চট্টগ্রাম নগরে নারী হাইজ্যাকারের বড় চক্র, অবিশ্বাস্য সব কৌশলে ছিনতাই

ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া ও কুষ্টিয়া থেকে আসা নারীরাই চট্টগ্রামজুড়ে সক্রিয়

নিত্যনতুন ভঙ্গি আর অভিনব সব কৌশল— চট্টগ্রামে নারী ছিনতাইকারীদের মূল অস্ত্রই এটা। তারা নিজেরা নারী, আবার তাদের টার্গেটও থাকে নারীই। চট্টগ্রাম নগরীর ব্যস্ত সড়কগুলোতে সুবিধামতো জায়গায় অবস্থান নেয় তারা। সাধারণত সড়কে একাকী চলাফেরা নারীদেরই তারা টার্গেট করে। সেই টার্গেটকে আগে থেকেই অনুসরণ করতে থাকে তারা। মুহূর্তেই কৃত্রিম জটলা তৈরি করে চোখের পলকে ছিনিয়ে নেয় সর্বস্ব। সবকিছু এতো নিখুঁতভাবে হয় যে, ছিনতাইয়ের শিকার নারীরাও ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেন না— কি থেকে কী হয়ে যাচ্ছে! সংঘবদ্ধ এই নারী ছিনতাইকারী দলের হাতে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে অনেকেই।

ধূর্ত এই নারী ছিনতাইকারীরা টার্গেট করা মেয়েদের পিছু নিয়ে চোখের পলকে চারপাশ থেকে ঘিরে এমনভাবে ঘিরে ফেলে, বাইরে থেকে কারও বোঝার উপায়ই থাকে না। পথেই শুধু নয়, আছে অন্য কৌশলও। যাত্রীবেশে গাড়িতে উঠে অন্য যাত্রীর গায়ের ওপর বমি করার অভিনয় করে টার্গেট করা যাত্রীকে প্রথমে অপ্রস্তুত করে ফেলে তারা। এরপর তার গয়নাগাটি ছিনতাই করে অভিনব কৌশলে।

বিস্ময়করভাবে চট্টগ্রাম নগরীতে গত কয়েক বছর ধরে পুলিশের হাতে ধরা পড়া বেশিরভাগ নারী ছিনতাইকারীর বাড়িই ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে। এদের প্রায় সকলেই পরস্পরের আত্মীয়। আবার কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থেকে আসা নারী ছিনতাইকারীরাও সক্রিয় রয়েছে চট্টগ্রাম নগরীতে।

রোববার (২৬ সেপ্টেম্বর) দুপুর দেড়টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরছিলেন রিফাত শামীম। লালদীঘি ওরিয়েন্ট টাওয়ারের সামনে পৌঁছানোর পর রাস্তার পাশে হঠাৎ তাকে ঘিরে ফেলেন কয়েকজন নারী। বুঝতে পারেন ছিনতাইচক্রের কবলে পড়েছেন তিনি। অভিনব কৌশলে রিফাতকে আটকে রেখে ভয়ভীতি দেখিয়ে তার গলায় থাকা স্বর্ণের চেইনটি নিয়ে পালিয়ে যান ওই নারীরা। পরে ভুক্তভোগী কোতোয়ালী থানায় অভিযোগ করেন। অভিযোগের সূত্র ধরে সোমবার (২৭ সেপ্টেম্বর) নগরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে আটক করা হয় তিনজনকে। এরা হলেন কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানা গোপালপুর কুড়িপাড়া মজিদ চেয়ারম্যান বাড়ির সুজন শেখের স্ত্রী পাপিয়া বেগম (৪১), ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর ধরমন্ডল পোকন চন্দ্র বাড়ির বাদলা মিয়ার স্ত্রী রুমা আকতার (২৬) এবং একই জেলা ও থানা এলাকার দৌলতপুর তাজু মেম্বার বাড়ির মো. সেলিমের স্ত্রী জোসনা বেগম (২৫)। আটক তিনজনই চট্টগ্রামের বন্দর ও কোতোয়ালী থানা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। এর মধ্যে পাপিয়া বেগমের বিরুদ্ধে কোতোয়ালী ও চাঁন্দগাও থানায় দ্রুত বিচার আইনে দুটি এবং পাঁচলাইশ থানায় একটিসহ মোট তিনটি মামলা আছে আগে থেকে।

