চট্টগ্রাম মেডিকেলে অপারেশনের ওষুধে মাসে ৫ লাখ টাকার বাণিজ্য

স্লিপে বাড়তি ওষুধ লিখে অর্ধেকই হাতানো হয়

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডের অপারেশন থিয়েটার থেকে স্লিপে বাড়তি ওষুধ লিখে প্রতিদিনই বিপুল অংকের ওষুধ হাতিয়ে নেয় একটি চক্র। পরে সেই ওষুধ বাইরে বেচে দেওয়া হয়। প্রতিটি অপারেশনের রোগী থেকে প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা ওষুধ চুরি করা হয়। এভাবে মাসে কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকার ওষুধ চুরি হয় কেবল সার্জারির ওটি রুম থেকেই।

সার্জারি ওয়ার্ডের অপারেশন থিয়েটার (ওটি) যেন ওষুধচোরদের স্বর্গরাজ্য। ওয়ার্ডের কিছু অসৎ আয়া, নার্স থেকে শুরু করে স্টাফরা প্রতিদিন রোগীদের ওষুধ চুরি করে হাসপাতালের আশপাশে দোকানে বেচে দেন। প্রতিটি অপারেশনের রোগী থেকে প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা ওষুধ চুরি করা হয়। গত কয়েক মাসে ওষুধসহ তিনজন স্টাফ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা খেলেও বন্ধ হয়নি চুরি। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নজরদারি থেকে বাঁচতে তাদের সঙ্গে ‘গোপন চুক্তি’ও রয়েছে এই ওষুধ চোরচক্রের।

তবে ওয়ার্ডের স্টাফদের অভিযোগ সার্জারির তিন ওয়ার্ডের সহকারী রেজিস্টারদের দিকে। গত ২১ জুন সার্জারি ওটির অফিস সহায়ক গোলাম রসুল ওষুধসহ ধরা পড়লে তাকে হাসপাতালে দেড় দিন রাখার পর আদালতে চালান করে পুলিশ।

তারও আগে গত ৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মেডিকেলের দুই কর্মচারীকে সাড়ে ৩ লাখ টাকার সরকারি ওষুধসহ আটক করা হয়। তারা হলেন ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের সরকারি স্টাফ আশু চক্রবর্তী ও আউটসোর্সিং কর্মচারী মো. সৈয়দ। ওই ঘটনায় সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মতিউর রহমানকে প্রধান করে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। ওই ঘটনায় হাসপাতালের স্টোর কর্মকর্তা ডা. মো. হুমায়ুন কবির বাদি হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় মামলা দায়ের করেন৷

চট্টগ্রাম মেডিকেলের ২৪ (ইউনিট-এক), ২৫ (ইউনিট-দুই) এবং ২৭ নম্বর (ইউনিট-তিন) ওয়ার্ড নিয়েই সার্জারি ইউনিট। ওয়ার্ডগুলোতে অ্যাপেন্ডিসাইটিস, ব্রেস্ট ক্যান্সার, গলব্লাডারে পাথর, হার্নিয়া, পেটে টিউমার, পিত্তথলিসহ সব ধরনের অপারেশন হয়। সপ্তাহের রোববার ও বুধবার অপারেশন হয় ইউনিট-একের, সোম ও বৃহস্পতিবার ইউনিট-দুইয়ের এবং শনি ও মঙ্গলবার ইউনিট-তিনের। তিন ইউনিটের একমাত্র অপারেশন থিয়েটারটি মেডিকেলের তৃতীয় তলায়।

সার্জারির অপারেশন থিয়েটারে সকালের শিফটে দায়িত্ব পালন করেন অফিস সহায়ক রামকৃষ্ণ। তার সঙ্গে দায়িত্বে আছেন গোলাম রসুল। কিন্তু সম্প্রতি ওষুধ চুরির অপরাধে গোলাম রসুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

সকালে আরও দায়িত্ব পালন করেন সিনিয়র স্টাফ নার্স ইনচার্জ সুমি দে। বিকালে আছেন অফিস সহায়ক শামীমুর রহমান শামীম। অফিস সহায়ক হিসেবে আরও আছেন মো. ইয়াছিন, মো. গোলাম রাব্বী। সকালে সার্জারির (ফিস্টুলা) ওটিতে কাজ করতেন সেলিম। কিন্তু তাকে বিকালের শিফটে আনায় শামীমের সঙ্গে কাজ করছেন। এছাড়া সার্জারির ওটিতে স্পেশাল আয়া এবং ওয়ার্ডবয়ও আছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিদিন সার্জারি ওয়ার্ডে প্রায় ১০টি করে অপারেশন হয়। সেই হিসেবে ছুটির দিন বাদ দিলে মাসে ২৫০টি অপারেশন হয়। এসব অপারেশনে যেসব ওষুধ দেওয়া হয় সেসবের সর্বনিম্ন দাম ৩৫০০ টাকা থেকে শুরু করে অপারেশনভেদে সর্বোচ্চ ১০-১২ হাজার টাকার বেশি পর্যন্ত হয়। গড়ে হিসেবে করলে রোগীপ্রতি অপারেশনে সাড়ে ৪ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। সেই তালিকা থেকে প্রতিটি রোগীর কাছ থেকে গড়ে দুই হাজার টাকার ওষুধ চুরি করে হাসপাতালের নার্স-স্টাফরা। মাস শেষে সেই হিসেব করলে প্রায় পাঁচ লাখ টাকার ওষুধ চুরি হয় সার্জারির ওটি রুম থেকে।

সার্জারির ওটি থেকে বেশিরভাগ চুরি হয় সেলাইয়ের সুতা, নিসিপোর (নিসিবান) টেপ, দামি ইনজেকশন, গ্লাভস, ব্রুরেট সেটসহ দামি এন্টিবায়োটিক ওষুধ।

