চট্টগ্রাম-ঢাকার গুরুতর কিডনি রোগীরা ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি, আবার ডায়ালাইসিস বন্ধ হওয়ার শঙ্কা

চট্টগ্রাম ও ঢাকার দুই প্রধান হাসপাতালে কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস কার্যক্রম হঠাৎ করেই একযোগে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর হাসপাতালে যাওয়া রোগী ও তাদের স্বজনরা পড়ে যান ভয়াবহ সংকটে। বুধবার (২ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ঢাকার জাতীয় কিডনি ইন্সটিটিউট অ্যান্ড ইউরোলজি একই সময়ে কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস বন্ধ হয়ে গেলে সৃষ্টি হয় এক ভীতিকর পরিস্থিতির।

এই হাসপাতালগুলোতে তুলনামূলক গরিব কিডনি রোগীরা জীবন রক্ষাকারী ডায়ালাইসিস সেবার সুযোগ পান। প্রাইভেট হাসপাতালে যেখানে ডায়ালাইসিস করাতে লাগে সাড়ে তিন হাজার থেকে আট হাজার টাকা, সেখানে সরকারি এসব হাসপাতালে মাত্র ৪৮৩ টাকা ব্যয়ে ডায়ালাইসিস করার সুবিধা রয়েছে। বাকি ভর্তুকির টাকা সরকারই পরিশোধ করে।

বেসরকারি সংস্থা কিডনি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি বছর অন্তত ৪০ হাজার মানুষের কিডনি অকেজো হচ্ছে। এ ধরনের গুরুতর রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয় দুইভাবে। এর একটি হল ডায়ালাইসিস— যাতে বিশেষায়িত যন্ত্রের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে কিডনিকে সচল রাখা হয়। ডায়ালাইসিস রোগীর ক্ষেত্রে প্রতি সপ্তাহে তিনটি করে ডোজ দিতে হয়। অকেজো কিডনির অন্য চিকিৎসাটি হচ্ছে কিডনি প্রতিস্থাপন।

চট্টগ্রাম মেডিকেলসহ দুটি প্রতিষ্ঠানেই ডায়ালাইসিস কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে আছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ‘স্যানডোর ডায়ালাইসিস সার্ভিসেস’। মূলত বকেয়া টাকা আদায়ের জন্যই ভারতীয় ওই প্রতিষ্ঠানটি হঠাৎ করে ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দিয়েছিল।

এর আগে গত জানুয়ারিতেও একবার চট্টগ্রাম মেডিকেলে ডায়ালাইসিস সেবা বন্ধ করে দিয়েছিল ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটি। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেলের তৎকালীন পরিচালকের আশ্বাসে আবার সেবা চালু করে প্রতিষ্ঠানটি। গত বুধবার (২ ফেব্রুয়ারি) সকালে আবারও ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দিলে হাসপাতালের নতুন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বকেয়া টাকা পরিশোধের আশ্বাস দিলে ৮ ঘণ্টা পর ডায়ালাইসিস সেবা চালু করা হয়।

এখন ‘স্যানডোর ডায়ালাইসিস সার্ভিসেসের’ পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে বকেয়া শোধ করা না হলে তারা আবার ডায়ালাইসিস সেবা বন্ধ করে দেবে।

বকেয়া যা-ই থাকুক, ডায়ালাইসিসের মতো একটি জীবনরক্ষাকারী সেবা কোনো আগাম সতর্কতা ছাড়াই এভাবে হঠাৎ করে বন্ধ করে দেওয়া যায় কিনা— এ নিয়ে সরব হয়েছেন অনেকেই। রোগী ও রোগীর স্বজনরা প্রকাশ করছেন ক্ষোভ। চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ‘স্যানডোর ডায়ালাইসিস সার্ভিসেস’ চরম অন্যায় ও স্বেচ্ছাচার করেছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

