চট্টগ্রাম কাস্টমসে প্রবাসীরা নাজেহাল, ফাইল নড়ে ২০ জায়গার ঘুষে

এক ফাইলের কাজ শেষ করতেই লাগে ১-২ মাস

টাকা দিলে ফাইল নড়ে। আগে টাকা তার পরেই স্বাক্ষর। কাস্টমসের ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি অনেকটাই প্রথায় পরিণত হয়েছে। একটি ফাইলের কাজ শেষ করতে সময় লাগে প্রায় ১-২ মাস। ফাইল ঘোরে টেবিলে-টেবিলে। এমন অভিযোগ করলেন বিদেশ থেকে আসা প্রবাসীরা।

তাদের অভিযোগ, বিদেশ থেকে ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য দুটির বেশি আনলে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এসব পণ্য আটক করে। পরে এই মালামালগুলো ছাড়িয়ে নিতে যেতে হয় চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস থেকে। সেখানে পদে পদে নানা নাটকীয়তা ও হয়রানি। ফাইল নিয়ে ঘুরতে হয় ধাপে ধাপে ১৮-২০ বার। প্রতিটি স্তরে টাকা দিলেই ফাইল নড়ে। পদে পদে হয়রানি ও পণ্যের মূল্যের চাইতে অতিরিক্ত টাকা দেওয়ার পরই পাওয়া যায় বিমানবন্দরে যাত্রীদের কাছ থেকে ডিএম রশিদ মূলে আটককৃত মালামাল।

জানা গেছে, নাজিউর রহমান নামের এক দুবাই প্রবাসী দীর্ঘদিন প্রবাসযাপন করে দেশে আসার সময় পরিবারের জন্য অন্য মালামালের সঙ্গে দুটি মোবাইল ফোন, তিনটি ট্যাব নিয়ে আসলে বিমানবন্দরের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তার মালামালগুলো আটক করে একটি ডিএম রশিদ ধরিয়ে দেয়। পরে তিনি এগুলো ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য কাস্টমস হাউসে গেলে তাকে স্টাফ শাখা থেকে বলা হয় ‘সময় লাগবে, আজকে হবে না পরে আসেন।’ এভাবে পর দিন আসলেও কোনো কাজ হয়নি। এখানে বার বার আসা-যাওয়া নিয়ে ভোগান্তি পেয়ে শেষ পর্যন্ত ওই মালামালগুলো ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য তার এক আত্মীয়কে আমমোক্তারনামা দিয়ে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।

এ ঘটনায় প্রতিবেদক সরেজমিনে গিয়ে আটককৃত পণ্য ছাড়ানোর কাজে যুক্ত হন।

প্রথম ধাপে দেখা যায়, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটককৃত পণ্যের ডিএম রশিদ নিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে মালামালগুলো ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রথম ধাপ হল স্টাফ শাখা। সেখানে কাজটি শেষ করতে প্রায় পাঁচ স্তর পার হতে হয়। প্রতিটি ধাপে টাকা দিলে ফাইল নড়ে। না হয় ফাইলে কোন স্বাক্ষর দেন না কর্মকর্তারা। দেখা যায় স্বাক্ষর পড়লেও তার ওপর আবারও সিল মারার জন্য টাকা দিতে হয়।

দ্বিতীয় ধাপে দেখা যায়, স্টাফ শাখা থেকে ফাইল বের হয়ে যাবে শুনানিতে। সেখানে রাজস্ব কর্মকর্তা আবারো ফাইলটি দেখে জরিমানা দেখিয়ে পাঠাবেন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) কাছে। এখানেও একই পরিস্থিতি। এরপর ফাইলটি পুনরায় স্টাফ শাখায় কেরানি চাকমা বাবুর টেবিলে আসবে। চাকমা বাবু এক হাজার টাকার কম হলে ফাইলে পরবর্তী নোট দেন না।

তৃতীয় ধাপে স্টাফ শাখা থেকে ফাইলটি যাবে কাস্টডিয়ানে। এরপর ওখানেও একই পরিস্থিতি। ওখানে দুজন কর্মকর্তা রয়েছেন। সিনিয়রের ঘুষ এক হাজার ও সহকারীর ঘুষ ৫০০ টাকা। টাকা দেওয়ার পর ফাইলে সরকারি ভ্যাট, ট্যাক্স ও জরিমানার বিষয়টি হিসাব-নিকাশ করে এবার পাঠানো হয় ব্যাংকে। ব্যাংকের ফাইলে উল্লেখিত টাকা পরিশোধ করে আবার আসতে হয় কাস্টডিয়ানে। সেখান থেকে নোট লিখে দেওয়া হয় ট্রেজারিতে।

