এন্টিজেন টেস্ট করানোরও সুযোগও নেই। ফলে আগুনে পোড়া রোগীরা শিকার হচ্ছেন নারকীয় দুর্ভোগের। চিকিৎসা পেতে দেরি তো হচ্ছেই, ড্রেসিংয়ে অনিয়ম ও তদারকির অভাবেও রোগীরা হাসপাতালে থেকে সুচিকিৎসা পাচ্ছেন না। তাদের অনেকেই আগুনে পোড়া দগদগে শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরে সারাজীবনের জন্য বিকলাঙ্গ হয়ে কপাল পুড়ছেন।

চমেক হাসপাতালের ৩৬ নং বার্ন ইউনিটের নার্স ওয়াসনীর বললেন, ‘আসলে আগুনে পোড়া রোগীদের গায়ে জ্বর ও ব্যাথা চলে আসে। আমরা বুঝতে পারি না এসব রোগীর কে করোনায় আক্রান্ত আর কে আক্রান্ত নয়। করোনা আতঙ্কে আমরা আগের মত নিঃসংকোচে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে পারি না। রোগীর ড্রেসিংসহ অনান্য কাজেও দেরি হয়।’

রোববার (৪ জুলাই) ওয়ার্ড ঘুরে অস্বাভাবিক করোনাভীতির ছাপই শুধু নয়, করোনাকালীন লকডাউনে ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসক ও নার্সদের উপস্থিতিও কম দেখা গেছে। যদিও তারা লকডাউনের আওতামুক্ত।

জানা গেছে, গত জুনে চমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ৭ থেকে ৮ জন রোগীর করোনা ধরা পড়ে। তখন হাসপাতালের পরিচালক ওয়ার্ডের সব রোগীর করোনার নমুনা পরীক্ষার উদ্যোগ নেন। করোনা ধরা পড়লে আগুনে পোড়া দগদগে শরীর নিয়েই চারতলায় আইসোলেশন ওয়ার্ডে চলে যেতে হয় রোগীদের। এরপর থেকে কিছুদিন করোনা ইউনিট থেকে ওয়ার্ডবয়রা এসে করোনার উপসর্গধারী রোগীর নমুনা নিয়ে যেতেন। এর খরচ বহন করতেন রোগীর আত্মীয়স্বজনরাই। এখন সেটিও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আগুনে পোড়া রোগীদের হাসপাতালের নিচে গিয়ে করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়ে আসতে হচ্ছে।

চমেক হাসপাতালের ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের নার্স ইনচার্জ সীমা দে বললেন, ‘আসলে আগুনে পোড়া রোগীদের ওয়ার্ডে ভর্তির পর শারীরিক যেসব সমস্যা দেখা দেয়, তা অনেকটাই করোনার সাথে মিলে যায়। আমরা সন্দেহভাজন রোগীর করোনা পরীক্ষা করাই। পজিটিভ হলে আইসোলেশন ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেই।’

আগুনে পোড়া রোগীদেরকে লাঠির সাথে তুলা বেধে ড্রেসিং করানোর অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘যারা রোগীদের ড্রেসিং করে তারা দুটো গ্লাভস পরে ড্রেসিং করে। তবে করোনার সময়ে একটু সাবধানে থাকতে হয়। আর হাসপাতাল থেকে ড্রেসিংয়ের প্রয়োজনীয় ওষুধ-সরঞ্জামাদি কিছুই সরবরাহ নেই। রোগীদের নিজের থেকে সব কিনতে হয়। তবে আমরা রোগীদের একটু সুস্থ হলে ছাড়পত্র দেওয়ার চেষ্টা করে থাকি। যেমন— ককসবাজার পেকুয়ার রোগীদের আমরা বোঝানোর পর তারা স্বেচ্ছায় ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি চলে গেছে।’

কিন্তু আগুনে পোড়া রোগীদের নিয়মিত ড্রেসিং করা প্রয়োজন। তাহলে এসব রোগীরা কী করবে? এ প্রশ্নের জবাবে সীমা দে বলেন, ‘আমরা রোগীদের বলে দিই বাড়ির পাশের ফার্মেসি থেকে ড্রেসিং করিয়ে নিতে।’

৩৬ নং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন সালমা বেগম বলেন, ‘আমার তিনদিন মাত্র জ্বর ছিল। অথচ ‘করোনা রোগী’ ধরে নিয়ে আমাকে কোনো ডাক্তার-নার্স তিন দিন কোনো চিকিৎসাই দেননি। আমার পোড়া জায়গায় ঘায়ের মত হয়ে গেছে। এখন আমাকে বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। আমি যাইনি। বাড়ি গিয়ে গিয়ে এই লকডাউনে আমি কোথায় ড্রেসিং করাবো?’