গত বছরের ১৭ অক্টোবর সকাল সাড়ে নয়টায় তরু চৌধুরী নামের এক নারী খুলশী রেলক্রসিং থেকে এ কে খান যাওয়ার জন্য মাহিন্দ্রা টেম্পোতে উঠেন। তাকে টার্গেট করে পাঁচ নারী ছিনতাইকারী তার গা ঘেঁষে একটি টেম্পোতে বসেন। একপর্যায়ে তাদের একজন তরুণ চৌধুরীর গায়ে বমি করার অভিনয় করেন। তরু চৌধুরী এতে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লে ছিনতাইকারীদের একজন মুহূর্তেই তার গলার হার খুলে নেয়। সেই গাড়ির ভেতরে জায়গা না হওয়ায় তরু চৌধুরীর ভাগ্নে হারাধন দত্ত গাড়িচালকের পাশে বসে ছিলেন। গাড়িচালক গাড়ির লুকিং গ্লাসে তরু চৌধুরীর গলার হার খোলার দৃশ্য দেখে ভাগ্নে হারাধন দত্তকে জানান। একপর্যায়ে গাড়ি থামলে ছিনতাইকারী নারীদের সবাই দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন হারাধন দত্ত স্থানীয়দের সহযোগিতায় তিন ছিনতাইকারীকে ধরে ফেলেন। পরে খুলশী থানায় খবর দেওয়া হলে তিন নারী ছিনতাইকারীকে আটক করে। তবে দুজন পালিয়ে যায়। ধরা পড়া এই তিন ছিনতাইকারীর বাড়িই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। এরা হলেন রুবিনা, শাহানা বেগম ও রিপা আক্তার। রুবিনার বিরুদ্ধে নগরীর কোতোয়ালী থানায় দুটি এবং রাউজান থানায় একটি মামলা রয়েছে। শাহানা বেগমের বিরুদ্ধে কুমিল্লার হোমনা থানায় একটি মামলা রয়েছে।

এর আগে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর দুপুরে নগরীর আন্দরকিল্লা এলাকায় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে আড়াই মাস বয়সী শিশুকে টিকা দিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছিলেন খাদিজা আক্তার নামের এক নারী। পৌনে একটার দিকে আন্দরকিল্লার ‘মল টোয়েন্টিফোর’ শপিং কমপ্লেক্সের সামনে আইল্যান্ডে পাশে পৌঁছাতেই সাত নারী তাকে পথচারীর বেশে ঘিরে ধরেন। এর একপর্যায়ে চোখের পলকে টান মেরে খাদিজা আক্তারের হাতব্যাগটি নিয়ে যায় তারা। ওই ঘটনায় আটক হওয়া সাত নারী ছিনতাইকারীর মধ্যে তিনজনের বাড়িও ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে। এরা হলেন রিমা আকতার (২৫), বিলকিস বেগম (২৫) এবং রুমা আকতার (২০)। বাকি চারজনের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে। এরা হলেন রহিদা বেগম (২৫), ববিতা বেগম (৩৫), পাপিয়া (৪০) এবং সাথী আক্তার শান্তা (২৮)।

২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল রুবিনা ও জান্নাত আক্তার নামের দুই নারী ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। দুজনের বাড়িই ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে। তারা টার্গেট করা পথচারীর সঙ্গে গায়ে পড়ে ঝগড়া শুরু করেন। ঝগড়ার একপর্যায়ে সুযোগ বুঝে ঝাপটা দিয়ে মোবাইল ও মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যান— এটাই তাদের কৌশল। গ্রেপ্তার হওয়ার দিন সকালে তারা নগরীর লালদিঘি এলাকায় এমনই এক কৌশলে চট্টগ্রামের এক নারী সংবাদকর্মীর গলার চেইন নিয়ে দৌড় দেন। ওই সংবাদকর্মীর চিৎকারে পুলিশ এগিয়ে এসে তাদের গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি চার আনা ওজনের স্বর্ণের চেইনটিও উদ্ধার করে।

