চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে সাড়ে ৫ কোটি টাকার দুর্নীতি ঢাকতে অবিশ্বাস্য সব নাটক

পাঁচলাইশ থেকে কোতোয়ালী থানা, অতঃপর দুদকের দুয়ারে

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ৫ কোটি ৩৭ লাখ ২৫ হাজার টাকার দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ার ৩৬ ঘন্টা পরও অভিযোগ দায়ের হয়নি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। টানা দুই দিন ধরে এ নিয়ে চলছে অবিশ্বাস্য লুকোচুরি। এই ঘটনার জের ধরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে চট্টগ্রাম নগরীর দুটি থানায় চক্কর কাটলেও অভিযোগ দায়ের করতে গড়িমসি করেই যাচ্ছে। সর্বশেষ দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) ডেকেছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, দুর্নীতির ঘটনায় প্রধান অভিযুক্তকে বাদ দিতেই ক্রমাগত নাটকের আশ্রয় নিচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫ কোটি ৩৭ লাখ ২৫ হাজার টাকায় আটটি আইসিইউ বেড ও অন্যান্য সামগ্রী কেনা হয়। অনিয়মের অভিযোগে এ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা দায়ের করে। এরপর প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকার ওই বিলটি আটকে যায়। জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বিলটি ছাড়ানোর জন্য তৎপর হয়ে ওঠে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ হাসপাতালেরই একটি চক্র। এর জের ধরে গত ১৭ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে একটি তদন্ত কমিটিও চট্টগ্রামে আসে। তবে চক্রটি তৎপর ছিল এতোকিছুর পরও।

জানা গেছে, প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফোরকান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি স্মারকের নম্বর জেনারেল হাসপাতালের বিলের কাগজে বসিয়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের আটকে যাওয়া একটি ৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকার বিল পাশ করানোর চেষ্টা করেন। এজন্য তিনি ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে তত্ত্বাবধায়কের স্বাক্ষরও করিয়ে নেন। পরে তত্ত্বাবধায়কের স্বাক্ষরযুক্ত ভুয়া বিলটি নিয়ে যখন মঙ্গলবার (২৮ জুন) বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রণ অফিসে যান, সেখানে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের কাছে বিষয়টি ধরা পড়ে।

এরপর বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রণ অফিস থেকে ফোরকানকে পাঁচলাইশ থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ঘটনা শুনে হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ও চট্টগ্রামের সাবেক সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বী তাৎক্ষণিক থানায় গিয়ে নিজের জিম্মায় ফোরকানকে ছাড়িয়ে আনেন বলে জানা যায়। পরে পাঁচলাইশ থানা থেকে অভিযোগ দায়েরের জন্য তাদের পাঠানো হয় কোতোয়ালী থানায়।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ভুয়া স্মারক নম্বর দিয়ে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা লোপাটের খবর প্রকাশ হওয়ার পর দুর্নীতির ঘটনা ও এর সঙ্গে প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার জড়িত থাকার বিষয়টি নিয়ে শুরুতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ছাড়াও এমনকি প্রশাসনও মুখ খুলতে চায়নি।

ঘটনার দিন মঙ্গলবার (২৮ জুন) রাত ১০ টার দিকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে এরপর ভোররাত ৪টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানায় ‘শলাপরামর্শ’ হলেও দায়ের হয়নি কোনো অভিযোগপত্র।

জানা গেছে, বুধবার (২৯ জুন) কোতোয়ালী থানা পুলিশের পরামর্শে অভিযোগ জানাতে শেষমেশ দুদকের দারস্থ হন হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক সেখ ফজলে রাব্বী। তবে খবর নিয়ে জানা গেছে, বুধবার রাত পর্যন্ত দুদকে এই ঘটনায় কোনো অভিযোগ জমা পড়েনি।

কেন এমন একটি ঘটনায় ৩৬ ঘন্টাতেও অভিযোগ দায়ের হল না— এমন প্রশ্নের উত্তরে হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. ফজলে রাব্বী সরাসরি কোনো উত্তর না দিলেও বলেন, ‘আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) আপনাদের জন্য সুসংবাদ আছে। কষ্ট করে আর একটা দিন অপেক্ষা করেন।’

এমন একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনায় কেন অভিযোগ নেওয়া হচ্ছে না— এমন প্রশ্নের জবাবে কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহেদুল কবির বুধবার (২৯ জুন) রাতে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘জেনারেল হাসপাতালে স্মারক নাম্বার জাল করে যে দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে, সেটা আমাদের তদন্তাধীন ঘটনা না। তাই আমরা ঘটনাটি সম্পর্কে সম্পূর্ণ জানার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানাই বিষয়টি দুদকের আওতাধীন। তাই তারা যেন অভিযোগ বা মামলাটি দুদকেই করেন। ওনারা আজ দুদকে গিয়েছেন। এখন বাকি বিষয় দুদক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।’

তবে অন্য একটি সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের প্রধান হিসাব কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফোরকানকে বাদ দিয়ে অভিযোগ দিতে চাওয়ায় তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে কোতোয়ালী থানা পুলিশ। সেজন্য ভোর রাত পর্যন্ত থানায় বসে থেকেও অভিযোগ আর দায়ের করা যায়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ফোরকানের তৈরি ভুয়া কাগজটি স্বাক্ষর করার আগে যদি একবার যাচাই-বাছাই করা হতো, তবে জালিয়াতির বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গেই ধরা পড়তো। ওই বিলে স্বাক্ষর করে ডা. ফজলে রাব্বি দায়িত্বহীন আচরণ করেছেন। ফোরকানকে বাদ না দিয়ে যদি মঙ্গলবার রাতেই অভিযোগ করতো তবে বিষয়টি এত ঘোলাটে হতো না। বৃহস্পতিবারের মধ্যে যদি ডা. ফজলে রাব্বি অভিযোগ দায়ের করতে ব্যর্থ হন, তবে সেজন্য তাকেও আইনি মারপ্যাঁচে পড়তে হতে পারে।’

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এতোকিছুর পরও শুরুতে প্রধান হিসাব কর্মকর্তা ফোরকানকে অভিযুক্ত হিসেবে মানতে রাজি ছিলেন না হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বী। তিনি দুর্নীতির বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দিকেই আঙুল তোলেন।

তবে বুধবার (২৯ জুন) রাতে দুর্নীতির ঘটনায় ফোরকান জড়িত কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে ফজলে রাব্বী বলেন, ‘তদন্তের পর বোঝা যাবে সে অপরাধী কিনা। ফোরকানকে আপাতত কাজ থেকে দূরে রাখা হয়েছে। তাকে হিসাবের কোনো কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না।’

ঘটনার দিন পাঁচলাইশ থানায় ফোরকানকে আটকে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, ওকে কেন আটকে রাখবে?’

ডিজে/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!