পুরো ওয়ার্ড ঘুরে আগুনে পোড়া রোগীদের কাছ থেকে এরকম আরও বিস্তর অভিযোগ শোনা গেছে। তবে সবার অভিযোগের সুর একটিই— করোনা রোগী মনে করে তাদেরকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয় না।

ফটিকছড়ির নাজিরহাটের বাসিন্দা কামরুল হোসেন কাজ করতেন গাড়ির গ্যারেজে। গাড়িতে রং করার সময় গায়ে স্প্রে পড়ে তার শরীর ঝলসে যায়। তিনদিন হল তিনি চিকিৎসাধীন। আগে থেকেই তার গায়ে জ্বর ছিল। সেই জ্বর নিয়ে কাজে গিয়েই দুর্ঘটনার শিকার হন কামরুল। তাকেও প্রথম দুইদিন ফেলে রাখা হয়েছিল ড্রেসিং না করেই।

তবে এসব অভিযোগ আমলে না নিয়ে নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথাই মুঠোফোনে জানিয়েছেন বার্ন ইউনিটের প্রধান ডা. রফিক উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘২৬ শয্যার এই ওয়ার্ডে প্রয়োজনীয় শয্যা ও জনবল বাড়ানো হয়নি। চট্টগ্রাম ছাড়াও কক্সবাজার, তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এবং ফেনী, নোয়াখালী ও সন্দ্বীপ এলাকার লোকজন এখানে চিকিৎসা নিতে আসে। ২৬টি শয্যার বিপরীতে প্রতিদিন এখানে রোগী ভর্তি হয় ৬০ থেকে ৭০ জন।’

জানা গেছে, বর্তমানে বার্ন ইউনিটে একজন সহযোগী অধ্যাপক, একজন সহকারী অধ্যাপক, একজন রেজিস্ট্রার ও দুজন সহকারী রেজিস্ট্রার আছেন। একাডেমিক কার্যক্রমের পাশাপাশি সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপকও চিকিৎসা দেন।

ডা. রফিক উদ্দিনের কথার সূত্র ধরে আরও জানা গেছে, মুমূর্ষু রোগীদের এই বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। কারণ এখানে কোনো আইসিইউ বা ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট নেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে একসময় সার্জারি ওয়ার্ডের একপাশে দগ্ধ রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হতো। এরপর ২০০৮ সালে সার্জারি ওয়ার্ডের এক পাশে ১৩ শয্যার বার্ন ইউনিট চালু করা হয়। ২০১২ সালের ৭ জুন চমেক হাসপাতালের ছয়তলায় প্রসূতি ওয়ার্ডের পাশে একটি বড় কক্ষে ২৬ শয্যায় উন্নীত করে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটটি স্থানান্তর করা হয়। তবে এই ইউনিটে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাব্যবস্থা না থাকায় ঢাকায় নেওয়ার পথেই মারা যাচ্ছে অনেক রোগী।

হাসপাতালের উপ পরিচালক ডা. আফতাবুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার এই সময়ে কোনো রোগী জরুরি বিভাগ দিয়ে ওয়ার্ডে ভর্তি হলে র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট করে করোনা নেগেটিভ-পজিটিভ অবস্থা জানা যায়। কিন্তু আগুনে পোড়া রোগীরা এতো খারাপ অবস্থায় হাসপাতালে আসে, ফলে সেটি করা সম্ভব হয় না।’

তবে ডাক্তারদের এই পরিস্থিতিটুকু মেনেই রোগীর পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা দেওয়া উচিত বলে মনে করেন ডা. আফতাব। তিনি বলেন, ‘চমেক হাসপাতালে আলাদা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে অনেক আগেই। চীন সরকারের সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি চুক্তি হয়েছে। কিন্তু জায়গার সুরাহা না হওয়ায় কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!