এদিকে এই ঘটনার জের ধরে শনিবার (৫ ফেব্রুয়ারি) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ পদস্থ কর্মকর্তারা ঢাকার জাতীয় কিডনি ইন্সটিটিউট অ্যান্ড ইউরোলজি পরিদর্শন করেছেন। কিডনি ইনস্টিটিউট এরই মধ্যে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি রিভিউ করা হবে বলে জানিয়েছে। প্রয়োজনে তারা এ নিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছে।

অন্যদিকে সমস্যাটির দ্রুত একটি স্থায়ী সমাধান প্রত্যাশা করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আফতাবুল ইসলাম বলেছেন, ‘এখানে অনেক গরিব রোগীর ডায়ালাইসিস হয়। এভাবে বন্ধ করলে তো মারাত্মক সমস্যা হয়। আশা করছি এর একটি স্থায়ী সমাধান হবে— যাতে রোগীদের ভোগান্তি আর না হয়।’

জানা গেছে, ২০১৫ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে ১০ বছরের চুক্তিতে সরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়া শুরু করে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ‘স্যানডোর ডায়ালাইসিস সার্ভিসেস’। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি ডায়ালাইসিসে মাত্র ৪৮৩ টাকা দিতে হয় রোগীদের। বাকি টাকা দেয় বাংলাদেশ সরকার। এই সুবিধায় প্রতি ৪ ঘণ্টায় এক সেশন ধরে বছরে ২৯ হাজার ৬০৯টি সেশন দেওয়ার কথা ওই প্রতিষ্ঠানের।

জানা গেছে, করোনাভাইরাসে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত দুই বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি থেকে বেশি সেশন নেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ঢাকার জাতীয় কিডনি ইন্সটিটিউট অ্যান্ড ইউরোলজিতে। এর মধ্যে শুধু ২০২১ সালেই নেওয়া হয়েছে ৫৯ হাজার সেশন। মূলত এই টাকা আদায়ের জন্য চাপ হিসেবে ডায়ালাইসিস সেবা হঠাৎ বন্ধ করে দেয় ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটি।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ঢাকার জাতীয় কিডনি ইন্সটিটিউট অ্যান্ড ইউরোলজিতে ডায়ালাইসিস সেবায় অতিরিক্ত সেশন নেওয়ার বিল দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১৫ কোটি টাকা। তবে এর মধ্যে প্রায় ৮ কোটি টাকা ইতিমধ্যে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটিকে পরিশোধও করা হয়েছে। এরপরও বাকি টাকার জন্য প্রতিষ্ঠানটি রোগীদের জিম্মি করে চাপ সৃষ্টির কৌশল নিয়েছিল।

চট্টগ্রামে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ‘স্যানডোর ডায়ালাইসিস সার্ভিসেসের’ তত্ত্বাবধায়ক হিমেল আচার্য গত বৃহস্পতিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) মুঠোফোনে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাকির টাকা আমাদের হিসেবে এত বেশি হয়ে গিয়েছে যে, আমরা আমাদের খরচ কুলাতে পারছি না। (চট্টগ্রাম মেডিকেলের) আগের পরিচালক বিভিন্ন সময় আশ্বাস দেওয়ার পরও সমস্যার সমাধান হয়নি। ২০২০ এবং ২০২১ সালে প্রদত্ত সেবার বিপরীতে কর্তৃপক্ষের কাছে সর্বমোট বকেয়া এতটা বেশি যে, তহবিল সংকট ও কাঁচামালের অভাবে এ জরুরি সেবা কোনোভাবেই চলমান রাখা সম্ভব হচ্ছে না।’

হিমেল আচার্য বলেন, ‘নতুন পরিচালক আমাদের সেন্টারে এসে আশ্বাস দিয়েছেন, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বকেয়া টাকা পরিশোধ করবেন। এ আশ্বাস পেয়ে আমরা আমাদের সেবা পুনরায় চালু করেছি। তবে টাকা না পেলে আবার ডায়ালাইসিস সেবা বন্ধ করে দেওয়া হবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!