চট্টগ্রাম মেডিকেলের জায়গা কর্মচারীদের দখলে, ঘর তুলে চলছে ভাড়ার ব্যবসা

বেদখলে বন্ধ দুটি ইউনিটের নির্মাণকাজ

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে গোঁয়াছিবাগানের চতুর্থ শ্রেণির স্টাফ কোয়ার্টার। ৯ বছর আগে কোয়ার্টারের পাঁচটি ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হলেও এখনও অনেক স্টাফ জায়গা দখল করে ঘর বানিয়ে ভাড়ায় খাটাচ্ছেন। আবার অনেকে অন্য জায়গায় সরকারি বাসা বরাদ্দের পরও গোঁয়াছিবাগানেও দখল করে রেখেছে জায়গা। মেডিকেলের প্রায় ৯ একর জায়গা এভাবে দখল করে রেখেছে অধিকাংশ কর্মচারী। রাত হলে এখানে জমজমাট হয়ে ওঠে মাদক ও জুয়া আসর।

এ জায়গায় চীন ও জাপান সরকারের অর্থায়নে পৃথক দুটি ইউনিট নির্মাণ করার কথা ছিল। কিন্তু একই জায়গায় দুটি ইউনিটের জন্য জায়গা বরাদ্দ নিয়ে জটিলতার তৈরি হয়। এ কারণে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং ইউনিট এবং চীন সরকারের অর্থায়নে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট নির্মাণের প্রায় ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প আটকে যায়। এসব বেদখল জায়গা উদ্ধার করা গেলে দুটি ইউনিটের জন্য জায়গা বরাদ্দও সহজ হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

এছাড়া একটি ২০ তলা ভবন নির্মাণের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ১০০০ শয্যার নতুন এ ভবন গোঁয়াছিবাগান এলাকায় স্থাপনের জন্য হাসপাতালে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসানের স্বাক্ষরিত চিঠি গত ১৬ মে স্বাস্থ্য অদিধপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) বরাবর পাঠানো হয়েছে। ভবনের ফ্লোর বিন্যাসসহ (কোন ফ্লোরে কোন ওয়ার্ড) অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংযুক্ত করা হয়েছে প্রস্তাবনায়।

জানা গেছে, ২০১৩ সালে গোঁয়াছিবাগানের কোয়ার্টার পরিত্যক্ত ঘোষণা করে হাসপাতাল ও গণপূর্ত কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এর আগে থেকেই বছরের পর বছর এসব সম্পদ ভোগদখল করে যাচ্ছেন অবৈধ দখলদাররা। এরপর ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল হাসপাতালের টিম লিচুবাগান, মসজিদ কলোনি ও গোঁয়াছিবাগান স্টাফ কোয়ার্টার এলাকা থেকে অবৈধ বসবাসকারীদের সরে যেতে মাইকিং করে। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। এখনও বহাল তবিয়তে আছেন দখলদাররা।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নামে অধিগ্রহণ করা ৮০ দশমিক ৮৩৬ একর ভূমির মধ্যে বর্তমানে ৭২ একর জমি হাসপাতালের দখলে আছে। অবশিষ্ট ৮ দশমিক ৮৩৬ একর সম্পত্তি বেদখল হয়ে আছে। যার বাজার মূল্য আট কোটি টাকার বেশি। ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ অধ্যক্ষের কার্যালয়ে এক সভায় বেদখল হওয়া ৮ দশমিক ৮৩৬ একর ভূমি উদ্ধার, সীমানা নির্ধারণসহ সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, বিদ্যুতের বকেয়া বিল আদায় ও আলাদা ট্রান্সফরমার স্থাপনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ কাজে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনও সহায়তার আশ্বাস দেন। কিন্তু সে কাজ আর এগোয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালে কর্মরত ১৫০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। এরমধ্যে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির স্টাফদের জন্য ৮৯টি স্টাফ কোয়ার্টার রয়েছে। হাসপাতালের লিচুবাগান ও মসজিদ কলোনিতে এসব কোয়ার্টার। তবে হাসপাতালের বেদখল সম্পত্তির বেশিরভাগ রয়েছে গোঁয়াছিবাগান এলাকায়। ২০১৩ সালে কোয়ার্টারের ভবনগুলো পরিত্যক্ত ঘোষণার পর দখলদাররা নিজ উদ্যোগে বাসাবাড়ি নির্মাণ করে থাকছেন। ২ নম্বর গেটের সিঅ্যান্ডবি কলোনিতে সরকারির বাসা বরাদ্দ থাকলেও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কেউ কেউ গোঁয়াছিবাগানেও নিজ নামে বাসা বরাদ্দ রেখেছেন। আবার কেউ নিজে না থেকে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন।

