চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বুলেট ট্রেনে ৫৫ মিনিট, ডাবল লাইনে পৌনে ২ ঘন্টা— সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর হাতে

বুলেট ট্রেনের জন্য টাকা দিতে চায় অস্ট্রেলিয়া-চীন-তুরস্ক

মাত্র এক ঘন্টায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার ‘বুলেট ট্রেন’ প্রকল্পে ১০২ কোটি টাকা খরচ করার পর রেলওয়ে এবার ডাবল লাইনে পৌনে দুই ঘন্টায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার আরও একটি বিকল্প উপায় খুঁজছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বুলেট ট্রেন নাকি ডাবল লাইন— শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই।

বর্তমানে রেলপথে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ৩২১ কিলোমিটার পথ যেতে সময় লাগে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা। বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার ট্রেনগুলো চলে ঘন্টায় মাত্র ৬০ কিলোমিটার গতিতে। দীর্ঘ ও সময়সাপেক্ষ এই পথে যাতায়াতে সময় কমিয়ে আনতে দ্রুতগতির ‘বুলেট ট্রেন’ চালুর উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। চট্টগ্রাম-ঢাকা রেলপথে যাত্রীদের কর্মঘণ্টা অপচয় ও জরুরি আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে ধীরগতিসহ নানা বিষয় বিবেচনা করে ২০১৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম ভায়া কুমিল্লা দ্রুতগতির রেলপথ নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিশদ নকশা প্রণয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। গত ৩০ জুন ওই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়।

বুলেট ট্রেন প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী, ইউরোপের আদলে পাঁচটি স্টেশন নির্মাণ করা হবে।
বুলেট ট্রেন প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী, ইউরোপের আদলে পাঁচটি স্টেশন নির্মাণ করা হবে।

প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিস্তারিত নকশা তৈরির কাজ অবশ্য ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। এর পেছনেই ইতিমধ্যে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১০২ কোটি টাকা। বুলেট ট্রেন প্রকল্পটি অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব হবে উল্লেখ করে ওই সমীক্ষায় বলা হয়, চট্টগ্রাম-ঢাকা নতুন রেলপথটি হবে স্ট্যান্ডার্ড গেজ, ইলেকট্রিক ট্র্যাকশনসহ ডাবল লাইনবিশিষ্ট। ট্র্যাক হবে পাথরবিহীন।

যা থাকছে বুলেট ট্রেন প্রকল্পের নকশায়

প্রস্তাবিত নকশা অনুযায়ী চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা রেলপথের দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ২২৪ দশমিক ৬ কিলোমিটার— যার প্রায় ৯৬ শতাংশই এলিভেটেড। বুলেট ট্রেনে ৫৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টায় ২২৪ কিলোমিটার পথ যাতায়াত করা যাবে। তবে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০০ কিলোমিটার গতিতেও ছুটতে পারবে বুলেট ট্রেন। এতে প্রতিদিন প্রায় এক লাখ যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে।

বুলেট ট্রেন প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী, চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, ফেনী, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় ইউরোপের আদলে পাঁচটি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। প্রতিটি স্টেশন ঘিরেই থাকবে এক-একটি মাল্টি মডেল ট্রানজিট হাব। এর ফলে বুলেট ট্রেন ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা (দাউদকান্দি), লাকসাম ও ফেনী হয়ে চট্টগ্রামে আসবে। বর্তমানে প্রচলিত সিস্টেমে চট্টগ্রামে ট্রেন আসে কমলাপুর থেকে গাজীপুরের টঙ্গী, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জের ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও ফেনী হয়ে।

চট্টগ্রামে বুলেট ট্রেনের স্টেশনটি হবে এরকম
চট্টগ্রামে বুলেট ট্রেনের স্টেশনটি হবে এরকম

বুলেট ট্রেন চালু করতে খরচ হবে প্রায় ৯৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। ব্যয়বহুল এই প্রকল্পের জন্য এখন টাকার উৎস খোঁজা হচ্ছে। তবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে এতো বেশি টাকার দরকার যে, সরকার শেষ পর্যন্ত ‘বুলেট ট্রেন’ প্রকল্প শুরু করবে কিনা— সেটি এখনও খানিকটা অনিশ্চিত। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই।

টাকা দিতে চায় অস্ট্রেলিয়া-চীন-তুরস্ক

চলতি বছরের মার্চে বাংলাদেশে রেলওয়ের দুটি মেগা প্রকল্প ঢাকা-চট্টগ্রাম উচ্চগতির ট্রেন ও লিংক প্রকল্প বাস্তবায়নে আকর্ষণীয় ঋণ প্রস্তাব দিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার প্রভিডাস ইনভেস্টমেস্ট প্রাইভেট লিমিটেড। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো প্রতিষ্ঠানটির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, প্রকল্প দুটির অনুমিত সম্পূর্ণ খরচ প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে প্রতিষ্ঠানটি।

ঢাকায় বুলেট ট্রেনের স্টেশনটি হবে এরকম
ঢাকায় বুলেট ট্রেনের স্টেশনটি হবে এরকম

এদিকে চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিআরসিসি) ও চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশনও (সিসিইসিসি) ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড রেললাইন নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠান দুটি জানিয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নে তারা যৌথভাবে একটি কোম্পানি গঠন করবে। গত বছরের ৯ অক্টোবর ঢাকার চীনা দূতাবাসের মাধ্যমে এ বিষয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়। সর্বশেষ গত অক্টোবরে রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মুস্তাফা ওসমান তুরান বাংলাদেশে রেল খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

বিকল্প উপায়ে পৌনে ২ ঘন্টায় চট্টগ্রাম-ঢাকা

তবে এরই মধ্যে বিকল্প আর একটি উপায় নিয়েও এগোচ্ছে রেলওয়ে। চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটে ডুয়েল গেজ বা ডাবল লাইনের একটি প্রকল্পের সমীক্ষা চলছে এখন। এটি বাস্তবায়ন করা গেলে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যেতে সময় লাগবে পৌনে দুই ঘণ্টা। এই ডাবল লাইনে ট্রেন চলবে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে। আবার এই প্রকল্পকে বাস্তবে রূপ দিতে খরচও পড়বে তুলনামূলক কম।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বুলেট ট্রেনে যাত্রী পরিবহনে সুবিধা পাওয়া গেলেও তাতে বাণিজ্যিক সুবিধা মিলবে না। কিন্তু ডাবল লাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে তাতে মিলবে বাণিজ্যিক সুবিধা। কারণ ওই লাইনে যাত্রীর পাশাপাশি পণ্য পরিবহনও করা যাবে। দেশের আমদানি-রপ্তানির ৮০ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে হয়। সামনে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরী, পতেঙ্গায় বে-টার্মিনাল, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন শেষ হলে চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটে পণ্যবাহী ট্রেনের চাহিদা বেড়ে যাবে বহুগুণ।

তবে বুলেট ট্রেন হোক কিংবা ডাবল লাইন— চট্টগ্রাম-ঢাকায় রেলপথে এক ঘন্টা কিংবা পৌনে ২ ঘন্টায় যাতায়াত করা গেলে রাজধানীর সঙ্গে বাণিজ্যিক রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থার চিরাচরিত চিত্রটিই বদলে যাবে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!