চতুর্থ ধাপে দেখা যায়, ট্রেজারিতে আছেন একজন বয়স্ক মহিলা নাম রক্ষি রানী দে। সেখানে ৫০০ টাকা দিলে ফাইল দেখা হয়। এরপর ব্যাংকের টাকা জমা দেওয়ার পে-অর্ডারটা আবার আরেকটি ব্যাংকে জমা দিতে হয়। সেখানে ফাইলের সঙ্গে ১০০ টাকা দিয়ে কাজ করতে হয়। এরপর আবার ট্রেজারি। নোট লিখে দেওয়া হয় সুপার ট্রেজারি বরাবর। এর জন্য যেতে হয় তিনতলা সেকশান-২-এ। সেখানে একই হিসেব। ২০০ টাকা দিয়ে স্বাক্ষর নিতে হয় ফাইলে। স্বাক্ষরের পর সিল দেওয়ার জন্য নিচে এসে আবার ট্রেজারিতে গিয়ে সুপার ট্রেজারির সহকারিকে সিলের জন্য আরও ২০০ টাকা দিতে হয়।

পঞ্চম ধাপে দেখা যায়, ফাইলটি ঘুরে আবার কাস্টডিয়ানে এসেছে। সেখানে অন্য প্রথা। মালামাল নিতে হবে সন্ধ্যার পর। অপেক্ষার প্রহর গুণে মালামাল বুঝে নেওয়ার পর সামনে আসামাত্র পড়তে হয় কাস্টডিয়ানের দারোয়ানের খপ্পরে। ১০০ হলে তিনি নেন না, কমপক্ষে ২০০ টাকা দিতেই হয়। নইলে বের হওয়ার পথ বন্ধ।

মালামাল নিয়ে কাস্টমস হাউস থেকে বের হওয়ার পথে কর্তব্যরত সিকিউরিটি সদস্যরা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা নিতে পথ আটকায়। এক্ষেত্রে রফা হয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকায়। এরপর অবশেষে মুক্ত বাতাসে ফিরতে পারেন ভুক্তভোগী একজন প্রবাসী।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মুহাম্মদ বাবুল মিয়া নামের এক দুবাই প্রবাসী জানান, ‘তিন মাস আগে ১২ কেজি পরিমাণ বাথরুম ফিটিংসের মালামাল এবং তিন কেজি ইলেকট্রনিক্স পণ্য বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ আটক করে। পরে এগুলো ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য কাস্টমসে গেলে ফাইল প্রসেসিং ও শুনানি করতে সময় লাগে প্রায় ২০ দিন। এ পর্যন্ত ফাইলটি ঘুরে আসতে টেবিলে টেবিলে ৬-৮ হাজার টাকা মতো ঘুষ দিতে হয়। শুনানিতে মালামালগুলো অতিরিক্ত মূল্য চার্জ করায় পরে পণ্যগুলো আর ছাড়াইনি।’

কাস্টমস ব্যাগেজ রুল ৩ ধারায় বলা আছে, দুটি মোবাইল শুল্কমুক্ত হিসেবে আনতে পারবেন। তিন থেকে পাঁচটি পর্যন্ত শুল্ক-করাদি (প্রায়) ৩৫% পরিশোধ সাপেক্ষে আনতে পারবেন। এর বেশি আনলে বাণিজ্যিক বিবেচনায় কাস্টমস তা আটক করবে। আটক রশিদ বুঝে নিবেন। আটককৃত মোবাইল ফোন এডজুডিকেশন প্রক্রিয়ায় বিআরটিসি দপ্তরের ছাড়পত্র উপস্থাপন, শুল্ক-করাদি এবং অর্থদণ্ড পরিশোধ সাপেক্ষে ফেরত পেতে পারেন।

এই প্রসঙ্গে জানতে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের ডেপুটি কমিশনার নুর উদ্দিন মিলন ও জয়েন্ট কমিশনার সাধন কুমার কুন্ড মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে দুজনই বিষয়টি এড়িয়ে যান। তারা অতিরিক্ত কমিশনারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপের পরামর্শ দেন। কিন্তু একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তার কাছ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!