অন্য দুই-চারজন কিশোরের মতো সবকিছু স্বাভাবিক চলছিল কিশোরী ময়ূরীরও। কিন্তু পিতার দ্বিতীয় বিয়ের পর বিপর্যয় নেমে আসে ময়ূরী বেগমের জীবনে। পিতা আমির হোসেন দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে লক্ষীপুর জেলার রায়পুর থানার বাবুরহাট এলাকায় বসবাস শুরু করেন। তিন সন্তানের একজন আরাফাতকে নিয়ে যান নিজের কাছে। ময়ূরী আর তার ছোট ভাই রিফাতকে নিয়ে নগরীর পুরাতন চান্দগাঁও থানা এলাকায় বসবাস করেতেন মা গুলনাহার বেগম। গত ২৪ আগস্ট এক মর্মন্তুদ ঘটনায় মা গুলনাহার ও ভাই রিফাত খুন হয়ে যায় চান্দগাঁওয়ের বাসার ভেতরেই। সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া অসহায় ময়ূরীর পাশে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের উদ্যোগে বিনা খরচে আইনি সহায়তা নিয়ে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন—বিএইচআরএফ।
জানা গেছে, প্রায় ২০ বছর আগে লক্ষীপুরের ছেলে আমির হোসেনের বিয়ে হয় চকবাজার থানার ঘাসিয়াপাড়া এলাকার ছিদ্দিক আহমেদের মেয়ে গুলনাহার বেগমের। তাদের সংসারের প্রথমে মেয়ে ময়ূরী, পরে ছেলে আরাফাত ও শেষে রিফাতের জন্ম। প্রায় সাড়ে ছয় বছর আগে রিফাতের বয়স যখন আড়াই বছর, তখন আমির হোসেন চলে যান গ্রামের বাড়িতে। স্ত্রী-সন্তানের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আমির হোসেনের। শহরে থাকা গুলনাহার বেগম অনন্যোপায় হয়ে মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ শুরু করেন। মায়ের পক্ষে সংসার চালাতে যখন কষ্ট হচ্ছিল, তখন ময়ূরী কাজ নেন আজিম গ্রুপের গার্মেন্টসে। মাস শেষে পাওয়া বেতন তুলে দিতেন মায়ের হাতে। মা শুরু করলেন নাস্তার ব্যবসা। বাসায় সিঙ্গারা, সমুচা তৈরি করতেন। আর তার পাতানো ভাই মো. ফারুক তা বিক্রি করতেন। তবে টাকা-পয়সার হিসাব নিয়ে দুজনের ঝগড়া ছিল নিয়মিত বিষয়।
পাতানো ভাই ফারুক বহদ্দারহাট খাজারোড এলাকার সিরাজ কসাইয়ের ছেলে। পেশায় ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি ফারুক অবসর সময়ে গুলনাহারের বানানো নাস্তা বিক্রি করতো। লকডাউনের সময়েই একইভাবে বিরিয়ানি বিক্রি করছিল ফারুক। টাকা পয়সা নিয়ে ঝগড়া হলে সবাইকে মেরে আমির হোসেনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকিও দিতো ফারুক। কিন্তু হুমকি যে ফারুক সত্যিকার রূপ দেবে— তা হয়তো কখনও ভাবেননি নিহত গুলনাহার বেগম। একদিন সত্যি সত্যিই ঘাতক ফারুকের ছুরির আঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যান ময়ুরীর মা গুলনাহার ও ভাই রিফাত।
গুলনাহার আর রিফাতের খুনের পর দুই কূল হারিয়ে মাঝ দরিয়ায় ভাসছে ময়ূরীর ভাগ্যনৌকা। বৃহস্পতিবার (১ অক্টোবর) ভোরে খুনি ফারুককে আটক করে দুপুর ১টায় সংবাদ সম্মেলন করে র্যাব। র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে ময়ূরী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বেশ দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করেন— ‘আমার মা-ভাইয়ের খুনির ফাঁসি চাই। আমি আর কিচ্ছু চাই না।’
খবর নিয়ে জানা গেছে, ময়ূরীর মা খুন হওয়ার পর থেকে আশ্রয় নিয়েছেন নিজের একমাত্র খালা রোজী আক্তারের কাছে। রোজী আক্তারও আবার তার জেঠার আশ্রয়ে আছেন। এই অবস্থায় মামলার শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার শক্তি তার থাকবে কিনা এবং ভবিষ্যতে যদি তার বিবাহিত জীবন শুরু হয়, তখন স্বামী পক্ষ মামলা পরিচালনার ভার নেবে কিনা— এমন প্রশ্নও ওঠে। এই প্রশ্নে নির্বাক রোজী আক্তার ও ময়ূরী বেগম।
ময়ূরীর পক্ষে আইনি লড়াইয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন—বিএইচআরএফের ট্রাস্টি ও চট্টগ্রাম সভাপতি এডভোকেট জিয়া হাবীব আহসানের সঙ্গে। তিনি বললেন, চট্টগ্রাম প্রতিদিনের মতো একটি প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে এমন প্রস্তাব পেয়ে হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন অবশ্যই খুনের শিকার গুলনাহার বেগম ও শিশু রিফাতের পরিবারের পক্ষে বিনা খরচে আইনি সহায়তা প্রদান করবে।
ভিকটিমের পরিবারের জন্য আইনি সহায়তার এই পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়ে র্যাব-৭-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মশিউর রহমান জুয়েল বলেন, ‘এটি একটি অনন্য পদক্ষেপ এবং দায়িত্বের চেয়েও বেশি কিছু। কারণ আমরা অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে আইনের হাতে সোপর্দ করে আমাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করছি। আদালতে যখন বিষয়টি উত্থাপিত হবে তখন সেখানে ভিকটিমের সহায়তার দরকার হবে। চট্টগ্রাম প্রতিদিনের মাধ্যমে ভিকটিমের পরিবার এমন একটি দৃঢ় আইনি সমর্থন পেলে বিচারিক কার্যক্রম কোন পর্যায়ে ব্যাহত হওয়ার আর কোনো সুযোগ থাকবে না।’
প্রসঙ্গত, ২৪ আগস্ট সন্ধ্যায় চান্দগাঁও ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের বিপরীতে রমজান আলী সেরেস্তাদারের বাড়ি এলাকার ভাড়াটিয়া গুলনাহার বেগম ও তার ছেলে রিফাতকে খুন করে পাবর্ত্য জেলা খাগড়াছড়িতে গা ঢাকা দেয় খুনি ফারুক। খাগড়াছড়ি থেকে একপর্যায়ে ঢাকায় পাড়ি জমায় ফারুক। ঢাকায় গিয়ে বিভিন্ন মাজারেও আশ্রয় নেয়। শেষে ওয়ার্কশপে কাজ নেয়। কিন্তু ৩৭ দিনের মাথায় ফারুক চট্টগ্রাম ফিরলে বৃহস্পতিবার (১ অক্টোবর) ভোর রাতে র্যাব তাকে আকবরশাহ থানার পাক্কারমাথা থেকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে।
আইনি সহযোগিতা পাওয়ার নিশ্চয়তা পেয়ে আপ্লুত ময়ূরী বেগম বলেন, ‘মা-ভাই সব হারিয়ে আমি কুলহারা চরম অসহায়। আপনারা পাশে থাকলে আমি আমার মা এবং ভাই এর বিচার পাব এই বিশ্বাস রাখি। বিচার শেষ হওয়া পর্যন্ত আপনারা আমার পাশে থাকবেন। আমাকে সাহস যুগিয়ে যাবেন, সহযোগিতা করবেন।’
এফএম/সিপি