গোঁয়াছিবাগানে কাঁচা-পাকা মিলে প্রায় ১০৯টি ঘর রয়েছে। আগে এখানকার বিদ্যুৎ সংযোগ হাসপাতালের মাদার মিটার দিয়ে দেওয়া হতো। তখন মিটারগুলোর বিল হাসপাতালের নিয়মিত বরাদ্দ থেকে পরিশোধ হতো। পরে হাসপাতাল, স্টাফ কোয়ার্টার ও গোঁয়াছিবাগানের বিল মিলে বেশি টাকা আসলে তা পরিশোধে জটিলতা তৈরি হয়। এরপর গোঁয়াছিবাগানের প্রায় ৩৪ লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়লে পিডিবি লাইন কেটে দেয়। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, পিডিবি ও নগর প্রশাসন বৈঠক শেষে আলাদা ট্রান্সফরমার স্থাপন করে। কিস্তিতে বিল পরিশোধ হলে নতুন মিটার স্থাপনের পর লাইন সচল করা হয়।

আরও জানা গেছে, একই নামে সিঅ্যান্ডবি ও গোঁয়াছিবাগানে দুটি সরকারি বাসা ভোগদখল করছেন বেশ কয়েকজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। তাদের মধ্যে পরিচ্ছন্নতাকর্মী ইব্রাহীম গোঁয়াছিবাগানে ১৩৩ নম্বর ঘরটি বরাদ্দ পেয়েছেন। পরিচ্ছন্নতাকর্মী হলেও তিনি বসেন মানসিক বিভাগে টিকিট কালেক্টর হিসেবে। তার সিঅ্যান্ডবি কলোনিতেও বাসা বরাদ্দ আছে। এখানকার বাসা ভাড়ায় দিয়ে তিনি থাকেন সিঅ্যান্ডবিতে।

হিসাবরক্ষক অফিসে কর্মরত ওয়ার্ডবয় মামুনুল কবিরের নামে গোঁয়াছিবাগানে ১৫৯ নম্বর বাসা বরাদ্দ থাকলেও তার নামে সিঅ্যান্ডবিতেও আরেকটি বাসা আছে। তিনিও এখানকার বাসা ভাড়ায় দিয়ে থাকেন সিঅ্যান্ডবিতে।

একইভাবে রেডিওলজি বিভাগের ওয়ার্ডবয় শাহজাহান, ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের অফিস সহায়ক মিলন, হিসাবরক্ষণ বিভাগের অফিস সহকারী সুলতানা, পরিচালক অফিসের অফিস সহকারী আবুল মোরশেদ, চক্ষু বহির্বিভাগের গার্ড সোহেল দাশ বাপ্পা, অফিস সহায়ক আব্দুস সাত্তার, আজগর আলীর নামে গোঁয়াছিবাগান ও সিঅ্যান্ডবিতে ঘর বরাদ্দ আছে। তারা প্রত্যেকে গোঁয়াছিবাগান এলাকার ঘর ভাড়ায় দিয়ে রেখেছেন।

হাসপাতালের কর্মচারী ছাড়াও বহিরাগতরাও থাকছেন এখানে এসে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রধান পুরুষ ছাত্রাবাস পেরিয়ে অনেকে পাহাড় কেটে বানিয়েছেন ঘর-বাড়ি। এমন বহিরাগতদের তালিকায় আছেন মো. আনিছ, রাজ্জাক, মোল্লা হাসেম, আনিছ, মো. শাহ আলম, মো. ওলি, লেদু, মানিক, সুকুমার, বশর, সবজি লিটন, পিরুজা, মোহা. হাবিব, মফিজ, লিটন, বাবুল, বদি আলম, এরশাদ, নূরজাহান, রূপন, পুতুল ড্রাইভার, রতন নাথ, দয়াল হরি।

এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম মেডিকেলের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ শুরু হলে গোঁয়াছিবাগানে যারা ঘর তুলেছেন, তারা ১০ দিনের নোটিশে জায়গা ছাড়বেন। আমাদের কাছে লিখিত জমা দিয়ে রেখেছেন তারা। বিভিন্ন অভিযোগই আমার কানে আসে, এখানে যেসব স্থাপনা তা অনেক আগের। তাই সুশৃঙ্খলতা ফেরানো খুব কঠিন। তারপরও আমি চেষ্টা করছি শৃঙ্খলা ফেরাতে।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!