২৭ নম্বর ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স প্রণতি চৌধুরী বলেন, ‘সার্জারির জন্য মূলত সেলাইয়ের সুতা, পিন, thiopental, ultracaine heavy injection, saxa, fentanyl, gloves, disposable plastic syringe, catheter, urine bag, metro injection, saline। এসব ওষুধের দাম পড়ে ১৫০০ থেকে ১৭০০ টাকা।’

সার্জারির ওটির ডাক্তারদের বেশকিছু প্রেসক্রিপশন করা ওষুধের তালিকা চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে এসেছে। একইসঙ্গে যেসব দোকান থেকে ওষুধগুলো কেনা হয়েছে তার রশিদও সংরক্ষণ করা হয়েছে।

২৭ নম্বর ওয়ার্ডে বাঁশখালী থেকে চিকিৎসা নিতে এসেছেন আলেফা খাতুন (ছদ্মনাম)। প্রায় ২২ দিন তিনি এই ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন। ব্রেস্টে পানি জমায় তার অপারেশন করেছে ডাক্তার। আলেফার স্বামী রহিম জানান, গত এক মাসে অপারেশন ছাড়া খরচ হয়েছে প্রায় ৬৫ হাজার টাকা। এরপর তিনবার অপারেশন হয়েছে। স্ত্রীর অপারেশনের টাকা জোগাড় করতে তিনি বিদেশ থেকে ছুটিতে এসেছেন। ওষুধ খরচসহ তিনবার অপারেশনে খরচ হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার টাকা।

এছাড়া অনেক সময় রোগীদের ওটিতে নিয়ে গিয়েও ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পিছিয়ে দেওয়া হয় অপারেশনের তারিখ। আর ওটিতে যাওয়ার আগে রোগীর ওষুধ কিনে রাখতে হয়। যদি অপারেশন পিছিয়ে দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে কেনা ওষুধগুলো ফেরত দেওয়া হয় না। আবার যেদিন অপারেশনের তারিখ নির্ধারণ হয় সেদিন আবারও ওষুধ কিনে দিতে হয় রোগীদের। এভাবে রোগীদের ভোগান্তিতে ফেলে ওষুধ চুরি করে হাসপাতালের কর্মচারীরা।

এমনই অভিযোগ করেন ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের এক রোগীর স্বজন রবিউল ইসলাম। তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার ভাইকে হার্নিয়া অপারেশনের জন্য পরপর দু’বার নিয়ে যায় ওটিতে। নিয়ে যাওয়ার সময় ওষুধ কিনে আনতে লিস্ট দেয় তারা। ওষুধ কিনে এনে দেওয়ার পর কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাকি আছে, পরের সপ্তাহে অপারেশন হবে বলে জানায় ওটির অফিস সহায়ক ও নার্স। আমাকে আর ওষুধগুলো ফেরত দেয়নি।’

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, অপারেশনের দিন রোগীকে ওয়ার্ড থেকে ওটিতে আনা হয়। এর আগে রোগীর স্বজনদের ইউনিটের সহকারী রেজিস্টার ওষুধের স্লিপ দেন। সেই ওষুধ এনে জমা দিতে হয় সিনিয়র স্টাফ নার্স সুমি দে ও দায়িত্বরত অফিস সহায়কদের। ডাক্তার অপারেশনের জন্য প্রয়োজন মতো ওষুধ নেওয়ার পর বাকিগুলো দেন নার্স ও অফিস সহায়কদের। নার্স সুমি দে ও অফিস সহায়করা ভাগ-বাটোয়ারা করে ব্যাগে করে বিভিন্ন কৌশলে হাসপাতালের বাইরে নিয়ে আসেন ওষুধগুলো।

এভাবে হাসপাতাল থেকে রোগীর ওষুধ চুরি হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নীরব।

নীরবতার কারণও খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সার্জারির ওটির স্টাফদের একটা গোপন চুক্তি থাকে। মাস শেষে একটা মোটা অংকের টাকা দিতে হয় তাদেরও। টাকা না দিলেই সার্জারি ওটির কর্মচারীরা ধরা পড়েন তাদের হাতে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে গোপন চুক্তির বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় পাঁচলাইশ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাদেকুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘এ রকম হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা তথ্য-প্রমাণ পেলেই ওষুধ চোরদের ধরার চেষ্টা করি।‘

এদিকে ওষুধ চুরির অভিযোগ অস্বীকার করে সিনিয়র স্টাফ নার্স সুমি দে বলেন, ‘আমরা রোগীদের ওষুধ লিখেও দিই না এবং অপারেশনের পর ওষুধ রাখিও না। ডাক্তার রোগীর ওষুধ লিখে দেন। রোগী ওষুধ কিনে ডাক্তারকে বুঝিয়ে দেন। তাহলে ওষুধ কারা চুরি করছে আপনারা বলেন।’

স্টাফদের করা অভিযোগের বিষয়ে জানতে সহকারী রেজিস্টার ডা. জামশেদ গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা রোগীদের যেসব ওষুধ লিখে দেই, তা না লাগলে আমরা ফেরত দেই।’

এ বিষয়ে আরও কিছু জানতে চাইলে তিনি হাসপাতালের পরিচালক ও বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে যোগোযোগ করতে বলেন।

সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. মতিউর রহমান বলেন, ‘ওষুধ চুরির ঘটনায় হাসপাতালের স্টাফ আটকের পর আমরা ত্রুটিগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। কোন প্লাটফর্ম থেকে ওষুধগুলো চুরি হচ্ছে, সেটা চিহ্নিত করায় আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।’

ত্রুটিগুলো খুঁজে বের করতে কতদিন সময় লাগতে পারে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!