চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন নিলেন মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ

পাকিস্তানি পতাকায় আগুন দিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন বোনা এক লড়াকু সৈনিকের নাম মোহাম্মদ ইউনুছ। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে নিঃস্বার্থে নিবেদিত প্রাণ এ বীর মুক্তিযোদ্ধা। জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে নিয়েছেন মনোনয়নপত্র। শেষ বয়সে দেশ-দশের সেবা করে সম্মানিত হতে চান তিনি।

রোববার (৪ সেপ্টেম্বর) তিনি মনোনয়নপত্র নিয়েছেন। সোমবার (৫ সেপ্টেম্বর) এ মনোনয়নপত্র জমা প্রদানের কথা রয়েছে।

জানা গেছে, গত ২৩ আগস্ট জেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। তফসিল অনুযায়ী ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মনোনয়নপত্র দাখিল করতে হবে। মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ১৮ সেপ্টেম্বর। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়েরের সময় ১৯ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর। ২২ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তি করা হবে। ২৫ সেপ্টেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময়। ২৬ সেপ্টেম্বর প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে। ভোটগ্রহণ হবে ১৭ অক্টোবর।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ বলেন, ‘দলের জন্য জীবন শেষ করলাম, তবে কোনো পদে নেই। যদি দল থেকে মনোনয়ন দেয় নির্বাচন করবো। আমার শপথ ছিল, যতদিন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসিতে ঝুলাতে পারবো না, ততদিন আমি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাছ থেকে কিছু চাইবো না। এখন আমি চাইছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার মতো দলের জন্য দীর্ঘদিন কারাবরণ ও নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করেছে এমন মানুষ বাংলাদেশে কমই আছে। নেতাদের ডিঙিয়ে যেতে পরিনি বলে পদ-পদবিও নেই।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউনুছ ১৯৫৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম হাটহাজারী থানার নূর আলী মিয়ার হাট ফরহাদাবাদ গ্রামের হিম্মত মুহুরী বাড়ির মরহুম নুর হোসেনের সন্তান। তার পিতা ছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক উচ্চতর হিসাব কর্মকর্তা।

তিনি মুজিববাহিনী ৭১ এর যুদ্ধক্ষেত্র- চট্টগ্রাম পূর্বাঞ্চলের সম্মুখযোদ্ধা ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে বি.কম পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ডিগ্রি পাশ করেন।
১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় পাকিস্তানি পতাকা জ্বালিয়ে দেন। পরদিন ৩ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে চট্টগ্রামের রাজপথ প্রদক্ষিণ করেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাক নৌ-কমান্ডোর সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরে প্রথম সংঘর্ষ এবং রাইফেলসহ গ্রেপ্তার হন। ২ মাস ৬ দিন ধরে দৈহিক নির্যাতন সহ্য করে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে পালিয়ে ভারত পাড়ি দেন। ভারতের উত্তর প্রদেশ দেরাদুন তানদুয়ায় ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সামরিক প্রশিক্ষন নেন। উচ্চতর গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

তাছাড়া জিয়াউর রহমান সামরিক জান্তা আমলে ১৯৭৬ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিরোধ যুদ্ধ করতে গিয়ে ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে গোয়েন্দা সংস্থার হাতে গ্রেপ্তার হন। এরপর তাকে ঢাকা সেনানিবাসে ৯ দিন, কুমিল্লা সেনানিবাসে ৩ দিন এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ১ মাস ২৮ দিন দৈহিক নির্যাতন করে চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়।

১৯৮০ সালে কারাগার থেকে মুক্তির পর একাধিকবার দিল্লি গমণ ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে দিল্লির পানদার রোডের বাসভবনে সাক্ষাৎ করে দেশে ফিরে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এতে সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন ডা. এসএ মালেক। তাছাড়া জিয়াউর রহমান হত্যার পর ডিজিএফআই কর্তৃক গ্রেপ্তারের চেষ্টাও করা হয় তাকে।

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত সার্বক্ষণিক কর্মী হিসাবে সঙ্গে ছিলেন। সঙ্গে আরও ছিলেন যুবলীগ নেতা আবুল কাশেম মন্টু (সূত্রাপুর), ছাত্রনেতা হুমায়ন, জাহেদসহ অনেকে। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত আক্রমণের সময় সার্বক্ষণিক নেত্রীর সঙ্গে ছিলেন। মোহাম্মদ ইউনুছ জানান, ‘সে সময় সঙ্গে আরও ছিলেন নজীব ভাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এসএ মালেক (মহাসচিব, বঙ্গবন্ধু পরিষদ), সাবেক মন্ত্রী মরহুম জহুর আহম্মদ চৌধুরী, এমএ আজিজ, এমএ হান্নান, এমএ মান্নান, আকতারুজ্জামান চৌধুরী (বাবু),আতাউর রহমান খান কায়সার, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশারফ হোসেন এমপি, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহম্মদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে সুদীর্ঘ সময় সংগঠনের কর্মকাণ্ড করেছি।’

কারাজীবন

১৯৬৯ সালে গ্রেপ্তার হয়ে ১৫ দিন কারাবরণ করেন তিনি। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি বাতিলের আন্দোলনে যুক্ত থেকে পাকিস্তান সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে ৯ মাস সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯৭৬ সালে ‘বিশেষ সামরিক আদালত- ৪’ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলায় ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৮০ সালের ১ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দি জীবন কাটান। এ ৪ বছর কারাজীবনে ২ বছর কাঠিয়েছেন কনডেম সেলে।

এছাড়া এ বীর মুক্তিযোদ্ধা ১৯৬৮ থেকে ৬৯ পর্যন্ত চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুল ছাত্রলীগ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ থেকে ৭০ পর্যন্ত বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় মাধ্যমিক স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭০ থেকে ৭১ চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ থেকে ৭৩ চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

তাছাড়া ১৯৭৩ থেকে ৭৫ পর্যন্ত দুই মেয়াদে চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ থেকে ৭৮ পর্যন্ত চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দি অবস্থায় চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮০ থেকে ৮২ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন।

আরএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!