চলতি বছরের ৩১ জুলাই গভীর রাতে চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ফারজানা বেগম (৩৮) নামে এক ছিনতাইকারীকে। তিনি আবার টিকটক ও লাইকিতেও সক্রিয়। তবে ধরা পড়ার আগেই তার বিরুদ্ধে মামলা ছিল আটটি। পুলিশ জানায়, ফারজানা খুবই দুর্ধর্ষ ছিনতাইকারী। কিশোরদের নিয়ে তার নিজস্ব একটি ছিনতাইকারী দলও আছে। ছেলে ও মেয়েদের কাছ থেকে আলাদা কৌশলে ছিনতাই করেন তিনি। সচরাচর একা চলাচলরত কোনো ছেলেকে প্রথমে টার্গেট করেন তিনি। এরপর ঠিকানা জিজ্ঞেস করার নামে তাকে থামান। ছেলে থামলেই ছোরা দেখিয়ে তার কাছে থাকা টাকা ও মোবাইল দিয়ে দিতে বলেন, নতুবা তার বিরুদ্ধে ইভটিজিং ও যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনার হুমকি দেন। এতে ভয়ে সবকিছু দিয়ে দেয় ছেলেরা। আর মেয়েদেরও ঠিকানা জিজ্ঞেস করার ভান করে থামায়। এরপর ছোরার ভয় দেখিয়ে সব ছিনিয়ে নেয়।

ফারজানার স্বামী রুবেলও ছিনতাইকারী। চলতি বছরের জুলাইয়ে এলজি ও ছোরাসহ গ্রেপ্তার হন তিনি। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১১টি মামলা রয়েছে। তারা স্বামী-স্ত্রী মিলেই একটি ছিনতাইচক্র গড়ে তোলেন। সর্বশেষ গত ১৯ জুলাই নগরীর আন্দরকিল্লা মোড়ে তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটান। তাদের বাসা নগরীর দেওয়ানহাটের সুপারিপাড়া এলাকায়। তবে তারা আগ্রাবাদের আক্তারুজ্জামান সেন্টারের আশপাশে ভাসমানভাবে অবস্থান করেন।

নারী ছিনতাইকারী শুধু চট্টগ্রাম নগরেই নয়, বিভিন্ন উপজেলায়ও তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। গত বছরের ৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার বারইয়ারহাট পৌরবাজারে এক মহিলার চেইন ছিনতাইয়ের সময় ৫ নারী ছিনতাইকারীকে আটক করে পুলিশে দেয় স্থানীয় লোকজন। আটক ওই ৫ নারী ছিনতাইকারীও চট্টগ্রামের বাইরের বিভিন্ন জেলার। এরা হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর থানার ডরমন্ডল গ্রামের কহিনুর আক্তার, সৈয়দা বেগম, রোজিনা বেগম, রুনা আক্তার ও হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থানার শিবপুর গ্রামের তাছলিমা আক্তার।

২০১৮ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ছয় নারী গ্রেপ্তার হন— যারা যাত্রীবেশে বাসে উঠে জটলা তৈরি করে ছিনতাই চালাতেন।
গ্রেপ্তার নারীরা হলেন আফিয়া বেগম (১৮), ফুলতারা বেগম (২২) , সাহার বানু (৫৫), সুলতানা বেগম (২৩), নাজমা বেগম (৩৫) ও মরিয়ম বেগম (২৫)। তার আগে চট্টগ্রাম নগরীর বাসে এক নারী যাত্রীর চেইন ছিনিয়ে নেওয়ার সময় রাহেলা (৪০) নামের এক নারী ছিনতাইকারী ধরা পড়েন। পরে তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সীতাকুণ্ডের ফকিরহাট ইমামনগর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ওই ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালী থানার পুলিশ। রাহেলাসহ সাতজনই পরস্পরের আত্মীয় এবং তাদের সকলের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে।

কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নেজাম উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সংঘবদ্ধ এই ছিনতাইচক্রের সদস্যরা রাস্তা পারাপারের সময় টার্গেট করা মহিলার পিছু নেন। সুযোগ বুঝে চারপাশে ঘিরে কৌশলে মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে সরে পড়েন। তারা টেরিবাজার, সিনেমা প্যালেস, আন্দরকিল্লাসহ নগরের বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয়।’

তিনি বলেন, ‘ছিনতাই করার সময় তারা কখনও আলাদাভাবে কাজ করে না। কোথাও গেলে ৫-৬ জন একসঙ্গে যান। তারা যাকে টার্গেট করেন, তার পিছু নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়ার পর ঘিরে ধরেন। এরপর ভয়ভীতি দেখিয়ে মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়ে দ্রুত সটকে পড়েন।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!