চট্টগ্রাম মেডিকেলে কোটি টাকার মেশিন ‘অচল’ দেখিয়ে আবারও কেনার নতুন বায়না

ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (আইসিইউ) সাড়ে ৮২ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি অকেজো ফেলে রেখে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আবারও একই যন্ত্রপাতি কেনার চাহিদাপত্র দিয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে আগের অর্থবছরগুলোতে ব্লাড গ্যাস ইলেক্ট্রোলাইট অ্যানালাইজার উইথ মেটাবোলিটিস (এবিজি) মেশিন কেনা হলেও তার ব্যবহার হচ্ছে না। চট্টগ্রাম মেডিকেলে এমন ছয়টি মেশিন পড়ে রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র একটি ব্যবহার হচ্ছে, বাকিগুলো অচল দেখিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে। এছাড়া সর্বশেষ কেনা মেশিনটি ওয়ার্ডে ফেলে রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে করোনার সময় কেনা মেশিন তিনটির দুটি অকেজো পড়ে থেকে মরিচা ধরেছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেলে ২০২১-২২ অর্থবছরে কেনা যন্ত্রপাতির তালিকায় দেখা গেছে, এবিজি মেশিন বা রক্ত গ্যাস বিশ্লেষক মেশিন ১টি কেনা হয়েছে ৯ লাখ ৬৬ হাজার টাকায়। মেকানিক্যাল ভেন্টিলেটর মেশিন ১টি কেনা হয়েছে ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকায়। এলইডি অপারেশন থিয়েটার (ওটি) লাইট ৪ পিস কেনা হয়েছিল প্রতিটি ১০ লাখ ৭৯ হাজার ৬০০ টাকায়। অন্য ধরনের আরেকটি এলইডি ওটি লাইট কেনা হয়েছিল ১০ লাখ ৮৯ হাজার টাকায়। সব মিলিয়ে এসব মেশিনের দাম ছিল ৮২ লাখ ৪৮ হাজার ৪০০ টাকা।

আইসিইউতে সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, করোনার সময় আইসিইউর জন্য তিনটি এবিজি মেশিন কেনা হয়েছিল। এর আগে ২০১৯ সালে আইসিইউতে দুটো এবিজি মেশিন ছিল। এরপর সর্বশেষ মেশিনটি কেনা হয় ২০২১-২২ অর্থবছরে। ছয়টি মেশিন থাকার পর ২০২২-২৩ অর্থবছরের আরও দুটি মেশিন কিনতে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে কেন্দ্রীয় ওষুধাগারে।

আইসিইউ সূত্রে আরও জানা গেছে, এবিজি মেশিন দিয়ে রক্তের গ্যাস পরীক্ষা করা হয়। রক্তে অক্সিজেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ, রক্তের অম্লতা (pH) পরিমাপ করা হয়। এতে ফুসফুস এবং কিডনি স্বাভাবিক রক্তের pH (অ্যাসিড-বেস) ভারসাম্য বজায় রাখতে একসঙ্গে কতটা ভাল কাজ করে তা জানা যায়।

কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যাপ্ত মেশিন থাকার পরও আইসিইউর ডাক্তাররা এসব পরীক্ষা বাইরের ল্যাবে করানোর জন্য পাঠান।

জানা গেছে, আইসিইউর ভেতরে এই মেশিনে পরীক্ষা করতে রোগীকে গুনতে হয় ৫০০ টাকা। কিন্তু বেসরকারি ল্যাব থেকে করালে ২২০০ থেকে আড়াই হাজার টাকা লাগে।

সোমবার (২৮ নভেম্বর) দুপুরে আইসিইউ ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, ‘এপিক হেলথ কেয়ার’ থেকে দু’জন টেকনোলোজিস্ট এসে আইসিইউতে এক রোগীর এক্সরে পরীক্ষা করছেন। তারা সঙ্গে এনেছেন পরীক্ষার যন্ত্রপাতি। পরিচয় জানতে চাইলে তাদের একজন বলেন, ’আমরা এপিক থেকে আসছি। ওয়ার্ড থেকেই আমাদের আসতে বলা হয়েছে। আমরা এক্সরে পরীক্ষা করছি রোগীর’। তখন এবিজি মেশিনটি ওয়ার্ডের ভেতর সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা।

আইসিইউ ওয়ার্ডের গেটের কাছে অর্ধশতাধিক কার্টন সারি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে রাখা আছে কাপড়ের জুতা। জানা গেছে, করোনাকালীন সময়ে ব্যবহারের জন্য আনা হয়েছিল এসব জুতা। কিন্তু ব্যবহার না হওয়ায় নষ্ট হয়েছে বক্সবন্দি অবস্থায়। এসব জুতা প্রতি পিস ৩০০ টাকায় কেনা হয়েছিল। জুতার বক্সের নিচে পানি জমে পুরো বক্সে গায়ে ছোপ ছোপ দাগ পড়েছে।

এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে মেকানিক্যাল ভেন্টিলেটর মেশিন কেনা হয় ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকায়। কিন্তু আগের অর্থবছরে কেনা তিনটি ভেন্টিলেটর আইসিইউ ওয়ার্ডের পেছনের বারান্দায় ফেলে রাখা হয়েছে।

ওয়ার্ড সূত্রে জানা গেছে, মেশিনগুলোর ওয়ারেন্টির মেয়াদ ছিল এক বছর। কিন্তু সামান্য ত্রুটি দেখা দিলে তা মেরামত না করে বারান্দায় ফেলে রাখা হয়েছে।

কারণ হিসেবে জানা গেছে, সামান্য ত্রুটি দেখা দিলে মেরামত না করে নতুন যন্ত্রপাতি কেনার জন্য চাহিদা পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় ওষুধাগারে (সিএমসিডি)। নতুন অর্থবছরে দুটি মেশিনের চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে।

গত অর্থবছরে এলইডি ওটি লাইট পাঁচটি কেনা হলেও ২০২২-২৩ অর্থবছর আরও ছয়টির চাহিদা দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, প্রতিবছর এ লাইটগুলো কেনা হলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই লাইটগুলোতে ত্রুটি দেখা দেয়। পরে সেগুলো পরিত্যক্ত দেখিয়ে নতুন লাইট ক্রয়ের চাহিদা দেওয়া হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইসিইউর এক চিকিৎসক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘দামি মেশিনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ সঠিকভাবে হলে প্রতিবছর নতুন করে বেশি দামে যন্ত্রপাতি কিনতে হতো না। সরকারি অর্থের সাশ্রয় হতো।’

আইসিইউ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. হারুনুর রশিদ বলেন, ‘যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়ে আমি কিছু বললে বিষয়টি আমার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়।’ তাই তিনি এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলতে অনুরোধ করেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, ‘আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী যন্ত্রপাতির রিকুইজিশন পাঠাই। সতর্কভাবে কয়েকটি বিভাগ মিলে আমরা ক্রয় চাহিদা তৈরি করি।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!