চট্টগ্রাম বন্দরের ‘ভুলে’ বড় সঙ্কটে পড়তে পারে বাংলাদেশের রপ্তানি ব্যবসা

নিষিদ্ধ বিদেশি কোম্পানিকে কাজ দিতে মরিয়া একটি মহল

নিষিদ্ধ প্রতিষ্ঠান থেকে স্পর্শকাতর স্ক্যানার কেনার ‘অতি উৎসাহ’ দেখাতে গিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যকেই সংকটে ফেলে দিতে চলেছে— এমন অভিযোগ উঠেছে। কারণ বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেই হয়ে থাকে। রপ্তানিযোগ্য সব কনটেইনারই যেহেতু স্ক্যানিং করা বাধ্যতামূলক, সেক্ষেত্রে কালো তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির সরবরাহ করা স্ক্যানারের স্ক্যানিং রিপোর্ট ওইসব দেশে গ্রহণ নাও করা হতে পারে। ফলে রপ্তানি বাণিজ্যই পড়ে যেতে পারে গভীর সংকটে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কালোতালিকাভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য স্ক্যানিং মেশিন সংগ্রহের কারণে এমন সংকট তৈরি হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর এর আগেও নিষিদ্ধ ওই কোম্পানি থেকে স্ক্যানিং মেশিন সংগ্রহ করেছিল। এই দফায়ও সেখান থেকেই এ ধরনের মেশিন চট্টগ্রাম বন্দরে আনার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।

দুর্বল নিরাপত্তা ও স্ক্যানিংয়ের অভিযোগে ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াসহ গোটা ইউরোপ বাংলাদেশ থেকে আকাশ ও নৌপথে পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় সেই নিষেধাজ্ঞা ওঠে যাওয়ার পর ফের চট্টগ্রাম বন্দরসহ দেশের বিমানবন্দরগুলোতে এবার বিশেষ অডিট অভিযান শুরু করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এই অডিটে পণ্য স্ক্যানিংকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কারণ দুর্বল স্ক্যানিংয়ের কারণে রপ্তানি পণ্যের সঙ্গে বিস্ফোরক বা মাদক সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে ঢোকার আশঙ্কা রয়েছে।

এখন স্ক্যানিং ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চলমান অডিটে যদি আপত্তি তোলা হয়, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো তো বটেই, রপ্তানির বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রেও বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য বড় সংকটের মুখে পড়ে যেতে পারে— এমনই শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল থেকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কালো তালিকাভুক্ত কোম্পানি থেকে স্ক্যানার মেশিন সংগ্রহ করা হলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যই হুমকির মুখে পড়ে যেতে পারে। ওই কোম্পানির সরবরাহ করা স্ক্যানিং মেশিনের রিপোর্ট যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে গ্রহণযোগ্য না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

জানা গেছে, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে মোট সাতটি স্ক্যানার মেশিন রয়েছে। এসব মেশিন সরবরাহ করে চীনা কোম্পানি নাকটেক কোম্পানি লিমিটেড। দেড় বছর আগে আরও ছয়টি স্ক্যানার ক্রয় এবং পাঁচ বছর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলেও এখন পর্যন্ত সেটা ঝুলে আছে। অভিযোগ রয়েছে, বন্দর কর্তৃপক্ষের পছন্দের কোম্পানি সর্বনিম্ন দরদাতা না হওয়ায় কার্যাদেশের সেই প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। জানা গেছে, সেই দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ১০৫ কোটি টাকা বেশি দাম রেখেও বিদেশি বিশেষ কোম্পানিটিকে কাজ দিতে আগ্রহ দেখায় বন্দর কর্তৃপক্ষ।

এরই মধ্যে গত ২১ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আরও দুটি কনটেইনার স্ক্যানিং মেশিন কেনার উদ্যোগ নিয়ে দরপত্র আহ্বান করে। ওই দুটি মেশিন কেনার জন্য বন্দর কতৃ‌র্পক্ষ এমন কিছু শর্তারোপ করেছে, যাতে নির্দিষ্ট একটি কোম্পানি ছাড়া আর কেউ অংশ নিতে না পারে। এছাড়া স্ক্যানার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে ১০ বছর। কিন্তু আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী এটি তিন থেকে পাঁচ বছর হওয়ার কথা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্দিষ্ট একটি কোম্পানিকে সুবিধা দিতেই দরপত্রে নানা শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, সর্বশেষ দুটি স্ক্যানার মেশিন কেনার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ যে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে, তা নিয়ে গত ৬ এপ্রিল প্রি-টেন্ডার মিটিং ডাকা হয়। সেখানে দরপত্র নেওয়া সব প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়।

ওই বৈঠকে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে কালো তালিকাভুক্ত একটি বিদেশি কোম্পানিকে অনৈতিক সুবিধা দিতেই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ রীতিমতো কোমর বেঁধে নেমেছে। পক্ষপাতমূলক ও অতিরিক্ত বেশ কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে, যাতে অন্য কোনো কোম্পানি সেই দরপত্রে অংশ নিতে না পারে। তারা অভিযোগ করে, এর আগেও স্ক্যানার কিনতে গিয়ে বিশেষ ওই কোম্পানিকে সুবিধা দেওয়ার জন্য এ ধরনের শর্ত আরোপ করেছিল চট্টগ্রাম বন্দর।

চট্টগ্রাম বন্দরে অনুষ্ঠিত প্রি-টেন্ডার মিটিংয়ে সুনির্দিষ্টভাবে এমন সব অভিযোগ ওঠার পর বন্দর কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে দরপত্রের শর্ত সংশোধনের আশ্বাস দেয়। তবে শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে, বন্দর কর্তৃপক্ষ কোনো কিছু সংশোধন না করেই বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের লিখিত অভিযোগের পাশে ‘নট অ্যাকসেপটেড’ লিখে সেগুলো বাতিল করে দিয়েছে।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য দুটি কনটেইনার স্ক্যানিং মেশিন কিনতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস প্রস্তাব আহ্বান করেছিল। এরপর চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস কর্তৃপক্ষ বাজারমূল্যের চেয়ে প্রায় দেড়শ কোটি টাকারও বেশি দামে স্ক্যানিং মেশিনগুলো সরবরাহের জন্য চীনা কোম্পানি নাকটেককে মনোনীত করলে শেষ পর্যন্ত সেটা গড়ায় আদালত পর্যন্ত। সেই জটিলতা এখনও কাটেনি।

পরে ২০১৯ সালেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ১৪টি স্ক্যানার মেশিন কেনার প্রক্রিয়া শুরু করে। সেবারও বিদেশি বিশেষ কোম্পানিকে কাজটি দেওয়ার জন্য ওঠেপড়ে লাগে একটি মহল। তবে পরে আপত্তির মুখে সেই তৎপরতা থেমে যায়।

জানা গেছে, যে কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ওঠেপড়ে লেগেছে, সেই বিদেশি কোম্পানিটি সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বলেছে, কোম্পানিটি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা এবং বৈদেশিক নীতির জন্য ক্ষতিকর। মালয়েশিয়া সরকারও সেই কোম্পানিকে ১০ বছর আগে সেই দেশে নিষিদ্ধ করে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!